২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের গ্রামে ফরাসি পর্যটক পল বালডি

কিশোরগঞ্জে ফরাসি পর্যটক পল বালডি (মাঝে) : নয়া দিগন্ত -

করিমগঞ্জ উপজেলার গুণধর ইউনিয়নের খয়রত গ্রাম। দেশের আর দশটা গ্রামের মতোই ছায়া সুনিবিড়। সামনে দিগন্ত জোড়া ফসলের মাঠ। পেছনে নদী। গ্রামে বেড়াতে এলেন ফরাসি পর্যটক পল বালডি। কাঁধে তার ক্যামেরা। গ্রামে রবি ফসল তোলার ব্যস্ততা চলছে। পল বালডির চোখে-মুখে বিস্ময়। ক্ষেতের আল ধরে তিনি এগিয়ে গেলেন কৃষকের কাছে। পরম আনন্দে কৃষকের সাথে তিনি যোগ দিলেন ফসল তোলায়। সেসবের ছবি তুললেন তিনি ভিডিও করলেন।
গ্রামের শিশু-কিশোররা তাকে পেয়ে মহা খুশি। বিকেলে তাদের সাথে ফুটবল খেললেন। এরপর গ্রামের গাছ থেকে নিজ হাতে বিভিন্ন ফল পেড়ে তাদের সাথে ভাগবাটোয়ারা করে খেলেন। তাকে এ গ্রামে দাওয়াত করে নিয়ে এসেছেন জাফর তুহিন। তার নানার বাড়ির এলাকা এটি। পল বালডি নিজের দেশে গিয়ে বাংলাদেশের এই গ্রাম নিয়ে একটি ব্লগে লিখলেন। ভিডিও তথ্যচিত্র বানিয়ে ইউটিউব চ্যানেলে দিলেন। বাংলাদেশের গ্রামের খণ্ড চিত্র দেখল বিশ্ববাসী। সেটা ২০১৫ সালের কথা।
এরপর তুহিন তার নানার বাড়ি ইন্দা চুল্লি গ্রামে নিয়ে এলেন শন মাফতি নামে কানাডিয়ান এক পর্যটককে।
তখন বর্ষাকাল। হাওরপাড়ের গ্রামের এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় ছোট কোষা নৌকা দিয়ে ঘোরালেন তাকে। শন মাফতি দেখলেন কিভাবে হাওরের মানুষ উত্তাল ঢেউ থেকে নিজেদের গ্রাম রক্ষা করে।
রাতে গ্রামের স্কুলে বসল পালা গানের আসর। শন মাফতি বাংলার ঐতিহ্যবাহী গানে বিমোহিত হলেন।
শুধু শন মাফতি কিংবা পল বালডি নন, গত ১৩-১৪ বছরে এরকম হাজারো বিদেশী পর্যটক বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন জাফর তুহিন। তাদেরকে ঘুরে দেখিয়েছেন গ্রাম জনপদ। দেশের বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান। এসব পর্যটকের অনেকেই তাদের দেশে গিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন ব্লগে লিখেছেন, তৈরি করেছেন ইউটিউবে প্রামাণ্যচিত্র। বিদেশী পত্রিকায় বাংলাদেশের গ্রাম নিয়ে ছাপা হয়েছে ফিচার। সেই সুবাদে বাংলাদেশের অনেক গ্রাম বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে।
জাফর তুহিন স্নাতকোত্তর পাস করা ছেলে। বিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই সাইকেলে ঘুরে বেড়ানোর শখ ছিল তার। কলেজে ওঠার পর সুযোগ পেলেই বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতেন। ২০০৯ সালের কথা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করে ঢাকায় পিৎজা হাট নামে একটি রেস্তোরাঁয় ওয়েটারের চাকরি নেন জাফর তুহিন। সেখানে পল লেইনওয়ান্ড নামে এক বিদেশীর সাথে তার প্রথম পরিচয় হয়। লেইনওয়ান্ড মার্কিন নাগরিক। বাংলাদেশ ঘুরে দেখতে এসেছেন। বিদেশী মানুষটা সুন্দরবন ভ্রমণের ব্যাপারে তথ্য জানতে চান তুহিনের কাছে। জাফর তুহিন তথ্য দিয়ে সহায়তা করেন। ভ্রমণে তাকে সঙ্গও দেন।
এভাবে কলেজজীবনের ভ্রমণ নেশাটা তাকে নতুন করে পেয়ে বসে।
এরপর কিছু টাকা জমলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন। কখনো শ্রীমঙ্গলে যান, কোনো মাসে বান্দরবানের গহিন পাহাড়ে। কখনো একা, কখনো দলবেঁধে। বিদেশী পর্যটকরা এলে তাদেরকে গাইড করেন তিনি। তার ভ্রমণের শখ আরো বেড়ে গেল ‘নিশিদল’ গঠনের পর। এটা তুহিনের পরিচিত কয়েকজন ভ্রমণপিপাসুর দল, যারা ভিন্নভাবে জীবনকে দেখতে চান। তারা প্রতি মাসে রাতে ভ্রমণে বের হন। রাতে মানুষের জীবন দেখেন। প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটান। কিছু বিদেশী পর্যটকও নিশিদলে ভ্রমণসঙ্গী হন।
এর মধ্যে আমেরিকান পর্যটক লেইনওয়ান্ডের সাথে তার যোগাযোগ চলতে থাকে। তুহিনের ভ্রমণের আগ্রহ দেখে কাউচসার্ফিং প্ল্যাটফর্মের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন লেইনওয়ান্ড।
লেইন বলেন, ‘বিদেশে ঘুরতে গেলে এই সাইট তোমাকে কাজে দেবে। এটাতে কোনো খরচ নেই এবং স্থানীয় মানুষের সাথে মেশাও যায়।’
এই সাইটে নিবন্ধন করে জাফর তুহিন ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ ঘুরে আসেন।
এরপর কাউচসার্ফিংয়ের মাধ্যমে কয়েকজন বিদেশী নাগরিককে অতিথি হিসেবে পান তুহিন। রাজধানীর রামপুরা বনশ্রীর ভাড়া বাসায় তাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। তাদের কেউ কেউ ঢাকায় ঘুরতে চাইলে সহায়তা করেন তুহিন। এভাবে নিজের রুমটাকে এয়ারবিএনবির তালিকাভুক্ত করেন। দিন দিন অনেক পর্যটক আসতে থাকেন, বাড়তে থাকে পরিচিতি। যারা ঘুরে যান, তাদের মাধ্যমেই আরো অনেক মানুষকে পেয়ে যান তুহিন। নিজের ভ্রমণবিষয়ক ওয়েবসাইট ‘তাঁবু’ও তত দিনে চালু করেন। সেখান থেকেও পান যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপানসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটক। এভাবেই নিজের ভাড়া বাসাটাকে হোমস্টে’ বানিয়ে শুরু হয়েছিল তার ভ্রমণ ব্যবসা।
‘হোমস্টে’ হলো অর্থের বিনিময়ে নিজের বাড়িতে অতিথিসেবা। ধারণাটি অনেক পুরনো হলেও বাংলাদেশে নতুন।
জাফর তুহিন বলেন, ‘পর্যটকরা সাধারণত নতুন জায়গা, সংস্কৃতি, খাদ্য ও নতুন অভিজ্ঞতার জন্য পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরে বেড়ায়, এটাই পর্যটনের ধর্ম। এক পর্যায়ে আমার মনে হলো ঢাকায় ভাড়া বাসায় থেকে এ ব্যবসা করছি কেন, আমি তো আমার গ্রামে বসেই এই ব্যবসা করতে পারি। তা ছাড়া বিদেশীদের শুধু গ্রামগুলো দেখালে কেমন হয়, বাংলাদেশের গ্রামগুলো আমাদের সম্পদ, বৈচিত্র্যময়। সেই থেকে আমার ধারণা এলো গ্রাম পর্যটন নিয়ে কাজ করতে।’
২০২০ সালে জাফর তুহিন ঢাকা শহরের ভাড়া বাসা ছেড়ে দিলেন। চলে এলেন নিজ গ্রাম নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার একদুয়ারিয়ায়। নিজেদের দোতলা বাড়ির একটা অংশে পর্যটকদের থাকার উপযোগী করে সেখানেই চালু করেছেন ‘হোমস্টে’ সেবা। একদুয়ারিয়া থেকে ঢাকায় যেতে লাগে ঘণ্টা তিনেক। ব্যক্তিগত বাহনে আরো কম সময়ে পৌঁছা যায়। প্রতি সপ্তাহেই বিদেশী পর্যটক পান তুহিন। বাড়ি থেকে গিয়ে তাদের নিয়ে ঘোরেন। শুধু একদুয়ারিয়ায় থাকার জন্যও অনেকে আসেন। সবাই প্রায় বিদেশী। হোমস্টেতে জনপ্রতি এক রাত ৭০ ডলার বা ৭ হাজার টাকা নেন। এ মাসেই এক ইংরেজ দম্পতি তিন দিন থেকে গেছেন। আরো কিছু বুকিং আছে। ফাঁকা বাড়িটায় অতিথি এলে তার মা নাকি বেশি খুশি হন। গ্রামের মানুষও সাদরে গ্রহণ করেন।
গত জুনে জাফর তুহিনের আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন গেভিন ও সারা স্টভইনার নামে নিউজিল্যান্ডের এক দম্পতি। দুই সন্তান নিয়ে তারা আসেন। ঢাকায় দুই দিন কাটিয়ে চলে আসেন তুহিনের একদুয়ারিয়ায়। স্টাইনার পরিবার নরসিংদীর মনোহরদী উপজেলার একদুয়ারিয়ায় ছিলেন তিন দিন। এই সময় ঠেলা জাল দিয়ে ডোবায় মাছ ধরেছেন তারা। অনভ্যস্ত হাতে কাঁঠাল ভেঙে খেয়েছেন। আবার ফসলকাটা ফাঁকা মাঠে বিকেলে ফুটবল খেলে সন্ধ্যায় আড্ডা দিয়েছেন পাড়ার চা দোকানে। তারা গ্রামীণ জীবন শুধু উপভোগই করেননি, উচ্ছ্বাস নিয়ে ব্লগে লিখেছেনও। ‘অ্যাওয়ে উইথ দ্য স্টাইনারস’ ওয়েবসাইটে সারা যে ব্লগ লেখেন, বাংলাদেশের ভ্রমণবিষয়ক গ্রুপগুলোতে তা ব্যাপকভাবে শেয়ার হয়েছে। ফেসবুকে তাদের দিনযাপনের ছবিগুলোও ভাইরাল হয়েছে।
জাফর তুহিনের বাবা ছিলেন স্কুলশিক্ষক, মারা গেছেন। ছোট ভাই পরিবার নিয়ে মনোহরদী শহরে থাকে। বড় বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মাকে নিয়ে তুহিনও একসময় ঢাকায় থাকতেন। এখন জাফর তুহিন মাকে নিয়ে একদুয়ারিয়া গ্রামেই থাকছেন। একদুয়ারিয়াকে কেন্দ্র করে তার ভ্রমণ প্রতিষ্ঠান ‘তাঁবু ট্যুর’ এখন বেশ জনপ্রিয়। তাঁবু ট্যুরের প্যাকেজগুলো মূলত বিদেশী পর্যটকদের কথা ভেবে সাজানো হয়েছে। তবে দেশের কেউ গ্রামে ঘুরতে চাইলেও সে ব্যবস্থা আছে। বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় ভ্রমণবিষয়ক ওয়েবসাইট ট্রিপ অ্যাডভাইজার, অস্থায়ী আবাস সন্ধানের জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান এয়ারবিএনবিতে আছে তাঁবুর প্রোফাইল। এসব প্ল্যাটফর্ম থেকেও অনেক পর্যটক পান জাফর তুহিন। এর মধ্যে ট্রিপ অ্যাডভাইজারের ‘আউটডোর অ্যাকটিভিটিজ ইন ঢাকা সিটি’ শ্রেণীতে তুহিনের তাঁবু শীর্ষে অবস্থান করছে। যেখানে তাঁবুর মতো ৮৬টি প্রতিষ্ঠান সেবা দিয়ে থাকে। ঢাকা ও আশপাশে ঘুরে দেখানো ছাড়াও তার প্রতিষ্ঠানে কক্সবাজার, শ্রীমঙ্গল, সুন্দরবনে ভ্রমণের প্যাকেজ আছে। এগুলো ৫০ থেকে ৫০০ ডলারে শুরু হয়। সুযোগ-সুবিধা বাড়লে প্যাকেজের মূল্যও বাড়ে।
জাফর তুহিন বলছিলেন, ‘তাঁবু ট্যুরের মাধ্যমে আমি মূলত প্যাকেজগুলো দেই গ্রামে ঘোরার প্যাকেজ। বাংলাদেশের গ্রামগুলোকে আমি বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে চাই। এ প্রচেষ্টায় আমি কিছুটা সফল হয়েছি। বিদেশীরা আমাদের গ্রামগুলো দেখতে আসছে। আকৃষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ পরিবেশে।
দিন দিন বাড়ছে বিদেশী অতিথি। বেড়েছে আয়। চাকরি না করে এখন একদুয়ারিয়া গ্রামে বসে প্রতি মাসে আমার লাখ টাকা আয় হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement
বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান ট্রাম্পের বিচার নিয়ে বিভক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট চুয়েট শিক্ষার্থীদের আন্দোলন স্থগিত, ক্লাসে ফেরার সিদ্ধান্ত আমদানি ব্যয় কমাতে দক্ষিণাঞ্চলের সূর্যমুখী তেলের আবাদ পাকুন্দিয়ায় গানের আসরে মারামারি, কলেজছাত্র নিহত আবারো হার পাকিস্তানের, শেষ সিরিজ জয়ের স্বপ্ন পাটকেলঘাটায় অগ্নিকাণ্ডে ৩ দোকান পুড়ে ছাই ৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা শুরু দোয়ারাবাজারে পরকীয়া সন্দেহে স্ত্রীকে হত্যা : স্বামীর আমৃত্যু কারাদণ্ড গাজীপুরে ফ্ল্যাট থেকে স্বামী-স্ত্রীর লাশ উদ্ধার ভারতে দ্বিতীয় পর্বে ৮৮ আসনে ভোট

সকল