২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঢাবিতে বাস্তবায়ন হয়নি তদন্ত কমিটির অনেক সুপারিশ

সরকারপন্থীদের বাঁচাতেই প্রশাসনের দ্বিমুখী আচরণ
-

একই ধরনের অপরাধে কাউকে সাজা, কাউকে একেবারেই ছাড়। কারো চাকরিচ্যুতি, কেউবা আছেন বহাল তবিয়তে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনাও ধামাচাপা পড়ে যায় প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ইঙ্গিতে। সম্প্রতি এমন অভিযোগ উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে। একাধিক ঘটনায় গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও, তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবতার মুখ দেখেনি। অন্য দিকে ভিন্নমতের শিক্ষক হলেই তার যেন রেহাই নেই। অনুগতদের বাঁচাতে এমনই দ্বৈত আচরণ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের। এ নিয়ে খোদ প্রশাসনেও রয়েছে দ্বিধাবিভক্তি। কারো জন্য হাফ কারো জন্য মাফÑ এই নীতির বিরোধিতা করেছেন প্রশাসনের কেউ কেউ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে চরম নৈতিক স্খলন, এমফিল বা পিএইচডির থিসিস চৌর্যবৃত্তি এবং নানা কেলেঙ্কারি থাকলেও নেয়া হয় না শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিগত কয়েক বছরের প্রশাসনিক উদ্যোগ পর্যালোচনা করে এমনটিই পরিলক্ষিত হয়েছে। ২০১৮ সালের ২৬ মার্চ পত্রিকায় একটি নিবন্ধ লেখার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। কারণ তিনি বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক। তিনি ভিন্নমত পোষণ করেন। তাকে অব্যাহতির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৭৩-এর আদেশ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম স্ট্যাটিউটের বিধির অনুসরণ করা হয়নি বলে ভুক্তভোগী শিক্ষক ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ। এখন স্ত্রী আর একমাত্র মেয়ে সন্তানের জীবন নিয়ে শঙ্কিত এই অধ্যাপক।
২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ এমরান হুসাইনকে ‘ছাত্রীকে নিপীড়ন’র অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কারণ তিনিও বিএনপিপন্থী শিক্ষক। একইভাবে ঠুনকো অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলামকে ২০১৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর সাময়িক অব্যাহতি দেয়া হয়। কারণ তিনিও ভিন্নমত পোষণ করেন। তবে তাকে কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি। পরে তিনি জেনেছেন যে, তাকে বিভাগের ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অব্যাহতি দেয়া হয়। চাকরি ফিরে পেতে আদালতের শরণাপন্ন হন ড. সাইফুল ইসলাম। নানা ধাপ পেরিয়ে আদালত তার পক্ষে রায় দিলে তিনি ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর যোগদানপত্র জমা দেন। তিনটি চিঠি দিয়েছিলেন। সর্বশেষ চূড়ান্ত চিঠি দিয়েছিলেন ভিসিকে। কিন্তু তাকে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়নি। সাইফুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে দেয়নি। আদালতের আদেশ মোতাবেক আমার যোগদানে কোনো বাধা নেই। তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আদেশ ভঙ্গ করে ২০২০ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে জানান ড. সাইফুল ইসলাম।
এ দিকে নীল দল সমর্থিত কিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে চরমতম মোরাল টার্পিচিউড বা নৈতিক স্খলন এবং গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি, নম্বর জালিয়াতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি এসব ঘটনায় তদন্ত কমিটি সর্বোচ্চ শাস্তির সুপারিশ করলেও কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এহেন বিপরীতমুখী আচরণ নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীন দলেরই কিছু শিক্ষকের মতে, কেউ গুরুতর অপরাধ করলে তাকে শাস্তি পেতেই হবে। সব কিছুকে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সবসময় বিবেচনা করা উচিত নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে জাতির আশা-আকাক্সক্ষা ও গর্বের প্রতিষ্ঠান। এখানে ন্যায়বিচার হবে এটি সবারই প্রত্যাশা। সেই প্রত্যাশা খর্ব করার অধিকার কারো নেই। কেননা বিশ্ববিদ্যালয় চলে তার নিজস্ব আইনে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি অন্যতম আলোচনার বিষয় হয়ে উঠেছে গবেষণা জালিয়াতি করেও পার পেয়ে যাওয়া গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমান এবং অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান। এ ছাড়াও ওষুধপ্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবুল কালাম লুৎফুল কবীর, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবু নাসের মুহম্মদ সাইফ। এ ছাড়াও নৈতিক স্খলনের পরেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের রাখঢাকের কারণে পার পেয়ে গেছেন রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. জি এম গোলজার হোসেন। অন্য দিকে চরম নৈতিক স্খলনের পরেও বিভাগে ফেরানোর তোড়জোড় চলছে ঢাবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান ওরফে বাহালুলকে। জানা গেছে, ২০১২ সালের অক্টোবরে ঢাবির ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান ওরফে বাহালুলের বিরুদ্ধে বিভাগের একাধিক ছাত্রীর সাথে যৌন নিপীড়ন ও কুকর্মের অভিযোগ উঠলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে যথাক্রমে তিন মাস এবং ২০১৩ সালের ১ জুন থেকে এক বছরের জন্য বিভাগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এরপর ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে বিভাগের পাঁচজন শিক্ষকের সমন্বয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তদন্ত কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইবরাহিম (বর্তমানে পিএলআর)। সদস্যরা হলেনÑ ড. মো: আতাউর রহমান মিয়াজী, অধ্যাপক ড. আবদুল বাছির, এ কে এম খাদেমুল হক ও সুরাইয়া আখতার।
২০১৩ সালের ২৫ মার্চ বিভাগীয় তদন্ত কমিটি তিন পৃষ্ঠাসংবলিত বিস্তারিত প্রতিবেদন ও সুপারিশ জমা দেন। যেখানে বলা হয়েছেÑ ভুক্তভোগী ছাত্রী ও অভিযুক্ত শিক্ষক বাহালুলের অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ পর্যালোচনা করে তদন্ত কমিটি এ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, ‘বাহালুল শিক্ষকসুলভ গণ্ডি অতিক্রম করে ছাত্রীদের সাথে যে সম্পর্ক স্থাপন করেছে তা নৈতিক স্খলন ছাড়া কিছু নয়। অতএব নৈতিক স্খলনের অপরাধে মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বাহালুলের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অনুকূলে বিভাগীয় অ্যাকাডেমিক কমিটির বিবেচনার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে সুপারিশ করা হলো। সেই সাথে বিভাগীয় অভ্যন্তরীণ কর্মপরিবেশ ও শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে অ্যাকাডেমিক কমিটি তাৎক্ষণিক শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করতে পারে।’ অথচ তদন্ত কমিটির এই প্রতিবেদন ও সুপারিশের পরও বাহালুলের বিরুদ্ধে অদ্যাবধি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি; বরং গত জুলাই মাসে অ্যাকাডেমিক কমিটির সভায় কয়েকজন শিক্ষক বাহালুলকে বিভাগের কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করার দাবি তোলেন। এ নিয়ে বিভাগের কতিপয় শিক্ষক চরম ক্ষুব্ধ। তারা বাহালুলকে বিভাগে দেখতে চান না। কারণ তদন্ত কমিটি শাস্তির সুপারিশ করায় বিষয়টি একপ্রকার মীমাংসিত।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট স্ট্যাটিউটের ৪৫(৩)(৪) উপধারায় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ৭৩’র আদেশের ৫৬(৩) উপধারায় স্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া আছে। সেখানে বলা আছেÑ ‘নৈতিক স্খলন, অদক্ষতা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও চাকুরিবিধি পরিপন্থী’ কাজের সাথে যুক্ত থাকার অপরাধে কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে টার্মিনেট করা যেতে পারে। কিন্তু ড. মোর্শেদের নিবন্ধ লেখার বিষয়টি উল্লিখিত অপরাধের কোনোটিতেই পড়ে না। তার পরও কেবল ভিন্ন মতাবলম্বী হওয়ার কারণে ড. মোর্শেদকে বেআইনিভাবে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় বলে ঢাবি সাদা দলের অভিযোগ। অন্য দিকে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক বাহালুল নৈতিক স্খলন করেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল সুবিধা ভোগ করেছেন।
ইসলামের ইতিহাস বিভাগের জন্য গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. আবদুল বাছিরকে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো: মোশাররফ হোসাইন ভূঁইয়ার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যায়।
২০১৭ সালের তৃতীয় বর্ষ ষষ্ঠ সেমিস্টারে ঢাবির ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের দুই অধ্যাপকের তৈরি করা ফলাফলে অসঙ্গতির অভিযোগ এনে ফল পুনঃনিরীক্ষণের দাবি জানায় ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত শিক্ষকদ্বয় হলেনÑ ড. আবদুস সবুর খান ও ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন। এরপর ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি একটি তদন্ত কমিটি গঠিত ও পুনঃটেবুলেটর নিযুক্ত করা হয়। পুনঃনিরীক্ষিত ফলাফলে ১১ শিক্ষার্থীর চারটি কোর্সের সর্বমোট ৮০-এর বেশি স্থানে প্রাপ্ত নম্বরের কমবেশি করার প্রমাণ মেলে। সর্বশেষ গত ১৭ সেপ্টেম্বর তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিয়েছেন পুনঃটেবুলেটরদ্বয়। শুধু তা-ই নয়, মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের সেক্রেটারি থাকাকালে টাকার বিনিময়ে তিনজন কর্মচারী নিয়োগ দেন। সে বিষয়েও তদন্ত কমিটি অনিয়ম পেয়েছে। তা ছাড়া বাহাউদ্দিন অনিয়ম করে নীলক্ষেত হাই স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য হয়ে নানা অপকর্ম করায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন স্কুলের সিনিয়র শিক্ষক মো: হারুন অর রশিদ। সর্বশেষ তার বিরুদ্ধে পিএইচডি থিসিস জালিয়াতির অভিযোগ তদন্ত হচ্ছে। এত বড় অনিয়মের পরও শুধু সরকারদলীয় শিক্ষক হওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
জানতে চাইলে ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান মো: আবুল কালাম সরকার দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, পরীক্ষার ফলাফলে কিছু অসঙ্গতি ছিল। সেটি সংশোধন করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসন আছে। তারাই দেখবেন। এখনো বিষয়টি তদন্তাধীন।
অভিযোগের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে মন্তব্য জানতে মোবাইলে কল দিলে ভিসি অধ্যাপক ড. মো: আখতারুজ্জামান এবং প্রোভিসি (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ কল রিসিভ করেননি।
সার্বিক বিষয়ে প্রোভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল দৈনিক নয়া দিগন্তকে বলেন, এগুলো আসলে কাম্য নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে সবার জন্য একই নিয়ম হওয়া উচিত। নিয়ম কারো জন্য আছে, কারো জন্য নেই, কারো জন্য খণ্ডিত এগুলো হওয়া উচিত না। অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বর্তমানে শিক্ষকদের একটা অংশের মধ্যে নৈতিক স্খলনের বড় কারণ হলো মাস্টার্স হওয়ার পরেই শিক্ষক হিসেবে ঢুকে যায়। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আদর্শ এবং অনুশীলন এর সমন্বয় হয় না। এ কারণে এমন কর্মকাণ্ডের সাথে তারা জড়িত হয়ে পড়েন। এগুলো ধীরে ধীরে আমরা সংশোধন করার চেষ্টা করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদে এথিক্যাল কমিটি গঠন করার বিষয়ে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও গবেষণা জালিয়াতি বন্ধেও কমিটি করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


আরো সংবাদ



premium cement