২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অনন্ত নীরবতা

-

শায়লা কথাগুলো প্রায়ই বলে। বাবারে রাইখা আমি কোথাও যাবো না। বাবারে কেউ কিছু বললে তার খবর আছে! আমি বাবার লাঠি। অনেকে সেই ছেলেমানুষি উপভোগও করে। ছোটবেলা থেকে শায়লা এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। ঘুরে ঘুরে বেড়াতে তার খুব ভালো লাগে। দেখা জিনিস অবাক বিস্ময়ে দেখে। শায়লা মেয়ে হলেও চলনে বলনে মেয়েসুলভতা এড়িয়ে চলে। পোশাক আশাকেও তেমন। সব সময় ছেলেদের শার্ট প্যান্ট পড়ে থাকে। বাবা মা তাকে মেয়েদের পোশাক পরাতে জড়াজড়ি করলেও সে পরে না। অনেকে বলে, তুই হইছিস মেয়ে, মেয়েদের পোশাক পরলে তরে সুন্দর লাগবে। কে শুনে কার কথা। পুরুষ রূপ ধারণ করেই নারী হয়তো কোনো উপায়ে মানুষ হয়ে বাঁচার চেষ্টা করতে পারে। অল্প বয়সে শায়লার এমন উপলব্ধি হয়ে ছিল কিনা কে জানে!
শায়লার বাবা জাকির হোসেন নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ। কারো আগে পিছে নাই। কখনো সাথে তার কারো ঝগড়া-বিবাদ হয়েছে বলে কেউ বলতে পারবে না। তারপরও শায়লার হুঁশিয়ারি থামে না। আমার বাবার সাথে কেউ বিরোধ করলে আমি তারে ছাইড়া দেব না। এক প্রতিবেশী বলে, আগে কাউরে কিছু কইতে দে, না কইতে দিয়াই তুই আগে থাইকা রেডি হইয়া আছস। তোর বাবারে কেউ কিছু কইলে তুই তারে খাইয়া ফেলাবি। মাইয়া মানুষের অত বাড় বাড়ন্ত ভালা না। তোর বিয়ে শাদী হইতে হইব না? শায়লার তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, আমি মাইয়া না আমি আমার বাপের পোলা। আমার বাপেরে রাইখা আমি কোথাও যামু না। দাদি রাহেলা নাতনিকে নিয়ে চিন্তিত। শায়লাকে বুঝাতে চেষ্টা করে, বড় হইতাছস তরে বিয়া দিতে হইব না। এমুন পোশাকে হাঁটাচলা করলে মানুষ কি ভাবব আর কি বলব। শায়লার উত্তর, মানুষ যা ভাবে ভাবুক, তাগো ভাবনা নিয়ে তারা থাক। দাদি যতই বলুক কোন বুঝে কাজ হয় না।

শায়লার বাবার জমিজমা আছে। একা দেখাশোনা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। জমির কাজে লোক নিতে হয়। শায়লা বায়না ধরে, বাবা আমি থাকতে তুমি লোক নাও কেন? জাকির হোসেন বুঝাতে চেষ্টা করে, মা মাইয়ারা বাড়ির কাজ করে চক পাথারে কাজ করে না। শায়লা প্রতিবাদ করে, বাবা তোমরা আমারে মাইয়া বলো না তো। আমি পোলা। যে কথা সেই কাজ। শায়লার বাবার সাথে জমি খেতে কাজ করতে যায়।
শায়লার দাদি রাহেলা ছেলেকে বলে, বাবা তুই শায়লার বিয়া দিয়া দে। দেখিস তখন ঠিক হইয়া যাইব। জাকির হোসেন মার কথায় আপত্তি করে। এই ছোট বয়সে মাইয়ারে বিয়া দেব? ওতো এখনো ভালো মন্দের কিছুই বোঝে না। সময় এগিয়ে গেলেও নারীর জন্য অনাদি কালের মজ্জাগত ব্যবস্থার বাইরে কেউ চিন্তা করে না। রাহেলা পুরনো কথার সুরে বলে, মাইয়া মানুষ বিয়া দিলেই গিন্নি হইব। আমরা তো কথা শুনাইতে পারি নাই স্বামীর বাড়ি গেল ঠিকই কথা শুনব। নাতনি বড় হচ্ছে এমন অনাসৃষ্টি কাণ্ড দেখে চিন্তিত হয় দাদি। রাহেলা প্রায়ই ছেলেকে শায়লার বিয়ের গুরুত্ব বুঝাতে থাকে। একদিন জাকির হোসেন মায়ের কথায় রাজি হয়ে যায়। ঠিক আছে মা তুমি যা ভালো মনে করো তাই হবে। শায়লার মা রেহানা তাতে আপত্তি জানায়। ছোট মেয়ে এখন একটু হেসে খেলে বেড়াবে। আমার মেয়ে উচ্ছন্নে যাওয়ার মতো কিছু করে নাই। পুত্রবধূর কথায় মনঃক্ষুণœ হয় শাশুড়ি। বৌমা তুমি আর এতে বাধা হয়ে দাঁড়াইও না। তোমার আরো কয়েকজন সন্তান আছে তাদের ভবিষ্যৎ নিয়া ভাব। যে ঠিক হয় ছোটকাল থেকেই ঠিক হয়। তোমার মেয়ে কাউকে মানতে চায় না। এসব স্বভাব অয় পরে বদলাইব না। এক যদি ঠিক হয় স্বামীর বাড়ি যাইয়া হইব। শায়লা এরপর যাই করুক আমি আর কোনো কিছুতে মত দেব না। উপায়ন্তর না দেখে রেহানা হাল ছেড়ে দেয়। ঠিক আছে মা আপনার ছেলে যা ভালো মনে করে তাই করুক।

শায়লার বিয়ে হয়। ভাগ্যের বিড়ম্বনা এড়াতে পারে না তার নিয়তি। শায়লার স্বামী এবং শশুরবাড়ির মানুষ ভীষণ অর্থ লোভী। স্বামীর ব্যবসায় লস হয়েছে কারবার চালু করতে টাকার দরকার। যথারীতি স্ত্রীর ওপর চাপ বাপের বাড়ি থেকে টাকা এনে দিতে হবে। কিন্তু শায়লা কোনো অবস্থাতেই বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনবে না। শাশুড়ি মালেহা বেগম বহুভাবে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত শায়লার গায়ে হাত তোলে শাশুড়ি। শুরু হয় প্রকাশ্য এবং অপ্রকাশ্য নিপীড়ন। তাকে ঠিকমতো খেতে দেয়া হয় না। অর্ধাহারে অনাহারে কাটে তার দিন। শায়লা অনড়। এসবের কিছুই জানায় না বাপের বাড়িতে। স্বামী রিফাত মায়ের মতেই চলে। তারও একই কথা। সাথে অকাট্য যুক্তি, টাকা আনলে তা তো তাদের মেয়ের সংসারেই লাগবে। আরো যোগ করে, টাকা পয়সা আনো না হলে বাপের বাড়ি চলে যাও। বিবাহিত জীবন নিয়ে মেয়েদের অনেক রঙিন স্বপ্ন থাকে। তার জীবন যে এমন অপমানের হবে তা শায়লা কল্পনাও করেনি। বাবা-মার প্রতি অভিমানে চোখ ফেটে কান্না আসে। প্রচার-প্রচারণা শুনে বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে একটা ধারণা গড়ে উঠেছিল তার। কোনো কাজে লাগে না সেসব। পরিবারের ভুল সিদ্ধান্তে বিপর্যস্ত হয় কচি জীবন। শায়লা সিদ্ধান্ত নেয় স্বামীর বাড়ি যত কষ্টই হোক বাপের বাড়ি আর যাবে না। তার এই কষ্টের কথা কাউকে জানাতে চায় না। প্রাণ চঞ্চল একটা মেয়ে অলক্ষে নীরব হয়ে যায়। অনন্তকালের কত শত কোটি জীবনের সাথে যেন যোগ হয় আর একটি জীবন। দাদি ঠিকই বলেছিল স্বামীর বাড়ি গেলে ঠিক হয়ে যাবে শায়লা। চটপটা প্রাণ উচ্ছল মেয়েটি স্বামীর বাড়িতে এতই সঠিক হয়ে যাবে তা কেউ ভাবতে পারিনি। সে পাথর হয়ে যায়। শায়লা বাপের বাড়ি যাওয়া তো বটেই বাপের বাড়ির সাথে যোগাযোগও বন্ধ করে দেয়। কঠিন প্রতিজ্ঞা করে। মরি বাঁচি যাই হোক স্বামীর বাড়ি পড়ে থাকব।
জাকির হোসেন মেয়েকে দেখতে আসে অনেক দিন পর। শায়লা সতর্ক হয়। বাবা যেন কোন অবস্থায় বুঝতে না পারে তার প্রকৃত অবস্থা। সে এক কাণ্ড করে বসে। বাবার সামনে হাজির হয় স্বামীর প্যান্ট শার্ট পরে। জাকির হোসেন চমকে উঠে। ভেবেছিল মেয়ের বিয়ে দিলে পরিবর্তন হবে। তা তো হয়নি বরং সে অভ্যাস আরো প্রকট হয়েছে। সবার সামনে লজ্জিত হয়। শায়লা অভিনয় করে প্যান্ট শার্ট পরলেও বাবাকে বুঝতে দিতে চায় না তার শরীরে মারের দাগ। জাকির হোসেন কোনো কিছু না বুঝতে পারলেও এটা বুঝে গেছে তার মেয়ে বাড়িতে যেমন ছিল এখনো তেমনি আছে। মেয়েকে অনেক বকাঝকা করে। এটা তোমার শ্বশুর বাড়ি বাবার বাড়ি না। যে কারণে তোমাকে এত ছোট বয়সে বিয়ে দিলাম তোমার পরিবর্তন হবে, পরিবর্তন তো হয় নাই যেমন ছিল তেমনি আছ। শাশুড়ি মালেহা সুযোগ পেয়ে বিষ ঢালতে থাকে। বলে, বিয়ান সাহেব আপনার মেয়েকে আদর সোহাগের কমতি করি না। আমি যে তার গুরুজন সেদিকে কোনো গ্রাহ্য নেই। আমারে কোনো মূল্যায়ন করে না। তার বেপরোয়া চলাফেরায় বিরাম নেই। এই যে আপনি এসেছেন দেখেন আপনার মেয়ের পোশাক-আশাক। মালেহার কথায় আরো লজ্জায় পায় জাকির হোসেন। শায়লার এমন কাণ্ডে মালেহা আশ্চর্য হলেও নিজের দোষ ঢাকতে পেরে হাফ ছেড়ে বাঁচে। সে প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে। বিয়াইন সাব আপনার এত কিছু আনার কি দরকার ছিল না। আমরা কি আপনার মেয়েকে আদর যতেœ কমে রাখছি? জাকির হোসেন বলে, না তা রাখেন নাই বিয়াইন সাহেবা। আপনাদের সাথে আত্মীয়তা করতে পেরে আমি বড়ই ভাগ্যবান। মালেহাও তালে তাল মিলিয়ে বলে, আমরাও আপনার সাথে আত্মীয়তা করে সৌভাগ্যবান।
জাকির হোসেন অস্বস্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে। স্ত্রী আর মাকে বলে, শায়লার কোনো পরিবর্তন হইল না ও যেমন ছিল তেমনি আছে। শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ দেইখা ওর এই জ্বালাতন সহ্য করতাছে। আমার সামনে সেই উদ্ভট পোশাক শার্ট প্যান্ট পইড়া হাজির হইল। আমি লজ্জায় মইরা যাই। তারা ভালো মানুষ দেইখা ওরে ফেরত পাঠায় নাই। এত কিছুর পরও রেহেনা বলে, আমার কেমন জানি মেয়ের লাইগা পরান ছটফট করতাছে। ভালো লাগে না। তুমি দু-এক দিন পর আবার যাও মেয়েটারে কয়েক দিনের জন্য নিয়ে আসো। জাকির হোসেন বলে, না ওরে আনতে চাই না ও যদি পরিবর্তন হয় সেখানেই হইব। রেহেনা অনুনয় করে, তারপরও বাবা-মার কাছে মেয়েটা দুই একদিন আইসা থাক। রাহেলা বলে, বৌমা ওরে আইনা কাজ নেই ও ওইখানে আছে ওইখানেই থাক।

রিফাত স্ত্রী হিসাবে শায়লাকে কখন স্ত্রীর মর্যাদা দেয় না। সব সময় তুই-তোকারি গালাগাল করে। শায়লাকে বলে, তুই আমার মন তখনই পাবি যখন তোর বাপের বাড়ি থাইকা আমার ব্যবসার জন্য টাকা আইনা দিবি। না হইলে অত্যাচার কারে কয় হাড়ে হাড়ে বুঝাইয়া দিমু। শায়লারও জেদ, মরে যাবে তবু বাবার বাড়ি থেকে এক কানা পয়সাও আনবে না। মারতে মারতে শায়লার পিঠে ঘা হয়ে গেছে কিন্তু চিকিৎসা করানো হয় না। শায়লা এমন অবস্থায় বিছানায় পড়ে যায়। ঘা নিয়ে বিছানায় শুতে পারে না। স্বামীকে অনুরোধ করে, আমাকে একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। রিফাত বলে, তোরে নিয়ে যাব ডাক্তারের কাছে? তুই যখন জেদ করছিস বাবার বাড়ি থেকে টাকা পয়সা আনবি না আমিও জেদ করলাম তোকে ডাক্তার দেখাব না। আমি এই অবস্থায় তোমার ঘরের কাজ করব কিভাবে? হাঁটতে না পারিস বসে বসে করবি, বসে না পারোস হামাগুড়ি দিয়ে করবি। তাও সংসারে কাজ করবি। অনাহার অপুষ্টিতে দিন দিন শায়লার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তার খাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, চোখ মেলে তাকাতে পারে না। এই অবস্থায় শায়লা একদিন পানি পানি করছিল। শাশুড়ি গরম পানি এনে মুখে ঢেলে দেয়। শায়লা ছটফট করে আর্তচিৎকার করতে থাকে। মনে হয় সমস্ত শরীর গলে যেন ছিটকে পড়বে চারদিকে। শরীর থেকে মাংস যেন খসে খসে পড়ছে। গরম পানির উত্তাপে শায়লার মুখ কণ্ঠনালী অন্ত্র দগ্ধ হয়ে যায়। শায়লা মা বাবার নাম করে কাতরাতে থাকে।
মায়ের মন সন্তানের কোনো কিছু হলে যেন সাড়া পায়। রেহেনা অস্থির হয়ে ভাবে, আমার এমন লাগছে কেন! আমি শায়লাকে দেখতে যাব। স্বামীকে বলে, তুমি কি শায়লার বাড়িতে নিয়ে যাবা নাকি আমি একাই যাব। স্ত্রীর অস্থিরতা স্বামীকেও উতলা করে। সে বউকে নিয়ে মেয়েকে দেখতে যায়। তার আগেই অভিমানী শায়লার মৃত্যু হয়। শায়লা হয়তো কামনা করেছিল বাবা-মা তার জীবিত নয় মৃত মুখটাই যেন দেখে। শায়লার মৃত্যু তার স্বামীর ঘরেও হয়নি। রান্নাঘরে তার শোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল সেখানেই তার মৃত্যু হয়। চরম অযতœ অবহেলা আর অবিচারে নিভৃতে যবনিকা ঘটে আরেকটি জীবনের।


আরো সংবাদ



premium cement