০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিশ্ব দুগ্ধ দিবস আজ

লোকসানে খামারিরা হৃষ্টপুষ্ট কোম্পানি

-

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা সুরুতজামান। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ২৮ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। আট মাস বয়সী শিশুসন্তানসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারে এখন তার প্রতিদিন এক লিটার দুধ লাগে। বাজারে মিল্কভিটাসহ পাস্তুরিত এক লিটার দুধের দাম ৯০ টাকা। দ্রব্যমূল্যের উচ্চমূল্যের সাথে নতুন করে বাধ্য হয়েই শিশু সন্তানের জন্য দুধ কিনতে হচ্ছে তাকে। এতে হিমশিম খেতে হচ্ছে সুরুতজামানকে। অথচ তৃণমূল পর্যায়ে ক্ষুদ্র খামারিরা লোকসানে এর অর্ধেক দামে দুধ বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

দেশের গোখামারের হাব হিসেবে পরিচিত পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চল। মিল্কভিটাসহ বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে দুধের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না গোখামারি ও ক্ষুদ্র কৃষকেরা। খামারিদের অভিযোগ, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলো তাদের কাছ থেকে এক লিটার তরল দুধ বোনাসসহ ৪৩ টাকায় কিনে প্যাকেটজাত করে প্রতি লিটার ৯০ টাকা দরে বিক্রি করছে। এক লিটার তরল দুধ থেকে আবার ৬০ টাকার ঘি উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলিয়ে এসব দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান প্রতি লিটার দুধে আয় করছে ১৫০ টাকা। অর্থাৎ প্রতি লিটার দুধে তাদের লাভ থাকছে ৯২ টাকার বেশি। দীর্ঘদিন ধরে দুগ্ধজাত কোম্পানিগুলো খামারিদের কাছ থেকে পানির দরে দুধ কিনে ব্যবসায়িকভাবে ফুলে ফেঁপে হৃষ্টúুষ্ট হচ্ছেন। অথচ ফোকলা থেকে যাচ্ছেন খামারিরা। দিনের পর দিন লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের।

এমন বাস্তবতায় আজ বৃহস্পতিবার সারা দেশে নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে বিশ্ব দুগ্ধ দিবস। ‘টেকসই দুগ্ধ শিল্প : সুস্থ মানুষ, সবুজ পৃথিবী’ এই প্রতিপাদ্যে রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ (কেআইবি) মিলনায়তনে ‘বিশ্ব দুগ্ধ দিবস উদযাপন ও ডেইরি আইকন সেলিব্রেশন’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যেখানে চারটি ক্যাটাগরিতে দেশের দুগ্ধ খাতের ৪১ জন সফল খামারি ও উদ্যোক্তাকে ডেইরি আকন সম্মাননা প্রদান করা হবে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এমপি। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক ডা: মো: এমদাদুল হক তালুকদারের সভাপতিত্বে এতে বিশেষ অতিথি থাকবেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এমপি ও সচিব ড. নাহিদ রশীদ।

কথা হয় সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ির খামারি মো: জাকির হোসেনের সাথে। এক সময় তার শতাধিক গরু ছিল। গোখাদ্যের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে লোকসানে পড়ে গরু বিক্রি করতে করতে তার খামারে মাত্র চারটি গাভী আছে। তিনি জানান, বাঘাবাড়ি মিল্কভিটা দুধে ফ্যাট বা ননীর স্ট্যান্ডার্ড ননীর পরিমাণ নির্ণয় করে দাম নির্ধারণ করে ৪৩-৪৫ টাকা কেজি। চার স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত দুধ সরবরাহ করে দাম পায় প্রতি লিটার ৪৫ টাকা। খোলাবাজারে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা। আগে তার সমিতি থেকে মিল্কভিটায় ৪৩-৪৪ ক্যান দুধ সরবরাহ করা হতো। এখন তা কমে নেমে এসেছে তিন-চার ক্যানে। তার মতো অনেক খামারিই গরু বিক্রি করে দিয়েছে।

জানা যায়, বর্তমানে স্থানীয়ভাবে খোলা বাজারে প্রতি লিটার তরল দুধ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তারা এই দুধ সরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটাসহ অন্যান্য প্রক্রিয়াজাতকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করছেন ৪৩-৪৮ টাকা কেজিতে। যেহেতু খামারিরা মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ, তাই ইচ্ছে করলেই খোলাবাজারে বিক্রি করতে পারেন না। খোলাবাজারে অবশ্য খুব বেশি চাহিদাও নেই। তাই বাধ্য হয়ে মিল্কভিটাসহ কোম্পানিগুলোতে দুধ সরবরাহ করতে হয় খামারিদের। মিল্কভিটাসহ দেশের প্রতিষ্ঠিত দুগ্ধজাত কোম্পানিগুলো দুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখায় অব্যাহত লোকসানের মুখে গোখামারি বিশেষ করে ক্ষুদ্র খামারিদের অনেকেই গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।

জানা যায়, স্বাধীনতার পর সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়িতে বড়াল নদী পাড়ে স্থাপন করা হয় দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদন কারখানা বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা। পাবনা-সিরাজগঞ্জ জেলায় গোখামার রয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার। এসব সমিতি প্রতিদিন গড়ে পাঁচ লাখ লিটার দুধ উৎপাদন করে থাকে। এ ছাড়া দু’টি জেলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই গাভী পালন করা হয়। এসব গাভী থেকে আরো প্রায় এক লাখ থেকে সোয়া লাখ লিটার দুধ পাওয়া যায়। এই দুধ মিল্কভিটাসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান ও ঘোষেরা ক্রয় করে থাকেন।

প্রাণ, আকিজ, আফতাব, ব্র্যাক ফুড (আড়ং), ফ্রেস মিল্ক, আমোফ্রেস মিল্ক, কোয়ালিটি, বিক্রমপুরসহ বেশ কিছু বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি দুধ সংগ্রহ করতে এ অঞ্চলে তাদের আঞ্চলিক ও শাখা দুগ্ধ সংগ্রহশালা স্থাপন করেছে। এর ফলে তরল দুধের চাহিদা দিন দিন বাড়তে থাকে। কিন্তু বাড়েনি দুধের উৎপাদন। সম্ভাবনাময় এই শিল্পকে কেন্দ্র করে পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের হাজার হাজার পরিবার তাদের জীবিকার পথ হিসেবে গাভী পালন ও দুধের ব্যবসা বেছে নিয়েছেন। ফলে এ অঞ্চলে গড়ে উঠছে হাজার হাজার গোখামার।
জানা যায়, পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রতিদিন দুধ উৎপাদন হচ্ছে সাত লাখ লিটার। এর মধ্যে ৪০ হাজার লিটার বাঘাবাড়ী মিল্কভিটা, প্রাণ ডেইরি দেড় লাখ লিটার, পৌনে দুই লাখ লিটার দুধ আফতাব, আকিজ, আমোফ্রেস মিল্ক, ব্র্যাকসহ বিভিন্ন বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠান, ঘোষ ও ব্যবসায়ীরা আড়াই লাখ লিটার, তিন শতাধিক মিষ্টির দোকানে ৪০ হাজার লিটার, হাট-বাজারে স্থানীয় ক্রেতারা প্রায় ৩০ হাজার লিটার দুধ ক্রয় করে থাকেন।

সরকারি ও বেসরকারি দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো খামারিদের কাছ থেকে চার দশমিক শূন্য স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ বোনাসসহ ৪৩ টাকায় কিনে সেই দুধ থেকে ননী বেড় করে নিচ্ছে। পরে তিন দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননীযুক্ত তরল দুধ প্যকেটজাত করে ৮৫ টাকা দরে বিক্রি করছে। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এ দুধ বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯২ টাকা লিটার। প্রতি লিটার দুধ থেকে শূন্য দশমিক ৫০ স্ট্যান্ডার্ড ননী তুলে ঘি তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রতি লিটার দুধ থেকে ৬০ টাকার ঘি উৎপাদিত হচ্ছে। সব মিলে দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি লিটার দুধে প্রায় ১৫০ টাকা আয় করছে। তাদের প্রতি লিটার দুধে লাভ থাকছে ৯২ টাকা। এ দিকে অব্যাহত লোকসানের মুখে কৃষক ও খামারিরা এ পেশাকে অলাভজনক মনে করতে শুরু করেছেন। খামারিরা দুধের দাম বৃদ্ধির দাবি করে এলেও তাদের সে দাবি মানা হচ্ছে না।

শাহজাদপুর উপজেলার চরাচিথুলিয়া প্রাথমিক দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় সমিতির সদস্য সোহেল রানা, ইউসুফ আলী, রওশন আলী, আব্দুল আলীমসহ কয়েকজন জানান, খামারিরা দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী প্রতিষ্ঠানে ৪৩ থেকে ৪৫ টাকা দরে প্রতি লিটার দুধ বিক্রি করছে। এতে তাদের দুধ উৎপাদন খরচ উঠছে না। অথচ খোলা বাজারে এই দুধ ৬০ থেকে ৬৫ টাকা লিটার দরে বিক্রি হচ্ছে। এ দিকে গোখাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেড়ে যাওয়ায় খামারিরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। আবার অনেক খামারি লোকসানের বোঝা বইতে না পেরে গরু বিক্রি করে দিচ্ছে। এতে সম্ভাবনাময় দুগ্ধ শিল্পের বিকাশ মুখ থুবড়ে পড়েছে।

প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানি প্রাণ ডেইরির সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বাঘাবাড়ীতে অবস্থিত আঞ্চলিক সংগ্রহ কেন্দ্রেরের ম্যানেজার মো: শরিফ উদ্দিন তরফদার জানান, তাদের রংপুর, সিরাজগঞ্জ ও পাবনা অঞ্চল থেকে প্রতিদিন দেড় লাখ লিটার তরল দুধ সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাহিদার তুলায় সরবরাহ কম থাকায় প্রতিদিন দুধ সংগ্রহ করা হচ্ছে মাত্র এক লাখ থেকে এক লাখ ২০ হাজার লিটার।
সরকারি দুগ্ধ উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকারী সমবায়ী প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটার ব্যবস্থাপনা কমিটির (ক) অঞ্চলের সাবেক পরিচালক নজরুল ইসলাম নকিব জানান, তিনি নিজেও একজন খামারি। দফায় দফায় গোখাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে এ শিল্প হুমকির মুখে পড়েছে। বর্তমান মূল্যে দুধ বিক্রি করে খামারিদের লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে তিনি জানান। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: ইমরান হোসেন বলেন, এই মুহূর্তে খামারিদের সবচেয়ে বড় সঙ্কট বাজার ব্যবস্থাপনা। প্রান্তিক খামারিরা দুধের দাম পাচ্ছেন না। আবার যাদের দুধ দরকার তারা ন্যায্য দামে দুধ পাচ্ছেন না। গোখাদ্যের মূল্য লাগামহীন। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা ও গোখাদ্যের দাম লাগামের মধ্যে রাখা জরুরি।

তিনি বলেন, বর্তমানে দেশে প্রতি গরু গড়ে তিন লিটার করে দুধ দিচ্ছে। ব্রিড ডেভেলপমেন্ট করা জরুরি। যাতে প্রতি গরুর গড়ে পাঁচ লিটার করে দুধ হয়। শুধু দুধ নয়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন, হট অ্যান্ড হিউমিডিটি টলারেন্ট জাত দরকার।
ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের এ সভাপতি বলেন, শুনছি খামারিদের উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প চলমান। কিন্তু বাস্তবতা হলো মাঠপর্যায়ে এসব প্রকল্পের উপকারিতা সেভাবে খামারিরা পাচ্ছেন না। রয়েছে ডাক্তারের (পশু) স্বল্পতা। খামারিদের ট্রেনিং দরকার। রিপিড ব্রিডিং হচ্ছে, এটা বন্ধ করা দরকার। এজন্য মাঠ পর্যায়ে পর্যাপ্ত এআই কর্মী দরকার।


আরো সংবাদ



premium cement