১৫ মে ২০২৪, ০১ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ০৬ জিলকদ ১৪৪৫
`


সাহিত্য ও রূপবৈচিত্র্যে জসীমউদ্দীন

জন্ম : ১ জানুয়ারি ১৯০৩, মৃত্যু : ১৩ মার্চ ১৯৭৬ -

সাহিত্য সৃষ্টির প্রধান উপাদান প্রাণ-প্রাচুর্য ও অন্তরের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ। যেসব কবি-সাহিত্যিক এ কাজটি সুন্দরভাবে করতে পেরেছেন, তার ভেতরে জসীমউদ্দীন অন্যতম। সাহিত্যকে কতটা সুন্দর, সব মানুষের প্রাণের কাছাকাছি আনা যায়, তা তিনি দেখিয়েছেন। তার লেখা পড়ে কেঁদেছেন এমন অনেকেই রয়েছেন। সত্যিকারের যে দরদ লেখার প্রতি, তা কবি জসীমউদ্দীনের ছিল। বিশেষত গ্রামবাংলার মানুষের দুঃখ-আহাজারি অত্যন্ত প্রাণ-স্পর্শীভাবে ফুটে উঠেছে তার কাব্যগুলোতে।
তার সাহিত্যকর্মের নানা ধরনের রূপ বৈচিত্র্যতা ছিল। বিভিন্ন ধরনের লেখা তিনি লিখেছেন। মূলত কবি কর্মী হয়েও নাটক, উপন্যাস, ভ্রমণ কাহিনী, স্মৃতি কথা প্রভৃতি অত্যন্ত পারদর্শিতার সাথে লিখেছেন। পল্লী জীবন ও প্রকৃতিকে সঙ্গী করে এগোলেও তিনি আধুনিক চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন তার কাব্যগুলোতে রেখেছেন। গদ্য ও পদ্যে নানা আঙ্গিকের প্রয়োগ-নিরীক্ষায় এবং ভাষা ও ছন্দের পরিমার্জনায় তার সদা জাগ্রত কৌতূহলেও আধুনিক মনের প্রক্ষেপ স্পষ্ট বোঝা যায়। পল্লী পথচারী হয়েও বিচিত্র ভঙ্গিতে তিনি হেঁটেছেন কাব্য পথে জসীমউদ্দীন তার কাব্যে আধুনিক জটিল নাগরিক জটিলতাকে স্বেচ্ছায় স্থান দিতে চাননি। তার কাব্য পড়ে অনেকেই এ জন্য এক ধরনের শান্তি লাভ করে। তার কাব্য ও গদ্য সাহিত্যে সহজ কথা সরলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন অত্যন্ত সার্থকভাবে। বিষয় ও ভাবানুগ অপূর্ব ভাষা শৈলী এবং সংবেদনশীলতা কবি হৃদয়ের স্পর্শে সঞ্জীবিত করে পাঠকচিত্তে ঢেউ তুলতে সমর্থ হয়েছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। বাংলার লোক ঐতিহ্য, মিথ, শিল্পকলা, অতীত কাহিনী, রূপকথা সব কিছুই প্রকৃষ্টভাবে তার সাহিত্যে বর্তমান। নানাভাবেই তিনি তার সত্যকে তুলে ধরেছেন। এমনকি জটিল বাস্তব জীবন সমস্যায় বিব্রত চিন্তাক্লিষ্ট আধুনিক মানুষরাও জসীমউদ্দীনের সহজ, অনাড়ম্বর অথচ হৃদয়স্পর্শী ভাষায় রচিত আশ্চর্যরূপে জটিলতামুক্ত লোক জীবন ভাষ্যমূলক-কাব্য কাহিনীকে গ্রহণ করেছেন মুক্ত ও আন্তরিক মনে। এর অর্থ হলো, জসীমউদ্দীনের কাব্য শিল্পের দাবি ও কালের দাবি উভয়ই মেটাতে সমর্থ হয়েছিল বলেই আদরনীয় হয়েছে এরূপ মনে করলে অন্যায় হবে না। তবে এ কথাও সত্য যে, তার পল্লী পরিমণ্ডলেই তিনি স্বচ্ছন্দ-বিহারী, নাগরিক পরিমণ্ডলে তিনি বেশ খানিকটা ম্রিয়মাণ। পল্লীবৃত্তে অবস্থান করে পল্লী রূপের অনুধ্যানেই তিনি খুঁজে পেয়েছেন পরম তৃপ্তি, পরম আশ্বাস। এর বাইরে তিনি সচেতনভাবেই হাঁটতে চাননি। তবে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে জসীমউদ্দীনের সাহিত্যকর্ম আপন সীমিত পরিমণ্ডলেও যে যথেষ্ট বৈচিত্র্যধর্মী, আর ওই কারণেই যে তার শিল্পীসত্তা অনেকটা বিশিষ্ট তা স্বীকার করতে হয়। ভাবনার বৃত্তের সম্প্রসারণ না ঘটিয়েও প্রকাশ কলায় বৈচিত্র্যাশ্রয়ী হয়ে শিল্পী সত্তার সজীবতাকেই তিনি বার বার প্রতিপন্ন করেছেন। জসীমউদ্দীনকে বুঝতে হলে তার বিচিত্র সৃষ্টিকর্মের সাথে আমাদের পরিচয় সাধন প্রয়োজন। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে তার সমগ্র সাহিত্যকর্মকে কয়েকটি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করে রূপ-বৈচিত্র্য নির্দেশ করা যেতে পারে।
১. কাব্য : ক) খণ্ড-কবিতাগুচ্ছ : রাখালী ১৯২৯, বালুচর ১৯৩০, ধানক্ষেত ১৯৩৩, রূপবতী ১৯৪৬, মাটির কান্না ১৯৫৮, হলুদ বরনী, জলের লিখন, ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে, মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো, সুচয়নী ১৯৬১।
খ) কাহিনী কাব্য বা কাব্যোপন্যাস : নকশী কাঁথার মাঠ ১৯২৯, সোজন বাদিয়ার ঘাট ১৯৩৪, সকিনা, মা যে জননী কান্দে ১৯৬৩।
গ) শিশু কবিতা : হাসু ১৯৩৮, এক পয়সার বাঁশী ১৩৫৬ বাং।
ঘ) গীতি মঞ্জুষা : রঙিলা নায়ের মাঝি ১৯৩৫, পদ্মাপার উত্তরাংশ ও গাঙের পার ১৯৬৪।
ঙ) কাব্যানুবাদ : পদ্মা নদীর দেশে।
২. নাটক : বেদের মেয়ে ১৯৫১, মধুমালা ১৯৫১, পল্লী বধূ ১৯৫৬, পদ্মাপার, ১ম অংশ ১৯৫০, গ্রামের মায়া, ওগো পুষ্পধনু।
৩. লোক গল্পের কথকতা : ডালিম কুমার ১৯৫১, বাঙালির হাসির গল্প-১ম খণ্ড ১৯৬০ ও ২য় খণ্ড ১৯৬৪।
৪. স্মৃতি কথা : যাদের দেখেছি ১৯৫২ ঠাকুর বাড়ীর আঙিনায় ১৩৬৮ বাং, জীবন কথা-১ম খণ্ড ১৯৬৪, স্মৃতির পট, স্মরণের সরণী বাহি।
৫. ভ্রমণ-কাহিনী : চলে মুসাফির ১৯৫২, হলদে পরীর দেশে ১৯৬৭, যে দেশে মানুষ বড় ১৯৬৮, জার্মানির শহরে বন্দরে।
৬. উপন্যাস : বোবা কাহিনী ১৯৬৪।
৭. লোকগীতি সংগ্রহ ও সম্পাদনা : জারী গান ও মুর্শীদাগান ১৯৬৮।
এভাবে যে শ্রেণী বিভাগ করা হলো তা যে সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত তা নয়, তবে এরও বিশেষ যৌক্তিকতা ও উপযোগিতা রয়েছে। এর মাধ্যমে সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তু, প্রকৃতি ও প্রকাশ বৈচিত্র্য সম্পর্কে অনেকটা জানা যায়। এর গুণগত দিক ছাড়াও পরিমাণের ও বৈচিত্র্যের দিক সম্পর্কে একটি সুষ্ঠু ধারণা জন্মায়। তিনি পল্লী কবি হলেও কেবল গণ্ডিবদ্ধ পথেই হাঁটেননি, তার রচনাকে বিভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গেছেন। পল্লী জীবন ও পল্লী প্রকৃতি সৃষ্টির প্রয়োজনে তার রচনায় বার বার এলেও নিতান্ত পল্লীনির্ভর ছিলেন না। কাব্যের বিষয়েও নয়, প্রকাশ কলায়ও নয়। পল্লী তার জীবন ও কাব্যের এক নিয়ামক শক্তি, তিনি ক্ষেত্র বিশেষে পরিবেশ নিরপেক্ষভাবে আধুনিক রোমান্টিক কবির মতো নিতান্ত ব্যক্তিগত প্রেম-সৌন্দর্যমূলক ভাবানুভূতি প্রকাশ করেছেন, কোথাও বা যুগমানবের সমস্যা সম্পর্কে সচেতনতা দেখিয়েছেন। পল্লীর বিষয় তার সাহিত্যে প্রাধান্য পেলেও অন্যান্য রূপ বৈচিত্র্যও বিদ্যমান। তার ‘বালুচর’, ‘রূপবতী’, ‘মাটির কান্না’ কাব্যের অনেক কবিতায় তার প্রমাণ মেলে। প্রকাশ কৌশলেও তিনি পল্লী কবিদের ছাড়িয়ে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছেন। পল্লী কবিরা গান রচনা করে বা গাথার আকারে নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করে, সে ক্ষেত্রে জসীমউদ্দীন আধুনিক কবির মতো খণ্ড-কবিতায় বিভিন্ন চিত্র ও ভাবনার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। আবার কাহিনী-কাব্য রচনা করে উপন্যাস ধর্মের সঞ্চার করেছেন। তিনি লোকজীবন থেকে উপাদান নিয়ে ‘লোকনাট্য’ লিখেছেন, উপন্যাসও লিখেছেন গদ্যরীতির আশ্রয়ে। স্মৃতি কথা লিখে আধুনিক মানুষের মতো নিতান্ত ব্যক্তিক কামনা-ভাবনা ও অভিজ্ঞতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন তার রচনায়। কখনো পল্লী প্রচলিত গল্প সরলভাবে বলেছেন, শিশুদের জন্য ছড়া লিখেছেন।
লোক সংস্কৃতির বিষয়কে নিজস্ব বক্তব্যসহ সভ্য সমাজের কাছে তুলে ধরেছেন। জসীমউদ্দীনের কাব্যের ভাব-ভাষা-ছন্দ বিশিষ্ট শিল্প রস নিষিক্ত এবং রূপ বৈচিত্র্যে ভরপুর।
জসীমউদ্দীনের কাব্যের বিভিন্ন শ্রেণী বিভাগ তার বিচিত্রমণ্ডিত শিল্প পরিচয়কেই তুলে ধরেছেন। পল্লীজীবন ও প্রকৃতিকে মূলধন করেও পল্লীগীতি গাথার পুরাতন অথচ সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন রূপে প্রকাশ করতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। পল্লীকবিদের অঙ্কিত চিত্রে নতুন রঙ সংযোগ করাই নয় এবং বহুবিধ বৈচিত্র্যময় পথ তিনি সৃষ্টি করেছেন। তার আপন উদ্ভাবনী ক্ষমতার প্রয়োগ আমরা লক্ষ্য করি। আধুনিক শিক্ষা-দীক্ষায় দীক্ষিত খাঁটি কবিত্ব শক্তির অধিকারী শিল্পীর হাতে পল্লীর বিভিন্ন বিষয়ও যে ঐশ্বর্যময় হতে পারে, তার প্রমাণ কবি জসীমউদ্দীন। মৃতপ্রায় পল্লীজীবনকে তিনি পুনরুজ্জীবিত ও মহিমান্বিত করেছেন। তিনি পল্লীকবি কিন্তু গ্রাম্য কবি নন। তিনি কাব্যের ভেতর পল্লীকে শিল্প মহিমামণ্ডিত করেছেন, তার উপস্থাপনা আধুনিক দৃষ্টিকোণ থেকে অবশ্যই সার্থক। একটি বিশেষ বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন পথে তিনি কাজ চালিয়ে গেছেন। প্রেম- সৌন্দর্য, দুঃখ-কষ্ট, মানসিক ও ব্যক্তিক চিন্তা প্রভৃতি তার সাহিত্য কর্মে বিদ্যমান। বিচিত্র রূপে তিনি আবির্ভূত হন অনেক স্থানেই। একজন পল্লীকবির মাঝেও যে বিশ্বকবি স্থান করে নিতে পারে, তা জসীমউদ্দীনকে প্রত্যক্ষ করলেই বোঝা যায়। তার কাব্য সাহিত্যগুলো বাংলা ভাষার জন্য এক বিরাট ধনভাণ্ডার। শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস, বোধ, অনুভূতি প্রভৃতিকে খুব সুন্দর করে সাজাতে পারেন খুব কমসংখ্যক কবি। কবি জসীমউদ্দীন অত্যন্ত বলিষ্ঠ এবং হৃদয়বৃত্তিক কবি তা সহজেই বলা যায়। এত সহজে মানুষের প্রাণে তিনি স্থান নিতে পারেন এবং তার গ্রহণযোগ্যতা এত চমৎকার যে কল্পনা করাও বেশ দুঃসাধ্য। তিনি চমৎকারভাবে সাবলীল ভঙ্গিতে বিভিন্ন রূপ বৈচিত্র্যের মাধ্যমে বাংলা সাহিত্য সম্ভারকে নিঃসন্দেহে সমৃদ্ধ করেছেন।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল