২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইটালিতে ডুবে যাওয়া নৌকায় কেন এত গুপ্তচর ছিল

ইটালিতে ডুবে যাওয়া নৌকায় কেন এত গুপ্তচর ছিল। - ছবি : সংগৃহীত

আল্পস পর্বতের নিচে ছবির মতো সুন্দর ম্যাগিওর হ্রদে হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে মানুষ ভর্তি একটি নৌকা ডবে যায়। এ ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, বিশেষ করে ইটালি ও ইসরাইলে।

পানিতে ডুবে নিহত চারজনের নাম-পরিচয় প্রকাশ এবং যাত্রীদের পেশাগত পরিচয় ফাঁস হওয়া এ দুর্ঘটনা বিস্ময় ও সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।

নিহতদের দু’জন ছিলেন ইটালির গোয়েন্দা কর্মকর্তা, একজন ছিলেন ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সাবেক অ্যাজেন্ট ও অন্যজন এক রুশ নারী।

দুর্ঘটনার জায়গাটিও বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আল্পস পর্বতের নিচে ওই হ্রদের একদিকে ইটালির লোমবার্ডি অঞ্চল, অন্য তীরে সুইজারল্যান্ডের টিচিনো। লোমবার্ডিতে বেশ কয়েকটি কোম্পানি রয়েছে, যেখানে সামরিক প্রযুক্তি তৈরি হয়। তাছাড়া, এমনিতেই মনে করা হয় যে সুইজারল্যান্ড বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দা এবং গুপ্তচরদের যাতায়াতের একটি ট্রানজিট পয়েন্ট, দেশটি হয়েই বিভিন্ন দেশের গোয়েন্দারা অন্য দেশে যাতায়াত করে।

ছোটো আকারের ওই প্রমোদ নৌকাটিতে মোট ২৩ জন ছিলেন। জানা গেছে, তাদের অনেকেরই ওই হ্রদের আশপাশে অ্যাপার্টমেন্ট বা বাড়ি রয়েছে।

ইটালির দৈনিক ইল কোরিয়ের দেল্লা সেরায় এর প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, ওই এলাকায় ইটালি ও ইসরাইলি সরকারি লোকজনের নির্বিঘ্নে ঘোরাফেরার অধিকার রয়েছে।

লেকের ওপর গুপ্তচরদের গোপন বৈঠক?

কিছু কিছু রিপোর্টে বলা হচ্ছে, নেহাত বিনোদনের জন্যই নৌকাটিতে করে বের হয়েছিলেন এর যাত্রীরা।

তবে ইটালির কিছু সংবাদপত্রের খবরে বলা হয়েছে, ডোবার আগে নৌকাটিতে ইটালি ও ইসরাইলি গুপ্তচরদের মধ্যে একটি বৈঠক চলছিল।

এ ঘটনা ইটালিতে এতটাই আলোচনার জন্ম দিয়েছে যে সরকার ২৮ মে নৌকাটি কিভাবে ডুবেছিল তা তদন্তে কার্লোস নোসেরিনা নামে তাদের একজন প্রসিকিউটার নিয়োগ করেছে।

তিনি জানিয়েছেন, নৌকাটিতে ২১জন গুপ্তচর ছিলেন। যাদের ১৩ জন ইটালির আর আটজন ইসরাইলের।

শুধু নৌকার চালক ক্লডিও কারমিনাটি ও তার নিহত স্ত্রী- যিনি একজন রুশ নাগরিক, কোনো গোয়েন্দা সংস্থার সাথে যুক্ত নন।

তবে কিছু রিপোর্ট বলছে, ১৫ মিটার লম্বা ওই প্রমোদ নৌকাটি ভাড়া করা হয়েছিল একজনের জন্মদিন পালনের উদ্দেশে। কিন্তু নৌকাটি হঠাৎ প্রচণ্ড এক ঝড়ের মধ্যে পড়ে যায় এবং ঘণ্টায় ৭০ কিলোমিটার বেগের বাতাস সেটি সহ্য করতে পারেনি।

দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ইটালিয়ান দৈনিক ইল কোরিয়ের দেল্লা সেরাকে ক্যাপ্টেন কারমিনাটি বলেন, ‘৩০ সেকেন্ডের মধ্যে যেন এক অলৌকিক প্রলয় নেমে আসে আমাদের ওপর। নৌকাটি সাথে সাথে ডুবে যায় এবং আমরা দেখলাম যে সবাই পানিতে।’

কারমিনাটি তদন্তকারীদের বলেন, এমন খারাপ আবহাওয়ার কোনে পূর্বাভাস ছিল না। তবে ঘাটে ফিরে আসার নির্ধারিত সময়ের পরও নৌকাটি হ্রদের ভেতর ছিল।

তার বিরুদ্ধে সম্ভাব্য ‘অনিচ্ছাকৃত হত্যাকাণ্ডের’ তদন্ত শুরু হয়েছে। তার কারণেই নৌকাটি ডুবেছে কি-না তাও তদন্ত করা হচ্ছে।

ক্যাপ্টেন কারমিনাটির নিহত স্ত্রী ৫০ বছর বয়সী আনা কোজকোভা রুশ নাগরিক, তবে ইটালিতে তার বসবাসের অনুমতি ছিল।

নিহতদের মধ্যে আরো ছিলেন তিজিনা বারনবি (৫৩), ক্লডিও আলোনজি (৬২)। তারা দুজনেই ইটালিয়ান গুপ্তচর সংস্থার অ্যাজেন্ট। ৫০ বছর বয়সী ইসরাইলি সিমোনি এরেজও নৌকাডুবিতে মারা গেছেন। তিনি ইসরাইলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ থেকে অবসর নিয়েছিলেন। তার নাম ইটালির মিডিয়াতে প্রকাশ করা হলেও ইসরাইলি মিডিয়া তার নাম উল্লেখ করা হয়নি।

অন্যদের অনেকে সাঁতরে তীরে উঠতে সমর্থ হয়। আশপাশের কিছু নৌকা গিয়ে বাকিদের টেনে তোলে।

উদ্ধারকাজে অংশ নেয় ইটালির পুলিশ ও দমকল বাহিনী। তারা জানিয়েছে, মৃত্যুগুলো হয়েছে নৌকা ডুবেই। তবে ইটালিয়ান মিডিয়া খবর দিয়েছে কোনো ময়নাতদন্ত করা হয়নি।

বেঁচে যাওয়া লোকজন উধাও
দুর্ঘটনাটি অন্য যে রহস্যের জন্ম দিয়েছে তা হলো যারা বেঁচে গেছে তারা যত দ্রুত সম্ভব জায়গা ছেড়ে চলে যায়।

ইটালিয়ান মিডিয়ার খবর অনুযায়ী উদ্ধার হওয়ার পরপরই তারা তাদের হোটেল থেকে জিনিসপত্র নিয়ে দ্রুত চলে যায়। যাদের হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল, প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েই তারাও সরে পড়ে। কাদের হাসপাতালে নেয়া হয়েছিল তার কোনো রেকর্ডও পাওয়া যায়নি।

ইসরাইলিরা তাদের ভাড়া করা গাড়ি ফেলে চলে যায়।

জানা গেছে, সোমবার মিলান থেকে একটি ইসরাইলি বিমান তাদের তুলে নিয়ে যায়।

বেঁচে যাওয়ার যাত্রীদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু সরকারি প্রসিকিউটার ও তদন্তকারী নোসেরিনো বলেন, নিহতদের নাম প্রকাশ স্বাভাবিক হলেও দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষজনের নাম-পরিচয় জানানোর কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।

ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বিনইয়ামিন নেতানিয়াহুর অফিস থেকে বুধবার নিশ্চিত করা হয়েছে, ইসরাইলি যে নাগরিক নিহত হয়েছে তিনি মোসাদের অবসরপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা ছিলেন।

প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘মোসাদ একজন নিবেদিতপ্রাণ পেশাদার বন্ধু হারিয়েছে। যিনি গত কয়েক দশক ধরে ইসরাইলি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। মোসাদে তার যে দায়িত্ব ছিল, তাতে তার নাম-পরিচয়ের বিস্তারিত প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’

নৌকায় অতিরিক্ত মানুষ ছিল?
ডুবে যাওয়া নৌকাটি এখনো তীরে আনা হয়নি। ফলে তদন্ত ঠিকমত শুরু করা যায়নি বলে জানান নোসিরিনো।

তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে নৌকাটি হ্রদের নিচের মাটিতে ঠেকে রয়েছে। টেনে তুলতে দুই থেকে তিন দিন লেগে যেতে পারে। নৌকাটির ধারণ ক্ষমতা ছিল ১৫ জনের, কিন্তু তাতে অতিরিক্ত আটজন যাত্রী ছিল।’

অনেক সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত যাত্রী থাকার কারণে আবহাওয়া খারাপ হয়ে পড়লে ক্যাপ্টেনের পক্ষে নৌকাটি ঠিকমত সামলানো সম্ভব হয়নি।

সরকারি ম্যাজিস্ট্রেটরা তদন্ত করে দেখছেন- কেন নৌকায় অতিরিক্ত লোক তোলা হয়েছিল এবং কেন খারাপ আবহাওয়ার মধ্যেও নৌকাটি ছাড়া হয়।

নোসিরিনো বলেন, নৌকাটি ঠিকমত নিরাপত্তা প্রটোকল মেনেছিল কি-না, ঠিকমত তার রক্ষণাবেক্ষণ করা হতো কিনা, এবং একই সাথে তার অনুমতিপত্র এবং ইন্স্যুরেন্স পরীক্ষা করে দেখা হবে।

তবে, নৌকাটিতে কী হচ্ছিল এবং কারা সেখানে ছিল তা নিয়ে অনেক কিছু যেহেতু অস্পষ্ট, ফলে এই দুর্ঘটনা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা সহজে শেষ হবে না।

ইটালির সেনা পুলিশ বাহিনী কারাবিনিয়েরি এ তদন্তে সাহায্য করছে।

তারা বলছে, নৌকা ও আবহাওয়ার বিষয়টি তারা খতিয়ে দেখবে। কিন্তু কারা নৌকায় ছিল দা নিয়ে তারা মাথা ঘামাবে না।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement