২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গাজায় ইসরাইলের গণহত্যা নিশ্চিত করল জাতিসঙ্ঘ

-

- পরিস্থিতি নারকীয়, সীমান্ত খুলে দিতে হবে : জার্মানি
- বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা অত্যধিক বেশি : যুক্তরাষ্ট্র
- সাগরে ত্রাণ আনতে গিয়ে ডুবে ১২ ফিলিস্তিনির মৃত্যু

ইসরাইল গাজা উপত্যকায় গণহত্যা চালিয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসঙ্ঘের একজন বিশেষজ্ঞ। একই সাথে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। জাতিসঙ্ঘের যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব পাস হওয়া সত্ত্বেও ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে অবিরাম হামলা চালিয়ে যাচ্ছে দখলদার ইসরাইলি বাহিনী। টানা প্রায় ছয় মাস ধরে চালানো এই হামলায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছেন ৩২ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি। বর্বর এই আগ্রাসনের জেরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে ক্ষোভ। রয়টার্স, আলজাজিরা, ডয়চে ভেলে ও সিএনএন।
রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, জাতিসঙ্ঘের একজন বিশেষজ্ঞ মঙ্গলবার বৈশ্বিক এই সংস্থার মানবাধিকার কাউন্সিলকে বলেছেন যে তিনি বিশ্বাস করেন, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযান গণহত্যার সমান এবং এই কারণে ইসরাইলের বিরুদ্ধে অবিলম্বে নিষেধাজ্ঞাসহ অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপের জন্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ইসরাইল অবশ্য জাতিসঙ্ঘের এই অধিবেশনে যোগ দেয়নি এবং গাজায় আগ্রাসন পরিচালনাকারী এই দেশটি জাতিসঙ্ঘের ওই বিশেষজ্ঞের ফলাফলকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ইসরাইলকে গণহত্যায় অভিযুক্ত করা জাতিসঙ্ঘের ওই বিশেষজ্ঞের নাম ফ্রান্সেসকা আলবানিজ। ফিলিস্তিনের অধিকৃত অঞ্চলে মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের বিশেষ এই র‌্যাপোর্টার মঙ্গলবার জেনেভায় জাতিসঙ্ঘের অধিকার সংস্থার কাছে ‘দ্য অ্যানাটমি অব এ জেনোসাইড’ নামে একটি রিপোর্ট উপস্থাপন করেন। ফ্রান্সেসকা আলবানিজ বলেন, মানবতার সবচেয়ে খারাপ অবস্থার বিষয়ে রিপোর্ট করা এবং প্রাপ্ত ফলাফলগুলো উপস্থাপন করা আমার দায়িত্ব। গাজায় একটি গোষ্ঠী হিসেবে ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অপরাধের সীমা পূরণ করা হয়েছে বলে আমি দেখতে পেয়েছি এবং এটি বিশ্বাস করারও যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে।

তিনি বলেন, অন্যান্য ক্রিয়াকলাপের মধ্যে ৩০ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, আমি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তাদের বাধ্যবাধকতাগুলো মেনে চলার জন্য অনুরোধ করছি, যা ইসরাইলের বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা এবং নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে শুরু হবে এবং ভবিষ্যতে যাতে এমন অপরাধের পুনরাবৃত্তি না হয় তা নিশ্চিত করবে। নাৎসি হলোকাস্টে ইহুদিদের গণহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে প্রণীত ১৯৪৮ সালের গণহত্যা কনভেনশনে গণহত্যাকে একটি জাতীয়, জাতিগত, জাতিগত বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত কাজ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
তবে জেনেভায় ইসরাইলের কূটনৈতিক মিশন বলেছে, গণহত্যা শব্দের ব্যবহার আপত্তিকর। তাদের দাবি, ইসরাইল এই যুদ্ধটি হামাসের বিরুদ্ধে করছে, ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে নয়। অবশ্য কাতারের মতো উপসাগরীয় দেশগুলো, সেইসাথে আলজেরিয়া এবং মৌরিতানিয়াসহ আফ্রিকান দেশগুলোও ফ্রান্সেসকা আলবেনিজের অনুসন্ধানের বিষয়ে সমর্থনের পাশাপাশি গাজার মানবিক পরিস্থিতির বিষয়ে যে উদ্বেগ জানানো হয়েছে, সেটির প্রতিও সমর্থন জানিয়েছে। এছাড়া ইসরাইলের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখানে আসন খালি রাখা হয়েছিল। ওয়াশিংটন এর আগে জাতিসঙ্ঘের এই কাউন্সিলের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদে ইসরাইল-বিরোধী পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ এনেছিল।

গাজার পরিস্থিতি নারকীয় : ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় আরো বেশি মানবিক সাহায্য পাঠানো প্রয়োজন। এজন্য সীমান্ত খুলে দিতে হবে বলে দাবি করেছেন জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনালেনা বেয়ারবক। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে সফর করছেন। মঙ্গলবার তিনি গিয়েছিলেন ইসরাইল-গাজা সীমান্ত কেরেম শালোমে। সেখানে দাঁড়িয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, গাজার পরিস্থিতি নারকীয়। দ্রুত সীমান্ত খুলে দিতে হবে এবং আরো অনেক বেশি পরিমাণে মানবিক সাহায্য পাঠাতে হবে সেখানে।
সেখানে দাঁড়িয়েই বেয়ারবক আরো জানিয়েছেন, ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামে জার্মানি বরাদ্দ বাড়িয়েছে। অতিরিক্ত এক কোটি ইউরো দেয়া হয়েছে গাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য, কোথায় সমস্যা এখনো জট পাকিয়ে আছে, তা নিয়ে আলোচনা করার সময় আর নেই। রাফাহ সীমান্ত দিয়ে যে ট্রাকগুলো গাজায় মানবিক সাহায্য নিয়ে ঢোকে সেগুলোতে তিনবার তল্লাশি চালানো হয়। সমস্ত জিনিস নামিয়ে দেখা হয়। যেভাবেই হোক এই প্রক্রিয়ার গতি বাড়াতে হবে। এর ফলে গাজায় যত দ্রুত মানবিক সাহায্য পৌঁছানো দরকার, তা পৌঁছাচ্ছে না।
বেয়ারবক জানিয়েছেন, মিসর এবং ইসরাইল দুই পক্ষই তাকে ট্রাক কিভাবে গাজায় ঢোকে সে বিষয়ে তথ্য দিয়েছে। বস্তুত, তিনিই প্রথম বিদেশী মন্ত্রী যাকে ইসরায়েল কেরেম শালোম পর্যন্ত যাওয়ার অনুমতি দিলো। তাকে দেখানো হয়েছে, কিভাবে প্রতিদিন ১২০টি ট্রাকে মানবিক সাহায্য বোঝাই করে গাজায় পাঠানো হয়। গত ৭ অক্টোবরের ঘটনার আগে গাজায় প্রতিদিন ৫০০ ট্রাক নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে যেত। তার মধ্যে ৩০০ ট্রাক যেত কেরেম শালোমের সীমান্ত দিয়ে। তা কমে এখন ১২০টি ট্রাকে এসে দাঁড়িয়েছে।

গাজায় মৃত্যু অত্যধিক বেশি : ইসরাইলের হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক। আর এই বিষয়টি নিয়ে আবারো সরব হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটি বলেছে, গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যুর সংখ্যা ‘অত্যধিক বেশি’। বুধবার আলজাজিরার এক খবরে বলা হয়েছে, গাজা উপত্যকায় বেসামরিক মৃত্যুর সংখ্যা ‘অনেক বেশি’ বলে ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে জানিয়ে দিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ যুদ্ধ-বিধ্বস্ত এই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির দাবিতে একটি প্রস্তাব পাস করার একদিন পরে গ্যালান্টকে এ কথা জানালেন তিনি। রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে মঙ্গলবার গ্যালান্টের সাথে বৈঠকের শুরুতে বক্তৃতাকালে অস্টিন বলেন, গাজায় পৌঁছানো মানবিক সহায়তার পরিমাণও খুব কম। মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগনের এই প্রধান আরো বলেন, গাজা মানবিক বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে এবং পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। এবং দুর্ভিক্ষ এড়ানোর জন্য আমাদের অবিলম্বে সহায়তা বৃদ্ধির প্রয়োজন এবং সমুদ্রপথে অস্থায়ী মানবিক করিডোর খোলার জন্য আমাদের কর্মকাণ্ড এই কাজকে সাহায্য করবে। কিন্তু মূল বিষয় হলো- স্থলপথে সাহায্য বিতরণ আরো প্রসারিত করা। ইসরাইল গাজায় অতীব জরুরি মানবিক সহায়তার প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে। এতে করে ফিলিস্তিনি এই ভূখণ্ড দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে বলেও জাতিসঙ্ঘসহ অনেকেই হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে। ইসরাইলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট এমন এক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানীতে সফরে এসেছেন যখন জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদ গত সোমবার গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে।

নাসের হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে ইসরাইল : মঙ্গলবার থেকে গাজার খান ইউনুসের নাসের হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে ইসরাইলি কয়েক ডজন ট্যাঙ্ক এবং সাঁজোয়া যান। প্রত্যক্ষদর্শীরা একথা জানিয়েছেন। এ দিকে ফিলিস্তিনের রেড ক্রিসেন্ট জানিয়েছে, ইসরাইলি সামরিক অভিযানের ফলে আরো একটি হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। নাসের হাসপাতালের প্রত্যক্ষদর্শীরা এএফপিকে জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনুসের বিস্তীর্ণ কমপ্লেক্সে গুলি চালানো হচ্ছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত কোনো অভিযান চালানো হয়নি।
হাসপাতালটিতে হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। গাজার হামাস পরিচালিত স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, ইসরাইলি সৈন্যরা অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে এর আশপাশে মর্টারের গোলা এবং সহিংস অভিযান পরিচালনা করছে। মন্ত্রণালয় বলেছে, হাজার হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষ এখনো হাসপাতালের ভেতরে রয়েছে। তাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার পানি, খাবার এবং শিশু খাদ্য নেই এবং তাদের জীবন হুমকির মধ্যে রয়েছে।

ত্রাণ আনতে গিয়ে ডুবে মৃত্যু : বিমান থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে সাগরে ফেলা ত্রাণ আনতে গিয়ে অন্তত ১২ ফিলিস্তিনি পানিতে ডুবে গেছেন। গত মঙ্গলবার বেঈত লাহিয়া উপকূলে এমন মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় প্যারামেডিকরা। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদমাধ্যম সিএনএন জানিয়েছে, তারা একটি ভিডিও পেয়েছে। সেটিতে দেখা গেছে, সাগরে ত্রাণ ফেলার পর সেগুলো আনতে দৌড়াদৌড়ি করছেন সাধারণ ফিলিস্তিনিরা। অপর একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, ডুবে যাওয়া মানুষদের উদ্ধার করে তীরে আনা হয়েছে এবং তাদের বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে।


আরো সংবাদ



premium cement