০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ইস্পাহানে ইসরাইলি হামলার খবর ইরানের অস্বীকার

-


ইরানের মধ্যাঞ্চলীয় ইস্পাহান প্রদেশ গতকাল শুক্রবার একাধিক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমগুলোকে মার্কিন বলেছেন, ইসরাইল ইরানে প্রতিশোধমূলক হামলা চালিয়েছে। তবে বিদেশ থেকে ইরানে কোনো 'হামলা' হয়নি বলে খবর দিয়েছে ইরানি গণমাধ্যম। এ অবস্থায় তেহরান ওই বিস্ফোরণের ঘটনার পাল্টা জবাব দেবে না বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ইরানের এমন অবস্থানের পর আঞ্চলিক যুদ্ধের শঙ্কা অনেকটা কেটে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষ করা। এএফপি, বিবিসি ও রয়টার্স।

১ এপ্রিল সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হয়। এই হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর বিদেশে কার্যক্রম পরিচালনাকারী কুলস ফোর্সের জ্যেষ্ঠ কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ রেজা জাহেদিসহ কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। এই হামলার জন্য ইসরাইলকে দায়ী করে। ঘটনার পর ইরান এক সপ্তাহের কম সময় শনিবার রাতে ইসরাইলে প্রথমবারের মতো সরাসরি হামল্য চালায়। তারা ৩০০টির বেশি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল। ইরানের অভ্যন্তরে ইসরাইলের চালানো এই 'হামলা' সম্পর্কে সর্বশেষ যা জানা গেল, তার আদ্যোপান্ত তুলে ধরেছে এএফপি। খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার ইরানের বার্তা সংস্থা ফারসের খবরে বলা হয়, দেশটির ইস্পাহান প্রদেশের উত্তর-পশ্চিমের শেকারি সেনা বিমানঘাঁটির কাছে তিনটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। ইরানের মহাকাশ সংস্থার মুখপাত্র হোসেইন দালিরিয়ান বলেছেন, বেশ কয়েকটি ড্রোন গুলি করে ভূপাতিত করা হয়েছে। ইরানে কোনো ক্ষেপনাস্ত্র হামলা হয়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক যুক্তরাষ্ট্রের এক কর্মকর্তা মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেছেন, ইরানের অভ্যন্তরে ইসরাইলের হামলার লক্ষ্যবস্তু পারমাণবিক স্থাপনা ছিল না। ইরানের বার্তা সংস্থা তাসনিম বলেছে, ইস্পাহান প্রদেশে অবস্থিত পারমাণবিক স্থাপনা সম্পূর্ণ নিরাপদ আছে।

ওয়াকিবহাল একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা তাসনিমের খবরে বিদেশ থেকে ইরানে কোনো হামলা হওয়ার কথা অস্বীকার করা হয়েছে। স্থানীয় একটি অধিকার গোষ্ঠীর তথ্যমতে, সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলেও বিস্ফোরণের খবর
পাওয়া গেছে। গতকাল ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, আজ (শুক্রবার) দেশটির বেশ কয়েকটি শহরে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়। ইরানের আধা সরকারি মেহর নিউজ এজেন্সির খবর অনুসারে, ইস্পাহান, সিরাজ, তেহরানসহ দেশটির বিভিন্ন শহরে উড়োজাহাজ চলাচল স্থগিত করেছিল কর্তৃপক্ষ। ফাইট-ট্রট্র্যাকিং সফটওয়্যার দেখা যায়, বাণিজ্যিক ফ্লাইটগুলো ইস্পাহানসহ ইরানের বিভিন্ন এলাকা এড়িয়ে চলছে। ফ্লাইদুবাইয়ের একটি উড়োজাহাজ ইরানের রাজধানী তেহরানের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল। কিন্তু তেহরান বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়ায় উড়োজাহাজটি পরে দুবাইয়ে ফিরে আসে। সকালে ইরানি টেলিভিশন ইস্পাহানের একটি গোলচত্বর এলাকার 'সরাসরি চিত্র' সম্প্রচার করে। এতে সড়কে স্বাভাবিক যান চলাচল দেখা যায়। ইরানের সরকারি আইআরএনএ সংবাদ সংস্থার খবরে বলা হয়েছে, ইস্পাহানে একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনায় কোনো বড় ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। ইরান-সিরিয়ায় বিস্ফোরণ ও হামলার খবরের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে ইসরাইলের সামরিক বাহিনী বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেছে, এ ব্যাপারে এই মুহূর্তে তাদের দিক থেকে কিছু বলার নেই।

ঘটনার বিষয়ে হোয়াইট হাউস বা পেন্টাগনের কাছ থেকেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকটি মার্কিন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ইসরাইলের এই হামলার বিষয়ে আগাম নোটিশ পেয়েছিল ওয়াশিংটন। তবে ইসরাইলের এই হামলাকে সমর্থন করেনি যুক্তরাষ্ট্র। কিংবা হামলা বাস্তবায়নে কোনো ভূমিকাও রাখেনি। এক সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেন, বৃহস্পতিবার ইসরাইল যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছিল তারা কয়েক দিনের মধ্যে ইরানে প্রতিশোধমূলক হামলা চালাবে। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, 'আমরা এ হামলাকে সমর্থন জানাইনি।' ইরানে ইসরাইলি হামলার ব্যাপারে হোয়াইট হাউস তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করেনি। এএফপির এক প্রশ্নের জবাবে পেন্টাগন কর্তৃপক্ষ বলেছে, 'এ মুহূর্তে আমাদের কিছু বলার নেই।' ইরানের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচারমাধ্যমের খবরে বলা হয়, মধ্যাঞ্চলীয় শহর ইস্পাহানে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। এরপর ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, দেশটির কয়েকটি শহরে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করা হয়েছে।

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্ক। ইসরাইল-ইরান হামলা-পাল্টা হামলাকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরণ হওয়ার সমূহ আশঙ্কাকে মাথায় রেখেই বিশ্বনেতারা, জাতিসঙ্গ্য সতর্ক করেছে ইসরাইলকে। কিন্তু উগ্র ইসরাইল যদি কারো কথায় কান না দিয়ে হামলা চালিয়ে থাকে, তাহলে এখন আতঙ্কের বিষয়, ইরান এর কী জবাব দেয় বা কিভাবে দেয় সেটা। এরই মধ্যে হামলার খবর প্রচার হওয়ার সাথে সাথে বিশ্ববাজারে তেল ও স্বর্ণের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
পতন হয়েছে শেয়ারের মূল্য। সবাই সতর্ক ও আতঙ্কিত। কেউ বিনিয়োগ করতে চাইছেন না। কারণ, ইসরাইল ও ইরান শুধু দুটি দেশই নয়। তাদের মিত্ররাও বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক মেরুকরণ করা। ইসরাইল-ইরান পাল্টাপাল্টি হামলা হলে তাতে জড়িয়ে যাবে এই বিপরীত মেরুর রাজনৈতিক পক্ষ। ফলে পরিস্থিতিকে ভঙ্গুর ও উত্তেজনাকর বলে বর্ণনা করছেন আলজাজিরার সাংবাদিক ডোরসা জব্বারি। তিনি বলছেন, সবচেয়ে উত্তেজনাকর অবস্থা বিরাজ করছে। ডোরসা জব্বারি আরো বলছেন, ইরানের মিডিয়া এই হামলাকে ছোট করে দেখছে। তারা বলছে, তিনটি ছোট আকারের উড়ন্ত অজ্ঞাত বস্তুকে স্থানীয় সময় ভোর ৪টায় ইসফাহানের
আকাশে দেখা গেছে। ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তা শনাক্ত করে ধ্বংস করে দিয়েছে। এই স্থানটি হলো ইসফাহান প্রদেশে ইরানের একটি সামরিক বিমানঘাঁটি বরাবর।

সেটা দেশটির সেনাবাহিনী ব্যবহার করে, রেভ্যুলুশনারি গার্ড ব্যবহার করে না। এই ঘাঁটিতে আছে এফ-১৪ টোমক্যাট যুদ্ধবিমানের অনেক সংগ্রহ। এই স্থাপনাটি ইসফাহান বিমানবন্দরের কাছেই। এসব ঘটনার পর ইরানের আকাশসীমাকে পরিষ্কার ও নিরাপদ করেছেন কর্মকর্তারা। তবে ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। উত্তর-পশ্চিমের তাবরিজ শহরের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও সক্রিয় করা হয়েছে। ওদিকে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে উদ্ধৃত করে ইসরাইলের হারেৎজ পত্রিকা বলছে, ইরানের তিনজন কর্মকর্তা বলেছেন, ইসফাহানের কাছে একটি সামরিক ঘাঁটিতে হামলা হয়েছে। তবে তেহরানের কর্মকর্তারা এ খবরকে মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা বলে অভিহিত করেছেন। তারা বলেছেন, ইসফাহানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। ইরানে হামলার রিপোর্ট হলো ইসরাইল ও আমেরিকান মিডিয়ার প্রচারণা ছাড়া কিছু নয়। এ ছাড়া ইরানের সুপ্রিম ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল জরুরি বৈঠক তলব করেছে মর্মে যে খবর বেরিয়েছে, তাও প্রত্যাখ্যান করেছে ইরান। রাষ্ট্রীয় টিভি বলেছে, শহরে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এর বাইরে যেসব রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে তা ভুয়া। সীমিত আকারে হামলা এবং ইরানের নিরুত্তাপ জবাব-সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে, কূটনৈতিক উদ্যোগ সফল হয়েছে। গত শনিবার ইসরাইলে ইরানের ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর উত্তেজনা প্রশমনে কাজ করছিলেন কূটনীতিকরা। যুক্তরাষ্ট্রসহ ইসরাইলের অন্যান্য।

মিত্র পাল্টা হামলা না চালানোর পক্ষে অবস্থান নেয়। চলতি সপ্তাহে ব্রিটেন ও জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরুসালেম সফর করেন। পশ্চিমা বিশ্ব ওই হামলার পরিপ্রেক্ষিতে ইরানের ওপর আরো নিষেধাজ্ঞা জোরদারের ঘোষণা দেয়। ইসরাইল সরকারের মধ্যে থাকা কট্টরপন্থী অংশ ইরানকে কঠোর জবাব দেয়ার চাপ দিচ্ছিল। কট্টরপন্থী ইসরাইলের জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন গভির গতকাল শুক্রবার এক্স হ্যান্ডলে শুধু লিখেছেন, 'দুর্বল'। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা দুই পক্ষকে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি না করার আহবান জানিয়েছেন। ইইউ কমিশনের প্রধান উরসুলা তন ডার লেন বলেন, এ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা খুবই জরুরি। দুই পক্ষকে আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। একইভাবে বেইজিং ও আরব দেশগুলো দুই পক্ষকে সংযত থাকার আহবান জানিয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement