২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে কক্সবাজারের সাড়ে ৪ শতাধিক গ্রাম পানির নিচে

-

তিন দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রাম কক্সবাজারের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কক্সবাজারের চকরিয়াসহ ৬ উপজেলার প্রায় সাড়ে ৪ শতাধিক গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। সাঙ্গু, মাতামুহুরী ও বাঁককালী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে পাহাড়ধস হয়েছে। উখিয়ায় বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়া আরো ২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। বান্দরবানে ১৪০টি, কক্সবাজারে ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। চকরিয়া উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার শতাধিক গ্রাম পানিতে ভাসছে। উখিয়া উপজেলার শতাধিক গ্রাম পানির নিচে। এসব এলাকায় খাবার পানি ও খাদ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজার অফিস জানান, উখিয়ায় পাহাড়ি ঢলে ভেসে যাওয়া আরো ২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এই নিয়ে গত ৩ দিনে ২৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করেছে প্রশাসন। গত বুধবার বিকেলে পৃথক দুটি ঘটনায় এ ২ যুবকের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছে উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহমেদ।
নিহতরা হলেন উখিয়ার রাজাপালং ইউনিয়নের ধইল্লারঘোনার হাবিবুর রহমানের ছেলে আকবর আলী (৩১) ও মালিয়ারকুল এলাকার মোহাম্মদ ইসলামের ছেলে মোহাম্মদ রুবেল (২২)।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন জানিয়েছে, টানা বৃষ্টিতে কক্সবাজারের ৪১৩ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে ৫৫ হাজার ১৫০ পরিবারের আড়াই লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এটা আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়েছে।
কক্সবাজারে তিন দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। আবহাওয়া অফিস জানিয়েছে, ১১৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৩ নম্বর সতর্ক সঙ্কেতও রয়েছে। জেলার ৭১ ইউনিয়ন ও ৪ পৌরসভার মধ্যে ৪১ ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। যেখানে গ্রামের সংখ্যা ৪১৩টি। এসব প্লাবিত এলাকায় ৩০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৬ হাজারের বেশি মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, কক্সবাজার সদর উপজেলার ৫৮ গ্রাম, রামু উপজেলার ৩৫ গ্রাম, চকরিয়া উপজেলার ১০০ গ্রাম, পেকুয়া উপজেলার ৬ গ্রাম, মহেশখালী উপজেলার ৩৮ গ্রাম, উখিয়া উপজেলার ১২০ গ্রাম, টেকনাফ উপজেলার ৫৬ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
উল্লেখ্য, বৃষ্টিতে পাহাড়ধস ও পানিতে ভেসে বুধবার ১২ জন, মঙ্গলবার ৬ রোহিঙ্গাসহ ৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। অপর দিকে পার্শ্ববর্তী উপজেলা নাইক্যংছড়িতে পৃথকভাবে পাহাড়ি ঢলে ভেসে যাওয়া তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৩৫ টন চাল ও ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
চকরিয়া (কক্সবাজার) সংবাদদাতা জানান, টানা কয়েক দিনের প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে চকরিয়া উপজেলার শতাধিক গ্রাম পানির নিচের তলিয়ে গেছে। উপজেলার ১৮টি ইউনিয়ন ও চকরিয়া পৌরসভার লোকালয় বানের পানিতে ভাসছে। ফলে উপজেলার অন্তত ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা। টিউবওয়েল ও বসতবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সঙ্কটে পড়েছে পরিবারগুলো। অনেক স্থানে বাড়ির চাল পর্যন্ত পানিতে ডুবে যাওয়ায় নিরাপদ স্থানে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে হাজারো মানুষ। বুধবার থেকে গ্রামগুলো তলিয়ে যাওয়ায় রাস্তা রান্না বন্ধ রয়েছে অনেক পরিবারে। উপকূলীয় এলাকায় ২টি স্থানে বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়ে নতুন নতুন এলাকায় বন্যার পানি ঢুকে পড়ছে। ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় ভয়াবহ পাহাড়ধসের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরেজমিন পরিদর্শনকালে দেখা যায়, চকরিয়া উপজেলার বমু-বিল ছড়ি, সুরাজপুর-মানিকপুর, কাকারা, লক্ষ্যারচর, ফাঁসিয়াখালী, কৈয়ারবিল, হারবাং, বরইতলী, ডুলাহাজারা, খুটাখালী, চিরিংগা, সাহারবিল, পূর্ব বড় ভেওলা, বি.এম.চর, কোনাখালী, ঢেমুশিয়া, পশ্চিম বড় ভেওলা, বদরখালী ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল কোমর সমান পানিতে তলিয়ে গেছে।
এ দিকে মাতামুহুরী নদীর ভাঙনে চকরিয়া উপজেলার উপকূলের বি.এম.চর ইউনিয়নের কন্যারকুমের নাশি এলাকার বেড়িবাঁধ ও কোনাখালী ইউনিয়নের মরংঘোনার বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম জানিয়েছেন, ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও অতিরিক্ত বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের কারণে তা ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এখনো ভারী বর্ষণ অব্যাহত থাকায় নদীতে বন্যার পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্যার পানিতে চকরিয়া উপজেলার অধিকাংশ চিংড়ি ঘের ও ফসলি জমির ফসল বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।
এ দিকে চকরিয়া পৌর এলাকার বাটাখালী ব্রিজ এলাকায় ভাঙন দেখা দিয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙন ঠেকানোর ব্যবস্থা না করলে চকরিয়া-বদরখালী-মহেশখালী সড়কের ওপর নির্মিত বাটাখালী ব্রিজ পয়েন্টে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে এলাকাবাসী। কক্সবাজার পাউবো (পওর) বদরখালী শাখার এস.ও জামাল মোর্শেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দাবি করেন, কন্যারকুমের নাশি এলাকায় ভেঙে বন্যার পানি লোকালয়ে প্রবেশ করছে। ভাঙন ঠেকানোর জন্য তারা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ শামসুল তাবরীজ জানান, অতি বর্ষণজনিত কারণে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল, নদীভাঙন ও পাহাড়ধসের আশঙ্কায় জনসাধারণকে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন। এ ছাড়া চকরিয়ার ১৮টি ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের জন্য প্রতি ইউনিয়নে ৪ টন করে ৭২ টন চাল বরাদ্দ দিয়েছে বলে জানান।
কক্সবাজার-১ (চকরিয়া-পেকুয়া) আসনের এমপি আলহাজ জাফর আলম বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে গত বুধবার রাতে দুর্গত এলাকায় ৫ হাজার মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন। অন্য দিকে পৌর এলাকায় বন্যাদুর্গতদের মধ্যে পৌর মেয়র আলমগীর চৌধুরী ৭ হাজার মানুষের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেন এবং পৌর মেয়র প্রার্থী জিয়াবুল হক ২ হাজার মানুষের মধ্যে খিচুড়ি বিতরণ করেন। বন্যাকবলিত এলাকা পরিদর্শন করেন উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ ফজলুল করিম সাঈদী।
বান্দরবান সংবাদদাতা জানান, টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে বন্যায় বান্দরবান সদর, লামা, নাইক্ষ্যংছড়ি ও আলীকদম এই চারটি উপজেলার শত শত ঘরবাড়ি তলিয়ে গেছে। জেলার সাংগু-মাতামুহুরী ও বাঁকখালী নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পুরো জেলায় ১৪০টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে জেলা সদরের তেরোটি আশ্রয়কেন্দ্রে ইতোমধ্যে আড়াই হাজার লোক আশ্রয় নিয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার তৃতীয় দিনের মতো পাহাড়ি ঢলে নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা ও আলীকদম উপজেলায় সড়ক ও পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় আলীকদম থানচি উপজেলা সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বান্দরবানের মৃত্তিকা ও পানি সংরক্ষণ কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মাহাবুবুল ইসলাম জানান, আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় ১৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক ইয়াছমিন পারভীন তিবরীজি জানান, দুর্যোগ মোকাবেলায় স্থানীয় প্রশাসন এবং জেলা প্রশাসন সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। উপজেলাগুলোতে পাহাড়ধসে সড়ক, ঘরবাড়ি এবং বৃষ্টিতে সড়কধসে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাহাড়ধসে প্রাণহানি ঠেকাতে ঝুঁকিতে থাকা বসবাসকারীদের নিরাপদ স্থানে সরে যেতে মাইকিং করা হচ্ছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement