মনে করুন আপনার জ্বর হলো। এখন কী করবেন?
- এটি নরমাল, সিজনাল- এ কথা চিন্তা করা বন্ধ।
- দেখি এক-দু’দিন- দেখাদেখি বন্ধ।
- আমার তো সর্দি-কাশি আছে, তাহলে এটি ডেঙ্গু না- ভাবা বন্ধ করুন।
কারণ?
ডেঙ্গুজ্বরের প্যাটার্ন পাল্টেছে। একসময় চিকিৎসকরা সর্দি-কাশি থাকলে আর ডেঙ্গু ভাবত না। এখন আর সেটি নেই। গুরুত্বপূর্ণ কথা হচ্ছে- একটি আউটব্রেকের সময় যেকোনো ফিভারে শুরুতেই ভাবতে হবে আমি আউটব্রেকের কবলে পড়েছি। এটিই হচ্ছে নির্দেশিত। একটা সময় রথ্যাশ হতো, এখন রথ্যাশ দেখাই যায় না খুব একটা। এ বছর জ্বরের তীব্রতাতেও পরিবর্তন এসেছে, অনেকেরই ১০০-১০১ এ ডেঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। প্রচণ্ড শরীর ব্যথার কারণে এটিকে ব্রেক বোন ফিভার বলত আগে, এ বছর সেই প্যাটার্নেও পরিবর্তন এসেছে, আগে পাঁচ-ছয় দিনের দিন রোগীর কন্ডিশন খারাপ হতো, এখন তিন দিনের মাথাতেই ইভেন জ্বরের এক-দু’দিনেও কেউ কেউ ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে চলে যাচ্ছে।
ডেঙ্গুর ক্লাসিক্যাল সিম্পটম
তীব্র জ্বর, প্রচণ্ড শরীর ব্যথা, বিশেষ করে কোমর ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা, মাথাব্যথা। তবে বর্তমান ডেঙ্গুতে এমনটি নাও থাকতে পারে।
করণীয়-১
প্রথম দিনেই হাসপাতালে গিয়ে তিনটি টেস্ট করে ফেলা।
১. CBC
২. Dengue NS1
৩. SGOT
করার পর কী করবেন? কারণ NS1 positive means আপনার ডেঙ্গু নিশ্চিত। কিন্তু ধরুন কোনো কারণে আপনার রিপোর্ট সব নরমাল এলো। প্রথম দিনে এটি হতেই পারে। তবে সব নরমাল আসার সম্ভাবনা কম।
প্রথমেই সিবিসি রিপোর্টের HCT/PCV নামে একটি টার্ম আছে, হেমাটোক্রিট বা প্যাকড সেল ভলিউম, এটি কত পারসেন্ট আছে মার্ক করে ফেলবেন বা লিখে ফেলবেন। কারণ এটিই আপনাকে পরবর্তীতে অনেক কিছু গাইড করবে। ধরুন আপনার এলো ৩৬ শতাংশ, আপনার হিমোগ্লোবিন ১২ শতাংশ, তাহলে নরমাল এবং প্রথম দিন এটি নরমাল আসবে। আর নরমাল রেঞ্জ আপনার কত সেটি জানা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ আমাদের দেশে ডেমোগ্রাফিক্যালি হেমাটোক্রিট ক্লাসিফাই করা নেই। তাই নিজের বেজ লাইন জেনে রাখবেন। হেমাটোক্রিট আপনার হিমোগ্লোবিনের তিন গুণ সাধারণ অবস্থায়।
যদি দেখেন আপনার SGOT সাধারণ মাত্রার চেয়ে এক-দুই গুণ বেশি, তাহলে ওকে, এটিকে সাধারণ অবস্থা ভেবে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু যদি SGOT চার-পাঁচগুণ হয়ে যায়, তবে এই রোগী সামনের দিকে খারাপ হওয়ার চান্স অনেক বেশি। তাই সতর্ক হয়ে যেতে হবে আগেই।
করণীয়-২ : প্রথম দিনেই ডাক্তার দেখাবেন। প্যারাসিটামল ছাড়া কোনো ব্যথার মেডিসিন খেয়েছেন তো বিপদ আছে। এরপর ডাক্তারের পরামর্শ শুনবেন ও মেনে চলবেন।
করণীয়-৩ : প্রতিদিন সিবিসি টেস্ট করতেই হবে মাস্ট। সিবিসি করে কী চেক করবেন? প্লাটিলেট? না। HCT বা হেমাটোক্রিট। বিলিভ মি, যত প্যাশেন্ট মারা যাচ্ছেন, সব ডেঙ্গু শক সিন্ড্রমে, কেউ প্লাটিলেট বা ব্লিডিং হয়ে মারা যাচ্ছেন না। হেমোরেজিক ডেঙ্গুর চেয়ে এখন আমাদের দেশে ডেঙ্গু শক হচ্ছে বেশি। আর এই হেমাটোক্রিট আপনাকে ইন্ডিকেশন দেবে এই শক সম্পর্কে। সিবিসি থেকে আপনি কিভাবে কী বুঝবেন এবং দ্রুত হাসপাতালে যাবেন?
যদি দেখেন আপনার HCT/PCV প্রথম দিনের নরমাল রেঞ্জের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে, ধরুন ছিল ৩৫ শতাংশ, এখন ৪০-৪৫ শতাংশ, তাহলে আপনার প্লাজমা লিকেজ হচ্ছে, শক। যদি দেখেন হিমোগ্লোবিন ও HCT দুটোই প্রথম দিনের চেয়ে অনেক কমে গেছে, তবে আপনার শরীরে কোথাও ব্লিডিং হচ্ছে, সাথে কালো পায়খানা, লাল প্রশ্রাব, দাঁতের মাড়ি থেকে, নাক থেকে রক্ত পড়ছে। দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হবেন। এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না। আর কী কী বোঝা যাবে সিবিসি থেকে? যদি আপনার WBC count বা হোয়াইট ব্লাড কাউন্ট পাঁচ হাজারের নিচে নেমে যায়, লিউকোপিনিয়া এবং মনে রাখবেন, WBC count না কমার আগে আপনার প্লাটিলেট কমবে না। WBC count কমার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনার প্লাটিলেট কাউন্ট কমতে শুরু করবে। প্লাটিলেট কাউন্ট যখন এক লাখের নিচে নেমে যাবে, তার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আপনার প্লাজমা লিকেজ শুরু হবে এবং আপনি শকের দিকে ধাবিত হবেন। তা হলে সিবিসি কতটা গুরুত্বপূর্ণ আশা করি বুঝতে পেরেছেন। মনে রাখবেন, প্রতিদিন সিবিসি করতে হবে। প্লাটিলেট কমে গেলে মরবেন না, তাই প্লাটিলেট নিয়ে হাহুতাশ করবেন না। প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে না নামলে অন্য কোনো প্রবলেম না থাকলে ব্লিডিং হয় না, কারোর ১০ হাজারেও কিছু হয় না। এটি আমাদের দেশে একটি অকারণ আতঙ্ক। পেঁপে পাতাও খাওয়া লাগবে না, প্লাটিলেট যখন বাড়বে, এক দিনেই কয়েক লাখ বেড়ে যাবে।
ক্রিটিক্যাল ফেজ
মনে রাখবেন, জ্বর থাকা অবস্থায় ডেঙ্গু রোগী মারা যায় না; বরং বিপদ শুরু হয় মূলত জ্বর কমার পর এবং সাধারণত আগে পাঁচ-ছয় দিনের মাথায় ক্রিটিক্যাল ফেজ শুরু হতো, কিন্তু এখন তিন দিনের শুরুতেই রোগীরা শকে চলে যাচ্ছে। ইভেন অনেকে জ্বর থাকা অবস্থাতেই ক্রিটিক্যাল হয়ে যাচ্ছে। তাই ফিভার কমে গেলে আরো সতর্ক হতে হবে। এই ফেজে আপনার প্লাটিলেট দ্রুত কমে যাবে। কিন্তু আগেই বলেছি, আপনাকে দেখতে হবে হেমাটোক্রিট। এই ফেজে আর কী কী করলে বুঝতে পারবেন আপনার রোগী খারাপ হচ্ছে কি না? ব্লাড প্রেশার মাপবেন। দিনে চার-পাঁচবার মিনিমাম; বরং প্রথম দিন থেকেই মাপবেন। এ ক্ষেত্রে ধরেন অনেকেরই আগে থেকে বিশেষ করে মেয়েদের ব্লাড প্রেসার লো থাকে, সো মাপার সময় আগে কত থাকত জেনে নেবেন। বাসায় একটি ব্লাড প্রেসার মেশিন রাখবেন, ডিজিটাল মেশিন হলে পরপর দু’বার মাপবেন, আর ম্যানুয়াল হলে একবার মাপবেন। এতে কি বোঝা যাবে? যদি ব্লাড প্রেসার সিস্টোলিক আইমিন উপরেরটা ১০০-এর নিচে নেমে যায় এবং ডায়স্টলিক মানে নিচেরটা ৬০-এর নিচে নেমে যায়, তবে অ্যালার্ট হয়ে যান। কিন্তু ধরেন উপরের প্রেসার ১০০-১১০ আর নিচেরটা ৯০। আপনি ভাবলেন নরমাল। বা ৯০ বাই ৭০ বা ১২০ বাই ১০০। না, এটি নরমাল না। দুটোর বিয়োগফল কত আসে? অনেক কাছাকাছি না? এটিকে বলে ন্যারো পালস প্রেসার এবং এই পালস প্রেসার যদি ২০-এর কম হয়, অর্থাৎ দুটোর পার্থক্য যদি ২০-এর কম হয়, ইউ আর ইন শক। আপনি শকে যাচ্ছেন। দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে।
এই ক্রিটিক্যাল ফেজে আর কী কী বিষয় গুরুত্বপূর্ণ?
তীব্র পেটে ব্যথা হচ্ছে কি না? এটি শকের লক্ষণ।
লো প্রেসারের সাথে আপনার রোগীর হাত ও পা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে কি না, এটি শকের লক্ষণ।
আপনার রোগী অস্থিরতা দেখাচ্ছে কি না, একদম নেতিয়ে দুর্বল ফ্যাকাশে হয়ে গেলো কি না, বিপদ চিহ্ন।
খুব ভালো করে প্রস্রাবের দিকে খেয়াল করবেন। কয়বার প্রস্রাব করছে, কতটুকু প্রস্রাব হচ্ছে প্রতিবার। যদি প্রস্রাব কমে যায়, অল্প প্রস্রাব হয়, হাসপাতালে সোজা ভর্তি হয়ে যাবেন।
রোগীর কি শ্বাসকষ্ট হচ্ছে? পেট ফুলে যাচ্ছে? হঠাৎ করে গা ঝাঁকুনি দিয়ে খিঁচুনি হচ্ছে? দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যান।
আর কী করতে পারেন? হাতের আঙুলের নখে জোরে চাপ দিয়ে ধরুন কিছুক্ষণ, নখ সাদা হয়ে গেলে এবার ছাড়ুন, এবার ভালোভাবে খেয়াল করুন নখের রঙ ফিরে আসতে কত সময় লাগছে, যদি বেশি সময় লাগে, বেশি বলতে কত? দুই সেকেন্ডের বেশি লাগলে আপনার রোগী শকে আছে। এটিকে বলে ক্যাপিলারি রিফিল টাইম।
আর কী করতে পারেন?
ব্লাড প্রেসার মেশিন নিন, এবার হাতের কব্জির মধ্যে রেখে যেভাবে ব্লাড প্রেসার মাপবেন সেভাবে বাতাস দিয়ে টাইট করুন, টাইট অবস্থায় ৪-৫ মিনিট দিয়ে রাখুন, এবার বাতাস ছাড়ুন এবং খেয়াল করুন বাহুতে লাল লাল কতগুলো দাগ পড়েছে ছোট ছোট, ছোট্ট একটি বক্স কল্পনা করে যদি মনে হয় অনেক বেশি লাল লাল স্পট, দ্রুত হাসপাতালে চলে যান। এটিকে বলে টর্নিকেট টেস্ট। সব রিপোর্ট নরমাল এলেও যদি আপনার টর্নিকেট টেস্ট পজিটিভ আসে, নিশ্চিত থাকুন আপনার ডেঙ্গু। এটি একদম প্রথম দিন থেকে প্রতিদিন করবেন।
বমি ও পাতলা পায়খানা
দিনে তিন বারের বেশি বমি করলে, তিন বারের বেশি পাতলা পায়খানা হলে সোজা হাসপাতালে চলে যাবেন। এক মুহূর্ত দেরি করা যাবে না।
বাসায় কী করবেন?
প্রচুর তরল খাওয়াবেন। দুই-তিন লিটার, ডাবের পানি, আধা লিটার পানিতে গোলানো স্যালাইনের পানি, স্যুপ, শরবত লবণ চিনি দেয়া খাওয়াবেন। যতক্ষণ মুখে খেতে পারবে খাওয়াবেন, যখন আর পারবে না, বমি হবে অনেক, পাতলা পায়খানা, হাসপাতালে নিয়ে যাবেন।
শিশুদের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকবেন। বেশির ভাগ রোগী মারা যায় শুরুতেই ডাক্তারের পরামর্শ না নেয়াতে, বিপদ চিহ্ন না জানাতে, বাসায় থেকে রোগী খারাপ করে ফেলে।
ডায়াবেটিস, হার্ট ডিজিজ, স্ট্রোক, কিডনি, লিভার, ক্যান্সার, SLE প্যাশেন্ট হলে প্রথম দিনই হাসপাতালে ভর্তি করে দেবেন।
আপনার বাড়ির কাছের হাসপাতালে আগে যাবেন। সব সরকারি হাসপাতালের ম্যানেজমেন্ট ভালো, বারান্দায় শুয়ে থাকলেও, কারণ সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ন্যাশনাল গাউডলাইন মেনে চিকিৎসা দেয়া হয়।
বাসায় পালস অক্সিমিটার থাকলে অক্সিজেন স্যাচুরেশন চেক করবেন। কোনো কোনো রোগীর ক্ষেত্রে হার্ট ইনভলভ হয়ে যাবে, দেরি করলে অর্গান ফেইলিউর হয়ে যায়। ভাইরাল মায়োকার্ডাইটিস কিংবা একিউট কিডনি ইনজুরির রোগীর জন্য আইসিউ লাগবেই। এসব রোগী বাইরে ম্যানেজ করা যায় না। রোগী খারাপ দেখলে সব প্রস্তুতি রাখুন। যেকোনো ইসিজি চেঞ্জেস, বিশেষ করে ট্যাকিকার্ডিয়া, শ্বাস দ্রুত হওয়া মানে ট্যাকিপেনিয়া বিপদ চিহ্ন। খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারো কারো ক্ষেত্রে প্লুরাল ইফিউশন অর্থাৎ লাংসে পানি চলে আসতে পারে।
মনে রাখবেন, প্রতিদিন সিবিসি টেস্ট, ডাক্তারের পরামর্শ, হাসপাতালে ভর্তির প্রস্তুতি, প্রচুর তরল খাওয়ানো, ব্লাড প্রেসার মাপা, বিপদ চিহ্ন খেয়াল করা, দেরি না করে হাসপাতালে নেয়া, জ্বর কমে গেলে আরো সতর্ক হওয়া, প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো মেডিসিন ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া না খাওয়ানো। ডেঙ্গু এখন আর শুধু ঢাকায় সীমাবদ্ধ না, সারা দেশে ছড়িয়েছে। দিনে রাতে যেকোনো সময় ডেঙ্গু মশা কামড়ায়। পরিষ্কার নোঙরা সব পানিতেই ডেঙ্গু হচ্ছে।
Dengue NS1 test জ্বর শুরু হওয়ার তিন দিন পর করলে লাভ নেই। সে ক্ষেত্রে CBC, SGOT, Dengue Antibodz (IgG+IgM) করতে হবে।
যারা রক্ত তরল করার মেডিসিন খান, ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে সেটি বন্ধ রাখবেন কিংবা খাবেন। কোনো অবস্থাতেই নিজে নিজে বন্ধ বা খাওয়া যাবে না।
সবাই সবার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহর কাছে বেশি বেশি সুরক্ষা চাইবেন। চারপাশ পরিষ্কার রাখবেন। সতর্ক থাকবেন।
তথ্যসূত্র : Dengue National Guideline, CDC
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা