০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


হালাল খাদ্যগ্রহণ ইবাদত

-

অতিরিক্ত খাদ্যগ্রহণ যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, এ ব্যাপারে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পূর্ণ একমত। অতিরিক্ত খাবার মানে অপচয়। অপচয় যে সম্পূর্ণ অনৈতিক বিষয়, সে ব্যাপারেও বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের দ্বিমত পোষণ করার সুযোগ নেই। খাদ্যের ব্যাপারে ইসলামের অন্যতম মূলনীতি হলোÑ পবিত্র ও হালাল খাদ্য গ্রহণ। ঈমানদারদের জন্য এ নির্দেশ মানা বাধ্যতামূলক। হালাল বস্তু গ্রহণ যেমন ইবাদত, হারাম খাদ্যগ্রহণ তেমনি কুফরি। বিশ্বাসীদের জন্য হারাম পরিহার ও হালাল খাদ্য গ্রহণ অত্যাবশ্যক। এ বিষয়টি যদিও সম্পূর্ণ ঈমানের সাথে সংশ্লিষ্ট, কিন্তু বাস্তবতা, যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকেও তা মানুষের জন্য কল্যাণকর। আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা এ সম্পর্কে নানা গবেষণা ও পর্যালোচনার পর এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন।
হালাল-হারাম মূলত নৈতিকতা সম্পর্কিত বিষয়। মানুষ নৈতিক জীব হিসেবে অন্য জন্তু-জানোয়ারের মতো যা খুশি তাই করতে পারে না, তার কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ একান্ত প্রত্যাশিত। পানাহারের ক্ষেত্রেও তা সমভাবে প্রযোজ্য। যারা হালাল-হারাম বিবেচনা করে না, তারাও সব ধরনের খাদ্যই যে গ্রহণ করে তা নয়। খাদ্যের ভালো-মন্দ, মান ইত্যাদি বিচার-বিবেচনা করেই সাধারণত মানুষ খাদ্যগ্রহণ করে।
যেকোনো নীতিবান ব্যক্তি খাবার গ্রহণের আগে অবশ্যই চিন্তা করবে, এ খাবার বৈধভাবে অর্জিত কি না, অথবা এর সাথে কোনো রকম অবৈধতা বা অপবিত্রতার সম্পর্ক ঘটেছে কি না। সর্বোপরি, এ প্রশ্নও সঙ্গতভাবে উঠতে পারে, বৈধ খাদ্যবস্তুও শরিয়তসম্মতভাবে হালাল করা হয়েছে কি না। যেমন-গরু, মহিষ, উট, ছাগল, ভেড়া, মুরগি ইত্যাদি হালাল জন্তু-জীবও যদি আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোনো নামে বা নিয়তে জবেহ করা হয়, তাহলে তা হালাল নয়। ঈমানদাররা তা ভক্ষণ করতে পারে না। কারণ সব প্রাণীর স্রষ্টা একমাত্র আল্লাহ। নির্বিচারে প্রাণী হত্যা পাপ। শুধু জীবনধারণের প্রয়োজনে আল্লাহর নামে কোনো হালাল পশু জবেহ করে তার গোশত খাওয়া হালাল। অনেক সময় অনেকে না জেনে, না বুঝে (তাও আবার সওয়াবের নিয়তে) পীর-আওলিয়া, দরবেশ বা মাজারের নামে পশু জবেহ করে থাকে। এটা সম্পূর্ণ হারাম। এর দ্বারা কাউকে আল্লাহর সমতুল্য বিবেচনা করা হয়, যা স্পষ্টত র্শিক। অতএব, এভাবে জবেহকৃত হালাল পশুর গোশতও হারাম।
জবেহ করার ক্ষেত্রেও শরিয়তের বিধান এই যে, প্রথমত আল্লাহর নামে জবেহ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, জবেহ করার স্থান পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে। নোংরা, অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর স্থানে জবেহ করা অসঙ্গত। তৃতীয়ত, জবেহ করার ছুরি ধারালো ও তীক্ষè হতে হবে, যাতে জবেহকৃত পশুর কষ্ট কম হয়। চতুর্থত, জবেহ করার সময় জবেহকৃত পশুর সাথে অমানবিক নিষ্ঠুর আচরণ করা যাবে না।
ভালো, পবিত্র ও হালাল খাদ্য সম্পর্কে ইসলামে সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।এ প্রসঙ্গে আল-কুরআনের কিছু আয়াত উল্লেখ করা যায়Ñ ‘তোমাদের জন্য চতুষ্পদ জন্তু (জবেহ করার ক্ষেত্রে) চিন্তা করার অবকাশ রয়েছে। আমি তোমাদেরকে পান করাই তাদের উদরস্থিত বস্তুসমূহের মধ্য থেকে গোবর ও রক্ত নিঃসৃত দুগ্ধ যা পানকারীদের জন্য উপাদেয়।’ (১৬ : ৬৬)
উপরিউক্ত আয়াতে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিত রয়েছে। যেকোনো হালাল জন্তু জবেহ করার ক্ষেত্রে চিন্তা করতে বলা হয়েছে। অর্থাৎ যেসব জন্তু-জানোয়ার দুধ দেয়, সেগুলো জবেহ করতে নিষেধ করা হয়েছে। কারণ দুধ মানুষের অতি উপাদেয় পানীয় বস্তু। তা ছাড়া, জন্তু-জানোয়ারের বাচ্চাদের জীবনধারণের জন্য এ দুধ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই দুগ্ধদানকারী জন্তু-জানোয়ার জবেহ্ করতে নিষেধ করা হয়েছে। আল্লাহ্ আরো বলেনÑ ‘অতঃপর যে জন্তুর উপর আল্লাহর নাম উচ্চারিত হয়, তা থেকে ভক্ষণ করো যদি তোমরা তার বিধানগুলো বিশ্বাসী হও।’ (৬:১১৮)
উপরিউক্ত আয়াতের অর্থ অতি স্পষ্ট। এর আগে এর ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। এরপর আল্লাহ্ বলেনÑ ‘তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত জীব, রক্ত, শূকরের মাংস, যেসব জন্তু আল্লাহ ছাড়া অন্যের নামে উৎসর্গকৃত হয়, যা কণ্ঠরোধে মারা যায়, যা আঘাত লেগে মারা যায়, যা উচ্চ স্থান থেকে পতনের ফলে মারা যায়, যা শিং-এর আঘাতে মারা যায় এবং যাকে হিংস্র জন্তু ভক্ষণ করেছে, কিন্তু যাকে তোমরা জবেহ করেছ। যে জন্তু যজ্ঞবেদিতে জবেহ করা হয় এবং যা ভাগ্য-নির্ধারক শর দ্বারা বণ্টন করা হয়। এসব গোনাহর কাজ। আজ কাফেররা তোমাদের দ্বীন থেকে নিরাশ হয়ে গেছে। অতএব তাদেরকে ভয় করো না বরং আমাকে ভয় করো। আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অনুগ্রহ সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে মনোনীত করলাম। অতএব, যে ব্যক্তি তীব্র ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়ে; কিন্তু কোনো গোনাহর প্রতি প্রবণতা না থাকে, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল।’ (৫:৩)
অতঃপর আল্লাহ বলেন, তোমাদের জন্য সমুদ্রের শিকার ও সমুদ্রের খাদ্য হালাল করা হয়েছে তোমাদের উপকারার্থে এবং তোমাদের এহরামকারীদের জন্য হারাম করা হয়েছে স্থল শিকার যতক্ষণ এহরাম অবস্থায় থাকো। আল্লাহকে ভয় করো, যার কাছে তোমরা একত্র হবে। (৫ : ৯৬)
মহান আল্লাহ্ আরো বলেনÑ ‘তারা তোমাকে মদ ও জুয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে। বলে দাও, এতদুভয়ের মধ্যে রয়েছে মহাপাপ। আর মানুষের জন্য উপকারিতাও রয়েছে, তবে এগুলোর পাপ উপকারিতা অপেক্ষা অনেক বড়। আর তোমার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী তারা ব্যয় করবে? বলে দাও, নিজেদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ের পর যা বাঁচে তাই খরচ করবে। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নির্দেশ স্স্পুষ্টরূপে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা করতে পারো।’ (২:২১৯)
সুষম খাদ্যগ্রহণে ইসলামের নির্দেশ : জীবনধারণের জন্য পানাহার অপরিহার্য। তবে ইসলাম মানসম্মত রুচিকর, স্বাস্থ্যসম্মত, উত্তম ও হালাল খাদ্য খাওয়ার নির্দেশ দেয়। অপরিমেয়, প্রয়োজনাতিরিক্ত খাবার খেতে নিষেধ করে। এ প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ সা:-এর একটি মশহুর হাদিসের উদ্ধৃতি দিচ্ছি। রাসূল সা: বলেন, ‘পূর্ণরূপে উদর পূর্তি করার মতো ক্ষতিকর আর কিছু নেই। মেরুদণ্ড সোজা রাখার জন্য মাত্র কয়েক লোক্মা খাদ্য গ্রহণই যথেষ্ট। তবে সে যদি এর চেয়ে অধিক খাদ্যগ্রহণ করতে চায়, তাহলে সে তার পেটের একভাগ খাদ্য, একভাগ পানীয় এবং অন্য ভাগ বাতাসে পূর্ণ অর্থাৎ খালি রাখতে পারে।’ (মসনদে আহমদ, তিরমিজি, নাসাঈ, ইবনে মাজাহ্)।
রাসূলুল্লাহ্ সা: সব ক্ষেত্রে আল-কুরআনের নির্দেশনানুযায়ী জীবনযাপন করতেন। তাঁর আচার-আচরণ, কথাবার্তা তথা সামগ্রিক জীবনযাপন পদ্ধতি সম্পূর্ণ আল-কুরআনের নির্দেশ মতো পরিচালিত হতো। তিনি ছিলেন মানবজাতির শিক্ষক ও সর্বোত্তম অনুসরণীয় আদর্শ। তাঁর জীবনাদর্শ অনুসরণ করা মানবজাতির জন্য নিঃসন্দেহে কল্যাণকর। সাহাবারা সর্বক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনাদর্শ অনুসরণ করার ক্ষেত্রে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। তাই তাঁদের জীবনযাপন পদ্ধতিও ছিল উন্নত ও আদর্শস্থানীয়। পানাহারের ক্ষেত্রেও সাহাবারা সর্বদা নিষ্ঠার সাথে রাসূলুল্লাহ সা:কে অনুসরণ করতেন। প্রসঙ্গত, এখানে উদ্ধৃত দু’জন সাহাবির মন্তব্য থেকে তা স্পষ্ট উপলব্ধি করা যায়। প্রথমে ইমাম শা’ফিঈর বর্ণনা উল্লেখ করছি। তিনি বলেন : ‘ষোল বছর পর্যন্ত আমি কখনো পেট পুরে খাইনি। পেট ভরে খেলে শরীরের ওজন অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়, চিন্তা-শক্তি হ্রাস পায়, অধিক নিদ্রা পায় এবং ইবাদতে আলস্য বা অনীহা সৃষ্টি হয়। আবু জুহাইফা রা: বলেন, ‘গত তিরিশ বছরে আমি একবারও পেট ভরে খাইনি।’
এভাবে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহর সাথে জীবনাদর্শ সাহাবাগণ যেভাবে অনুসরণ করতেন, পানাহারের ক্ষেত্রেও তাঁকে সেভাবে অনুসরণ করেছেন। ফলে ওই সময় মুসলমানরা জ্ঞান-বিজ্ঞান, আমল-আখলাক, মহত্ত্ব-উদারতা, শৌর্য-বীর্য-পরাকাষ্ঠায় অন্যদের তুলনায় অধিক পারদর্শী ও দক্ষ ছিলেন। এ কারণেই বিশ্ব জয় এবং সমকালীন বিশ্বে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উভয় ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল। স্বাস্থ্যসম্মত, সুষম খাবার স্বল্প পরিমাণে গ্রহণ করায় রাসূল সা: ও খলিফাদের যুগে আরব দেশে রোগ-ব্যাধির প্রকোপ ছিল না বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়।
মিসরের জনৈক চিকিৎসক রাসূলুল্লাহ সা: ও সাহাবাদের চিকিৎসার জন্য মদিনা শরিফে তসরিফ আনেন। তিনি রাসূলুল্লাহ সা:কে তাঁর মনোবাঞ্ছার কথা জানিয়ে দুই বছর মদিনায় থাকার অনুমতি চান। রাসূলুল্লাহ সা: যথারীতি তাকে সেখানে থাকার অনুমতি দেন। কিন্তু দীর্ঘ দুই বছর মদিনা শরিফে অবস্থান করা সত্ত্বেও কোনো রোগী তার কাছে চিকিৎসার জন্য আসেনি। তিনি অবাক হয়ে রাসূলুল্লাহ সা:কে বলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সা: আমি দুই বছর যাবৎ এখানে অবস্থান করছি। কিন্তু এ সময় আমার কাছে কেউ কখনো চিকিৎসা সেবা নিতে আসেননি। জবাবে রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, আমরা পরিমিত খাদ্য গ্রহণ করি, তাই আমরা সাধারণত রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হই না। এ কথা শুনে চিকিৎসক অত্যন্ত বিস্মিত হলেন এবং তার দেশে ফিরে গেলেন। এভাবে ইসলামের বিধান অনুযায়ী পানাহার করলে আমরাও রোগব্যাধি থেকে বহুলাংশে মুক্ত থাকতে পারি। এতে শরীর স্বাভাবিক থাকে, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায় এবং সর্বোপরি, চিকিৎসাব্যয় সাশ্রয় হয়।
লেখক: শিক্ষাবিদ


আরো সংবাদ



premium cement
রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় সহযোগিতার জন্য ওআইসি সদস্যদের প্রতি আহ্বান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাফা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরিয়ে নেয়ার আদেশে হামাসের প্রতিক্রিয়া হিলি বন্দর দিয়ে ১৪ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর ওপর : মন্ত্রী রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলায় ওআইসি’র সহযোগিতা চেয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী টর্চার সেলে শিশু-বৃদ্ধদের পেটাতেন মিল্টন : হারুন গাজা ত্যাগ করবে না ইউএনআরডব্লিউএ শৈলকুপায় সাংবাদিক মফিজুলের ওপর হামলা : প্রেসক্লাবের উদ্যোগে মানববন্ধন বিএনপির ভাবনায় ক্লান্ত ওবায়দুল কাদের : রিজভী অনলাইন জুয়ায় ২০ লাখ টাকা হেরে যুবকের আত্মহত্যা আল-জাজিরার অফিসে ইসরাইলি পুলিশের হানা

সকল