বাংলাদেশে ব্যাংকিং খাত সংস্কারের উদ্দেশ্যে সরকারি ও বেসরকারি খাতের দশটি ব্যাংককে পাঁচটিতে নামিয়ে আনার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তা সম্পন্ন করতে কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় এগুলো কতদিনে শেষ হবে তা নিয়ে সংশ্লিষ্টরাই এখনো নিশ্চিত নন।
তবে যেসব সবল ব্যাংক দুর্বল ব্যাংকগুলোকে অধিগ্রহণ করতে যাচ্ছে তাদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের ধারণা আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে ব্যাংক একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ার প্রাথমিক কাজ হিসেবে তারা এখন পর্যন্ত শুধু এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের জন্য অডিটর নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে।
এরপর বেশ কিছু ধাপের প্রস্তুতি শেষ করার পর ব্যাংকগুলোকে আদালতে গিয়ে একীভূত হওয়ার অনুমতি চাইতে হবে। আদালত অনুমতি দিলে এরপর ব্যাংকগুলো একীভূত করার কাজ শুরু হবে।
তবে দুর্বল ব্যাংক গ্রহণের জন্য কয়েকটি সবল ব্যাংককে ‘অনানুষ্ঠানিকভাবে বাধ্য’ করার যে অভিযোগ গণমাধ্যমে আসছে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বীকার করেনি। ব্যাংকগুলো অবশ্য প্রকাশ্যে ও আনুষ্ঠানিকভাবে এমন কোনো অভিযোগ করেনি।
‘তাদের সম্মতি আছে বলেই কাজটা হচ্ছে। এখানে জোর করে করানোর কোনো বিষয় নেই। রেগুলেটরি কিছু তো কেন্দ্রীয় ব্যাংক কারো ওপর চাপিয়ে দেয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুধু আহ্বান জানিয়েছে এবং যারা স্বেচ্ছায় এসেছে তাদেরটাই হচ্ছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘নির্দেশনা’ অনুযায়ী দুর্বল পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে পাঁচটি সবল ব্যাংক, যা নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া আছে এই খাতের বিশ্লেষকদের মধ্যে।
গত ৪ এপ্রিল ব্যাংক একীভূতকরণের (মার্জার) বিষয়ে নীতিমালা প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নীতিমালা অনুযায়ী খেলাপি ঋণ, মূলধন ঘাটতি, ব্যবস্থাপনা ও তারল্য– এ চারটি সূচকে প্রত্যাশিত মানদণ্ডের নিচে থাকা ব্যাংকগুলোই ‘দুর্বল’ হিসেবে চিহ্নিত হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।
ওদিকে প্রথম ধাপের দশটি ব্যাংককে একীভূত করে পাঁচটিতে নামিয়ে আনার প্রক্রিয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত নতুন করে আর কোনো ব্যাংককে একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় না আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কে কার সাথে একীভূত হচ্ছে
এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংক, সোনালী ও বিডিবিএল, কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, সিটি ও বেসিক ব্যাংক এবং ইউসিবি ও ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত হতে পরস্পরের সাথে একমত হয়েছে।
‘ব্যাংকগুলো তাদের এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেস্ট অর্থাৎ আগ্রহপত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেবে। এরপর ধীরে ধীরে অন্য ধাপের কাজগুলো হবে। আমরা এখন পর্যন্ত এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের জন্য অডিটর নিয়োগ দিয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি শুরু করতে পেরেছি,’ বলছিলেন মেজবাউল হক।
যদিও ব্যাংক সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, কে কার সাথে একীভূত হবে সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে ডেকে জানিয়ে দিয়েছে শুধু, তাদের মতামত নেয়া হয়নি। তবে একীভূত হতে যাওয়া ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে এমন কোনো মন্তব্য করেনি বা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
‘আমার মনে হয় এগুলো বাজারে ছড়ানো কথা, যার কোনো ভিত্তি নেই। আমরা আগ্রহ করেই একটি ব্যাংক আনতে চাইছি কারণ দুর্বল ব্যাংক থেকে ভালো ব্যাংকে পরিণত হওয়ার অভিজ্ঞতা সিটি ব্যাংকের আছে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন।
এর আগে গত মাসে এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের একীভূত হওয়ার ঘোষণার পর এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে দুই সপ্তাহ আগে যে কোনো একটি দুর্বল ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিলো এবং তারই অংশ হিসেবে দুই ব্যাংকের কর্মকর্তারা আলোচনার মাধ্যমে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
এ দফায় ১০টি ব্যাংক পাঁচটি ব্যাংকে একীভূত হওয়ার অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের আগে নতুন করে আর কোনো ব্যাংককে একীভূতকরণ করা হবে না বলে জানিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তবে নীতিমালা অনুযায়ী আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সাল থেকে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবেই একীভূত করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মেজবাউল হক বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ‘আমাদের সক্ষমতার বিষয়টি দেখতে হবে। বাজারেরও সক্ষমতা থাকতে হবে। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার জন্য যথার্থ রিসোর্স থাকতে হবে। পাঁচটা ব্যাংক একীভূতকরণটা সফল করার জন্য রিসোর্স কী আছে? কয়টা মানসম্মত অডিট ফার্ম আছে এখানে। তবে প্রোগ্রেস ভালো হলে তখন হয়তো নতুন একীভূতকরণে বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে,’ বলছিলেন তিনি।
অর্থাৎ এবারের একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পর পর্যালোচনা করা হবে এবং তার ভিত্তিতে নতুন করে আর কোনো ব্যাংককে একীভূত করা হবে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানাচ্ছেন তিনি।
ব্যাংক খাতকে সংস্কারের অংশ হিসেবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর সমস্যা কিভাবে কাটিয়ে ওঠা যায় তা নিয়ে আগেই ‘প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন বা পিসিএ’ নামে একটি ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করেছিলো কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরপর গত সপ্তাহে যে নীতিমালা জারি করা হয়েছে সে অনুযায়ী একীভূতকরণ প্রক্রিয়া সফল করার জন্য সবল ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার নীতি সহায়তা দেবে।
কী কী ধাপ, কতদিন লাগবে
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত যে সার্কুলার জারি করেছে সে অনুযায়ী, দুটি ব্যাংক নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ার পর তারা তাদের আগ্রহ জানিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন করবে।
এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্বাধীন অডিটর দিয়ে ব্যাংকের ভ্যালুয়েশন করাবে। এরপর উভয় ব্যাংক সমঝোতা চূড়ান্ত করবে এবং কী প্রক্রিয়ায় একীভূত হবে তার একটি প্রকল্প তৈরি করবে। একইসাথে তখন দুর্বল ব্যাংকগুলোর সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে জানা যাবে।
ঘোষিত নীতিমালা অনুযায়ী ওই অডিট বা নিরীক্ষা এবং আর্থিক ও আইনি কার্যক্রম সম্পন্ন করার ব্যয় বহন করার কথা বাংলাদেশ ব্যাংকেরই।
এরপর সিকিউরিটিজ ও এক্সচেঞ্জ কমিশনের অনুমতি নিয়ে দুর্বল ব্যাংক অবসায়নের জন্য আদালতে যাবে; সবল ব্যাংকের সাথে একীভূত হওয়ার জন্য অনুমতি চাইবে।
একইসাথে অডিট রিপোর্ট নিজ নিজ পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদনের পর শেয়ার হোল্ডারদের সম্মতির জন্য এজিএম আহবান করে সম্মতি গ্রহণ করতে হবে।
‘চূড়ান্তভাবে আদালতের সিদ্ধান্ত পেলে তারপর ব্যাংকগুলো একীভূতকরণের কাজ শুরু করবে। এখনো এক্সিম ও পদ্মা ব্যাংকের বাইরে অন্য ব্যাংকগুলোর এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট আমাদের কাছে আসেনি,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক।
তবে বেসিক ব্যাংককে নিজের সাথে একীভূত করতে যাওয়া সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, দুই ব্যাংকের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এমওইউ (সমঝোতা স্মারক) স্বাক্ষরের পর সাড়ে চার থেকে পাঁচ বছর পর্যন্ত সময় লাগবে একীভূতকরণ প্রক্রিয়া চূড়ান্তভাবে সম্পন্ন করতে।
‘আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এমওইউ স্বাক্ষর হবে। তার আগে আমাদের উভয় ব্যাংককে নিজ নিজ বোর্ডের অনুমোদন নিতে হবে। এরপর সবগুলো ধাপের কাজ শেষে আদালতের অনুমতি পেলে একীভূতকরণের কাজ শুরু হবে। আমি আশা করছি এমওইউ স্বাক্ষরের পর থেকে চার/সাড়ে চার বছরের মধ্যে প্রক্রিয়াটি শেষ হবে,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালায় বলা হয়েছে যে একীভূত হওয়া ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের তিন বছরের মধ্যে ছাঁটাই করা যাবে না।
তারপরও যেসব দুর্বল ব্যাংকের নাম একীভূতকরণ প্রক্রিয়ায় এসেছে সেখানকার কর্মীদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার খবরও আসছে।
বেসিক ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীরা এ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের কাছে স্মারকলিপি দিয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে।
যদিও বেসিক ব্যাংক যেই ব্যাংকের সাথে একীভূত হবে সেই সিটি ব্যাংক বলছে আগামী অন্তত চার বছর কারো চাকরি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
এর মধ্যে এক বছর একীভূত হওয়ার প্রস্তুতিকাল এবং এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী তিন বছর কাউকে ছাঁটাই না করার নির্দেশনা মানতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোকে।
‘আমরা ভালো প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমনিতেই মানবিক বিষয়গুলো গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি। আমাদের সাথে এসে কাউকে কেন চাকরি হারাতে হবে। আমি আশা করি চার বছরের গ্যারান্টির সময়ের পরেও সবাইকে নিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারবো,’ বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
নজরুল ইসলাম মজুমদারও বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন যে সারা দেশে পদ্মা ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় প্রায় এক হাজার মানুষ কর্মরত আছে। তাদের চাকরির কোনো ক্ষতি হবে না। সূত্র : বিবিসি
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা