২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`
ব্যাপকতা ও গভীরতা হতাশাজনক : টিআইবি

বৈশ্বিক দুর্নীতিতে ১৩তম বাংলাদেশ

বছরে জাতীয় আয়ের দুই-তিন শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত
-

বিশ্বের ১৮০টি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের মধ্যে এবার একধাপ এগিয়ে বাংলাদেশ ১৩তম অবস্থানে রয়েছে। দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২১-এ টানা চতুর্থবার বাংলাদেশের স্কোর (২৬) অপরিবর্তিত। বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রকাশ করা ‘দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২১’-এ এই তথ্য উঠে এসেছে। আর টিআইবি বলছে, গত এক দশকে দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থানের স্থবিরতা প্রমাণ করে, দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা আশঙ্কাজনক। দুর্নীতির কারণে প্রতি বছর জাতীয় আয়ের দুই-তিন শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
টিআই কর্তৃক প্রকাশিত এই ধারণা সূচক গতকাল মঙ্গলবার ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) পক্ষ থেকে তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেনÑ টিআইবির উপদেষ্টা- নির্বাহী ব্যবস্থাপনা, অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ রফিকুল হাসান।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ২০২১ সালের সিপিআই অনুযায়ী, ৮৮ স্কোর পেয়ে যৌথভাবে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড। ৮৫ স্কোর নিয়ে যৌথভাবে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে সিঙ্গাপুর, সুইডেন ও নরওয়ে এবং ৮৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে সুইজারল্যান্ড। আর ১১ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নে দক্ষিণ সুদান। ১৩ স্কোর পেয়ে যৌথভাবে তালিকার দ্বিতীয় সর্বনিম্ন সিরিয়া ও সোমালিয়া এবং ১৪ স্কোর পেয়ে তৃতীয় সর্বনিম্ন অবস্থানে ভেনিজুয়েলা।
সিপিআই তথ্য বলছে, কোনো দেশই শতভাগ স্কোর করতে পারেনি। ১৮০টির মধ্যে ১০০টি দেশ বৈশ্বিক গড় ৪৩-এর কম স্কোর করেছে। ১৩০টি দেশের স্কোর ৫০-এর নিচে। ২০২০-এর তুলনায় স্কোর বেড়েছে ৬৫টি দেশের, ৬৬টি দেশের স্কোর কমেছে এবং ৪৮টি দেশের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। এরমধ্যে ২৭টি দেশ তাদের ইতিহাসের সর্বনিম্ন স্কোর করেছে। আর গত ১০ বছরে সার্বিকভাবে ৮৩টি দেশের স্কোর হ্রাস পেয়েছে, ৮৪টি দেশের বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বাংলাদেশসহ সাতটি দেশের স্কোর অপরিবর্তিত রয়েছে। টিআই বলছে, যেসব দেশে নাগরিক স্বাধীনতা ও অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, তারাই সিপিআই সূচকে কম স্কোর পেয়েছে। ২০১২ সাল থেকে বিশ্বের যে ২৩টি দেশের স্কোর হ্রাস পেয়েছে, তার ১৯টিই নাগরিক স্বাধীনতা সূচকেও কম স্কোর পেয়েছে। বিশেষ করে, ২০২০ সালে সারা বিশ্বের ৩৩১ জন মানবাধিকার কর্মী হত্যার ঘটনার ৯৮ শতাংশই এমন সব দেশে দেশে ঘটেছে, সূচকে যাদের স্কোর ৪৫-এর নিচে। এবারের সিপিআই অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে কম ভুটানে, সূচকে ৬৮ স্কোর পেয়ে উপর থেকে এর অবস্থান ২৫তম। এ অঞ্চলের আটটি দেশই এবার ২০২০-এর তুলনায় অধিক স্কোর অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। ভুটান, ভারত, নেপাল ও বাংলাদেশের স্কোর অপরিবর্তিত থাকলেও মালদ্বীপ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা ও আফগানিস্তানের অবনমন হয়েছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০২১ সালের সূচকে ০-১০০ স্কেলে টানা চতুর্থবার অপরিবর্তিত ২৬ স্কোর পেয়েছে বাংলাদেশ। গত এক দশকের স্কোর বিশ্লেষণে বাংলাদেশের ২৬-এ স্থবিরতা এবং সার্বিকভাবে অবস্থানের উল্লেখযোগ্য কোনো পরিবর্তন না হওয়া হতাশাব্যঞ্জক। এবারের সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন থেকে গণনা অনুযায়ী ২০২০-এর তুলনায় একধাপ উন্নতি হয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩তম। আর সর্বোচ্চ থেকে গণনা অনুযায়ী, একধাপ পিছিয়ে ১৪৭তম। একই স্কোর পেয়ে এবার নিম্নক্রম অনুযায়ী, বাংলাদেশের সাথে যৌথভাবে ১৩তম অবস্থানে মাদাগাস্কার ও মোজাম্বিক। ২০১২ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশের মধ্যে অষ্টমবারের মতো এবারো বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন এবং এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের ৩১টি দেশের মধ্যে তৃতীয় সর্বনিম্ন, যা বিব্রতকর, উদ্বেগজনক ও হতাশার।
ড. জামান বলেন, কোভিড-১৯ অতিমারীর সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রকট দুর্নীতিÑ বিশেষ করে, উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতির বিচার না হওয়া, আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতে ভয়াবহ খেলাপি ঋণ ও জালিয়াতি, গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অবস্থান ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হওয়া এবং ভিন্নমতের প্রতি সহনশীলতার ঘাটতিও আমাদের অবস্থানের উন্নতিতে অন্তরায় হয়েছে। বিভিন্ন নীতি ও প্রয়োগ ক্রমাগত জনস্বার্থ বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্ষমতাবানদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব, রাজনৈতিক শুদ্ধাচারের অবক্ষয়, ক্ষমতার অপব্যবহার, সরকারি কাজে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি ও অপরাধের সাথে রাজনৈতিক যোগসূত্রতা এবং রাঘববোয়ালদের জবাবদিহিতার আওতায় আনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা বাংলাদেশের আরো অগ্রগতি অর্জনের সুযোগ নষ্ট করেছে।
টিআইবি বলছে, সূচকে বাংলাদেশের আরো ভালো করার সুযোগ ছিল। যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত শূন্য সহনশীলতার অঙ্গীকার বাস্তবে প্রয়োগ করা যেত, দায়বদ্ধতা নিশ্চিতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অকার্যকরতা ও বিচারহীনতার অবসান ঘটিয়ে আইনের শাসন নিশ্চিত করা যেত এবং সরকারি ও রাজনৈতিক অবস্থান ব্যক্তিগত উন্নয়নের লাইসেন্স হিসেবে ব্যবহার বন্ধ করা যেত, তাহলে আমাদের স্কোর ও অবস্থানের আরো উন্নতি হতে পারত।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকারি খাতে সেবা নিতে গিয়ে যারা ঘুষ প্রদানে বাধ্য হন, তাদের ৮৯ শতাংশের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ঘুষ ছাড়া সরকারি সেবায় অভিগম্যতা অসম্ভব। দুর্নীতি এখন আমাদের সাধারণ জীবনাচারের অংশ হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সুফল সাধারণ ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের সুযোগ ও সম্ভাবনা আছে, তবে তা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক ‘যদি-কিন্তু’ রয়েছে। আমাদের আইন আছে, রাজনৈতিক অঙ্গীকারও আছে; কিন্তু যাদের ওপর এই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের ভার, তাদের একাংশই দুর্নীতিতে নিমজ্জিত, দুর্নীতির ফলে লাভবান, দুর্নীতিকে সুরক্ষা দেন এবং দুর্নীতির প্রসারে কাজ করেন। তাই এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য জনস্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল পরিবর্তন আনতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement