২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ভোক্তার অধিকার রক্ষায় কী করছে ভোক্তা অধিদফতর

- ছবি : ডয়চে ভেলে

বাংলাদেশে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরই মূল দায়িত্বে আছে। কিন্তু তাদের জনবল আর কর্ম এলাকার সীমবদ্ধতার কারণে ভোক্তারা সব অভিযোগের প্রতিকার পান না। একইসাথে আছে আইন প্রয়োগে দ্বৈতনীতি।

২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন পাস হয়। এই আইনের অধীনে অধিদফতর বাজার তদারকি, ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ এবং এই সংক্রান্ত অপরাধের বিচার ও নিস্পত্তি করে। তাদের কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং অভিযোগ নিস্পত্তির মাধ্যমে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ।

তবে আইনে ই-কমার্স, স্বাস্থ্যসেবা, টেলিকম, বাড়ি ভাড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত নেই। সরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান যেমন ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ (ওয়াসা), ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ (ডেসা) বা তিতাসের গ্রাহকদের কোনো অভিযোগ আমলে নিতে পারে না ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতর। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে প্রচুর অভিযোগ আসে অধিদফতরে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহা-পরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান জানান, ’ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আইনে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও আমরা প্রতারণাসহ অন্য আইনে অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি করি।’

অধিদফতর যেভাবে কাজ করে :
ভোক্তারা সরাসরি ও অনলাইনে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরে অভিযোগ করতে পারেন। তারা অভিযানও পরিচালনা করে। এটা অভিযোগের ভিত্তিতেও হয় আবার অধিদফতর নিজেদের উদ্যোগেও করে। অভিযানের ক্ষেত্রে অন্যায্য দাম, প্রতারণা, ভেজাল ও মজুতের মতো বিষয়কে প্রাধান্য দেয়া হয়।

ভোক্তা সংরক্ষণ অধিকার আইন অনুযায়ী অধিদফতর অভিযান পরিচালনা এবং বিচারিক কাজ দু’টিই একসাথে করে। আইনের ৭০ ধারায় তারা প্রশাসনিক ব্যবস্থার আওতায় জরিমানা, লাইসেন্স বাতিল, স্থায়ী বা অস্থায়ীভাবে কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে। আইনের ৫৭ ধারায় ফৌজদারি ব্যবস্থা নিতে পারে। সর্বোচ্চ তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড দিতে পারে। তারা আইনের ৬৬-৬৭ ধারায় ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারে। ক্ষতির চেয়ে পাঁচগুণ পরিমাণ আদেশ দেয়ার ক্ষমতা তাদের আছে।

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে ওষুধে ভেজাল, মিশ্রণ বা নকল ওষুধের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদফতরের মহা-পরিচালক এই বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারেন। কিন্তু এর বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেন না। ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলাও করতে পারেন না। বিচারের দায়িত্ব বিশেষ ট্রাইব্যুনালের। তারা সরাসরি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারে না। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রের মাধ্যমে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হয়। এর বাইরে এই অধিদফতর সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সচেতনতামূলক কাজ করে। তাদের সব কাজের মূল লক্ষ্য হলো ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ।

অভিযোগ ও নিষ্পত্তি :
ভোক্তাদের অভিযোগ বাড়ছে। ২০২৩ সালে ২৬ হাজার ৬০৫টি অভিযোগ জমা পড়ে, যা তার আগের বছরের তুলনায় প্রায় ১০ হাজার বেশি। ২০২২ সালে অভিযোগের সংখ্যা ছিল ১৬ হাজার ৫৪টি। এর আগে ২০১০ সালের ৬ এপ্রিল থেকে বাজার পর্যবেক্ষণ এবং অভিযোগ গ্রহণ ও নিষ্পত্তি শুরু করে অধিদফতর। গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ লাখ ২৩ হাজার ৭৫৩টি অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা, যার বেশিভাগই ই-কমার্স ও এফ-কমার্সের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ১ লাখ ২১ হাজার ৩৬০টি অভিযোগ নিষ্পন্ন হয়েছে।

সংস্থাটি অভিযোগ ছাড়াও নিজ উদ্যোগে বিভিন্ন বাজারে এ পর্যন্ত ৭২ হাজার ৯৩৭টি অভিযানে ১ লাখ ৭০ হাজার ৯০৮টি প্রতিষ্ঠানকে শাস্তির আওতায় এনেছে। তাদের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করেছে ১২০ কোটি ২৭ লাখ ৪৮ হাজার টাকার বেশি। এছাড়া ভোক্তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে ৯ হাজার ১৫০টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ৬ কোটি ৩৫ লাখ টাকার বেশি জরিমানা করেছে। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ হিসাবে অভিযোগকারীদের দেয়া হয়েছে ১ কোটি ৫৫ লাখ ৬৬ হাজার টাকার বেশি। বাকি ৭৫ শতাংশ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হয়েছে।

২০২১ সালের পর থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ই-কমার্সের বিরুদ্ধে ৩৪ হাজার ৮৪২টি অভিযোগ করা হয়। এর মধ্যে ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ৬ হাজার ৩৮৮টি। মোট অভিযোগের নিষ্পত্তি হয়েছে ১৫ হাজার ৪৩৮টি বা ৪৪ দশমিক ৩১ শতাংশ। অধিদফতরের হটলাইনেও বেড়েছে অভিযোগ। সংস্থাটির কল সেন্টার ১৬১২১-এ গত সাত মাসে ৩৫ হাজারের বেশি কল করে অভিযোগ করেছেন ভোক্তারা।

জনবল ও আইনের সমস্যা :
ভোক্তা অধিদফতরে ৮২ জন কর্মকর্তাসহ মোট জনবল ২৮০ জন। দেশের ১৭টি জেলায় ভোক্তা অধিদফতরের কোনো কর্মকর্তা নেই। আর উপজেলা পর্যায়ে এখনো তাদের কাজ সম্প্রসারিত হয়নি।

অধিদফতরের মহা-পরিচালক বলেন, ’কাজের তুলনায় জনবল আছে এখন ১০ ভাগের ১ ভাগ। আর আমাদের কাজ উপজেলা পর্যন্ত সম্প্রসারিত হওয়া প্রয়োজন।’ ২০০৯ সালের অর্গানোগ্রামে মোট অনুমাদিত জনবল ছিল ৩৬৬ জন। আরো ৪৫৭টি পদ সৃষ্টির আবেদন করা হলেও অনুমোদন মিলছে মাত্র ১২টির। এছাড়া আইন ও লজিস্টিক সাপোর্টে সমস্যা আছে। কর্মকর্তারা ভাড়া করা গাড়িতে অভিযানে যান। আর মেবাইল কোর্ট পরিচালনার সরাসরি এখতিয়ার নেই।’

তবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাস টিটু বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে ইউএনও এবং জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসকেরা আছেন। তারাই মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে পারেন। ফলে আমি মনে করি ভোক্তা অধিদফতরের লোকবল বাড়ানো নয়, দরকার এটা নিয়ে প্রচার ও সচেতনতা। তারা পলিসি তৈরি করবেন। প্রশাসনের মাধ্যমে কার্যকর করা হবে।’

তার কথা, ’জনপ্রতিনিধি ও ক্যাবের মতো যেসব সংগঠন আছে তাদের বেশি করে সম্পৃক্ত করতে হবে। সবখানে পুলিশিং নয়, দরকার সচেতনতা ও অংশগ্রহণ।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, ’আইন আছে, কিন্তু প্রয়োগ ঠিক মতো করা হয় না। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুতদারির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ভোক্তা অধিদফতর চাইলে এই আইনে মামলা করতে পারে। তারা নিজেরা আইনটি প্রয়োগ করতে পারেন, কিন্তু মামলায় তো বাধা নেই। ডিসিরাও এই আইনে মামলা করেন না। তারা সবাই চান এখন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দেশ চালাতে। তারা নিজেরাই শাস্তি দিতে চান সবক্ষেত্রে। এটাই সমস্যা।’

ভোক্তার অধিকার আদায় বত দূর?
কনজ্যুমারস অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ’দেশের অনেক ভোক্তাই এখনো তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন না। অভিযোগ নেয়া হয় প্রধানত অনলাইনে। অধিকাংশ মানুষই অনলাইনে অভ্যস্ত নয়। আর অভিযোগ অনেক জটিল প্রক্রিয়া। অনেক কাগজপত্র লাগে। সেটা আবার প্রমাণ করতে হয়। ক্রেতা যখন পণ্য কেনেন তখন তো তিনি প্রতারিত হওয়ার আগাম প্রস্তুতি রাখেন না। ফলে তারা কাগজপত্রও সংরক্ষণ করেন না। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান বিক্রয় রসিদ দেয় না।’

নাজের হোসেন বলেন, ‘তবে এই ব্যক্তি পর্যায়ের চেয়ে বড় বিষয় হলো ক্রেতারা এখন সবাই প্রতারিত হচ্ছেন একযোগে। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। তারা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বাজারে অস্থিরতা তৈরি করছে। তার বিরুদ্ধে তো কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। ব্যবসায়ীদের কাছে ক্রেতারা এক প্রকার বাধ্য তার প্রতিকার কে দেবে?’

তিনি আরো বলেন, ‘আর নিত্যপণ্যের ওপর সরকার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি কর বসায়। ব্যবসায়ীরা সেটা ক্রেতার কাছ থেকে আদায় করে। ফলে অস্বাভাবিক দাম বাড়ার পিছনে সরকারেরও হাত আছে। এটা আমাদের আশপাশের দেশে হয় না। তারা এসেনশিয়াল প্রোডাক্টে এত কর বসায় না।’

মনজিল মোরসেদ বলেন, ’ভোক্তা অধিদফতরকে আমরা ছোট খাটো ব্যবসায়ী ও দোকানদাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে দেখি। কিন্তু যারা আমদানি করে, মজুত করে, যারা সঙ্কট তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দেখি না।’

এর জবাবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘সরকারের দায়িত্ব পণ্যের সাপ্লাই ঠিক রাখা। আমরা সেটা আশা করি আগামী তিন মাসের মধ্যে করতে পারব। তবে হঠাৎ করে কঠিন কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায় না। তাতে সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়।’

সূত্র : ডয়চে ভেলে


আরো সংবাদ



premium cement
নোয়াখালীতে ভূমিদস্যুর বিরুদ্ধে ঝাড়-মিছিল ব্রিটিশ তেলবাহী ট্যাংকারে হাউছিদের সরাসরি হামলা গাজা নিয়ে আলোচনার জন্য সৌদি আরব যাচ্ছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিরসরাই প্রেস ক্লাবের নতুন সভাপতি মিঠু, সম্পাদক মাঈন আইসিসির সিদ্ধান্ত ইসরাইলকে প্রভাবিত করবে না : নেতানিয়াহু শনিবার বন্ধই থাকছে প্রাথমিক বিদ্যালয় মে মাসে দেশে সর্বকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড হতে পারে ডাসারে শিশু খেলতে গিয়ে পানিতে পড়ে নিখোঁজ সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী ট্রাস্টের শরবত বিতরণ কর্মসূচি ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের শতাধিক স্পটে জামায়াতের খাবার পানি ও স্যালাইন বিতরণ দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক বাধা দূর করতে সম্মত ভুটান ও বাংলাদেশ

সকল