২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তিন মেয়ে

-

আরশির বিয়ে হয়েছে মাস ছয়েক হলো। এখনো শশুরবাড়ির সবার সাথে সে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে নি। পারবেই বা কিভাবে? উঠতে বসতে শুনতে হয় তাকে রাজ্যের যত খোঁটা। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতে একটু দেরি হলে শাশুড়ির আশ্রাব্য গালিগালাজের শিকার হতে হয় তাকে। মাঝে মাঝে সে ভুলেই যায় যে, সে এ বাড়ির নতুন বউ। আজকেও শাশুড়ি তাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছেন, ‘আহা! মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে বিয়ের পর কত উপঢৌকন-ই-না আসে। আমার হয়েছে রাজ্যের যত পোড়া কপাল। দুটো ফকিন্নি এনে আমি ঘরের ভেতর পুষছি। না আছে এদের কোনো সৌন্দর্য আর না আছে কোনো টাকা-পয়সা। কী দেখে যে এদের আমি ঘরে তুলেছিলাম আমার মাথায়ই আসে না।’ হুট করেই মেজাজ খিঁচড়ে যায় আরশির বর আসিফের। তারপরও যথাসম্ভব নিজেকে ঠাণ্ডা রেখে বলে, ‘দেখ মা! তোমরা নিজেরাই কিন্তু পছন্দ করে আরশিকে এই বাড়ির বউ করে নিয়ে এনেছ, তবে এখন কেন এসব কথা তুলছ। তুমি তো ভালো করেই জানতে, আরশির বাবা একজন গরিব স্কুল মাস্টার। তার কোনো কিছু দেয়ার সামর্থ্য নেই। সবকিছু জানা সত্ত্বেও এ রকম ব্যবহার তোমাকে মানায় না মা।’
সঙ্গে সঙ্গে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন আরশির শাশুড়ি জামিলা বানু। চোখ ছোট ছোট করে দাঁতে দাঁত পিষে বলেন, ‘কালনাগিনী এনেছি আমি এই বাড়িতে। বউ হবার আগেই আমার ছেলের মেজাজ আমার বিরুদ্ধে খিঁচড়ে দিয়েছে। বলি, ও বৌমা! ছেলেকে কি তাবিজ করেছ নাকি? নচেৎ, আমার এত শান্ত-শিষ্ট ছেলেটা মায়ের সাথে এমন আচরণ করছে কেন?’
শাশুড়ির ব্যবহার দেখে পুরোপুরি শকড হয়ে যায় আরশি। একেকটা কথার আঘাত তার বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধছে। নরম তুলতুলে হৃদয় ভেঙে এসপার-ওসপার হয়ে যাচ্ছে।

সারা জীবন বাবার বাড়িতে কষ্ট করে এসেছে। খাওয়া-পরার কষ্ট। এসএসসি পাস করার পর থেকে টিউশনি করে নিজের খরচ নিজে চালিয়েছে। সবাই আরশিকে বলতো, ‘দেখিস মা! তুই এখন কষ্ট করছিস। শশুড়বাড়িতে অনেক সুখে থাকবি। রাজকপাল হবে তোর।’
পুরনো স্মৃতি মনে পড়তেই ডুকরে কেঁদে ওঠে আরশি।
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে টলতে টলতে রান্নাঘরে প্রবেশ করে সে।
রাত বারোটা বাজে। সবাই খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছে নিজেদের মতো। বাকি আছে আরশি আর ওর বড় জা অহনা।
অহনা মিষ্টি হেসে আরশির মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর বলে, ‘বোন আমার, মন খারাপ কোরো না। বিয়ের প্রথম প্রথম শাশুড়ি মা আমার সাথেও এমন আচরণ করতো; কিন্তু আমি কোনো উত্তর দিতাম না। আপনমনে নিজের কাজ করতাম।
খারাপ লাগতো বৈকি! তারপরও ভাগ্যকে মেনে নিয়েছি।’
ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে আরশি। বড় জা অহনাকে জড়িয়ে ধরে আর বলে, ‘বলেন তো ভাবী, এই বাড়িতে কিসের এতো অভাব? প্রত্যেকটা রুমে এসি। চোখ ধাঁধানো টাইলসের কারুকার্য। খাওয়া-পরার কোনো সমস্যা নেই। যে যার মতো চলছে-ফিরছে। শুধু আমাদের কপালই কেন এমন হলো? আমরা বাড়ির বউ হয়েছি বলে? বউদের কি কোনো শখ-আহ্লাদ থাকতে নেই।’
আবারও মিষ্টি হেসে অহনা আরশিকে জড়িয়ে নেয়।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নিচুস্বরে বলে, ‘‘পাগলি মেয়ে! এভাবে বলতে নেই। শুধু স্মরণে রাখবে, ‘যে সহে সে রহে’। আর রিভেঞ্জ অব ন্যাচার বলেও একটা কথা আছে। আজকে যে তোমার সাথে খারাপ করবে, পরবর্তী সময়ে
আল্লাহ তার খারাপ করবেন।’

অহনার বলা কথাগুলো আরশির মন ছুঁয়ে দেয়। মনে মনে ভাবে, ‘আমার চেয়ে খারাপ ভাগ্যও তো কতজনের আছে। আমার তো শুধু শাশুড়ি খারাপ। অন্যদের তো এমনও আছে শশুরবাড়ির সবাই খারাপ হয়।’
এ কথা মনে পড়তেই আরশি দ্রুত বাথরুমে ঢুকে অজু করে নেয়। তারপর জায়নামাজ বিছিয়ে দু’রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করে। মুনাজাতে নিজের সমস্ত ব্যথার কথা মহান রবের কাছে জানায়। শাশুড়ির হেদায়েতের জন্য কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করে।
নামাজ শেষ করার পর আরশির মন কিছুটা হালকা হয়। সে কুরআন শরিফ খুলে তিলাওয়াত করতে থাকে। চোখের অশ্রু বাঁধ মানে না।
আসিফ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে আরশির পানে। নিজেকে বড্ড কাপুরুষ মনে হয় তার। স্ত্রীকে ভালো রাখতে পারছে না সে। বারংবার বুকে ব্যথা ওঠে আসিফের।
দ্রুত বিছানা ছেড়ে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে অজু করে নেয়। তারপর স্ত্রীর পাশে জায়নামাজ বিছিয়ে সেজদায় কান্না করতে থাকে।
আরশির মায়া হয় খুব। কিছুক্ষণ আগেও নিজেকে বড্ড অপয়া মনে হয়েছিল তার। আর এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবান ব্যক্তি হচ্ছে সে। তার জন্য তার স্বামী কাঁদছে। তার সুখের জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছে।
পরদিন সকাল। আরশির শাশুড়ি জামিলা বানু একাধারে প্রলাপ বকছেন।
শাশুড়ির এহেন চেঁচামেচিতে অহনা, আরশি দ্রুত ছুটে আসে শাশুড়ির রুমে।
জামিলা বানু রুদ্রমূর্তি ধারণ করে আছেন। দাঁতে দাঁত পিষে তিনি বলেন, ‘কোন হতচ্ছাড়ি এই নাস্তা বানিয়েছে। একটা পিঠাও মুখে দেয়া যায় না। লোহার মত শক্ত।’

অহনা, আরশি শাশুড়ির মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। ছেলের বউদের এমন পিত্তি জ্বলানো হাসি দেখে জামিলা বানুর রাগ সপ্তমে চড়ে।
রাগের বশে তিনি প্লেট বাটি সব ফ্লোরে ছুড়ে মারেন। গগনবিদারী চিৎকারে ছেলেমেয়েসহ সবাই চলে আসে জামিলা বানুর কক্ষে।
থরথর করে কাঁপছে জাফরিন। মেয়ের এমন কাঁপাকাঁপি দেখে জামিলা বানু মেয়ের কাছে আসেন।
কণ্ঠ খাদে নামিয়ে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কী রে মা! তুই কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলছে তোরে? নিশ্চয়ই বড় বউ, ছোট বউ তোর সাথে খারাপ আচরণ করছে। দাঁড়া! দুইটারে আজকে আমি সুচের মতো সোজা করে দিব।’
জাফরিন কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আম্মা! তুমি ভাবীদের ওপর রাগ কোরো না। আসলে আজকে সকালে পিঠা আমি বানিয়েছি। আমার ইচ্ছে হয়েছিল তাই। ফার্স্ট টাইম বানানোর কারণে পিঠা ভালো হয়নাই। আম্মা, তুমি আমারে মাফ করে দাও।’
মেয়ের কথা শুনে জামিলা বানুর মাথায় বাজ পড়ে। তিনি মেয়েকে উঠিয়ে বলেন, ‘ক্যান, তুই চুলার পাড়ে কেন গেছস? বড় বউ, ছোট বউ থাকতে তুই চুলার পাড়ে যাবি ক্যান! ওরা তোরে ফোর্স করছে?’
জাফরিন বিরক্তি নিয়ে বলে, ‘ছি! মা, তুমি যা ভাবছো এ রকম কিছুই না। আমার দুই ভাবীই অনেক ভালো, সুইট। তুমি শুধু শুধু ওদের সাথে খারাপ আচরণ কর।
একবার ভাবো তো মা, আমাকে যখন বিয়ে দেবে তখন আমার শশুরবাড়ির লোকেরা যদি আমার সাথে খারাপ আচরণ করে তখন তোমার কাছে কেমন লাগবে?’
জামিলা বানু মেয়েকে বলেন, ‘কেন? খারাপ আচরণ করবে কেন? আমার মেয়ে হচ্ছে লাখের মধ্যে একটা। রূপে, গুণে অনন্যা।’
জাফরিন মায়ের কথা থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘মোটেও না মা। আমার যদি এতই গুণ থাকতো তাহলে সামান্য এই পিঠা বানাতে গিয়ে আমার এত হিমশিম খেতে হতো না। ছোটবেলা থেকে আদরে আদরে মানুষ হয়েছি। কখনো কোনো কাজ করতে হয়নি।একটু বড় হবার পর বাড়িতে বড় ভাবী এসেছে। সে-ই সামলিয়েছে সবকিছু। এত বড় বাড়ির কাজ সব ভাবী একা হাতে সামলাতো। আমি যদি কখনো তাকে সাহায্য করতে যেতাম, তুমি আমাকে বকাঝকা করতে। কিন্তু একবার ভেবে দেখ তো মা, আমারও তো বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ি। এখনো কোনো কাজ জানি না। শুয়ে বসে সারা দিন খাচ্ছি। কখনো একটু ভেবে দেখেছো কি? ভাবীরা এত কষ্ট করে এই খাবার রান্না করে, আমরা তো শুধু খেয়েই খালাস। তাদের কোনো খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা অব্দি করি না। আমার সাথেও যদি এমন হয়। প্রকৃতি কখনো ক্ষমা করে না মা।’ গলা কেঁপে ওঠে জাফরিনের। সে ফোঁপাতে থাকে।
আরশি, অহনা ননদের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। আর বলে, ‘পাগলি মেয়ে! তোমাকে এত শত ভাবতে কে বলছে...’ ভাবীদের কথা শেষ হয় না। তার আগেই জামিলা বানু দুই বউকে বুকে জড়িয়ে নেন। আর মুখে বলেন, ‘আজ থেকে আমার তিন মেয়ে। নে জাফরিন, এখন আর মন খারাপ করিস না। একটু হাস।’
মায়ের কথায় সবাই একসাথে উচ্চৈঃস্বরে হেসে ওঠে।


আরো সংবাদ



premium cement
ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশী প্রভুদের দাসত্ব করছে : কাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু সুলতান মাহমুদকে বাঁচাতে সাহায্যের আবেদন গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় নিহত ১৫ মুজিবনগরে ২ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, আহত ১৩ বাগেরহাটের রামপালে ট্রাকের চাপায় নিহত ৩ ফিলিস্তিনের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিশ্ববিদ্যালয় বিক্ষোভে উত্তাল পূর্ব আফ্রিকায় প্রবল বৃষ্টি ও বন্যা, কমপক্ষে ১৫৫ জনের প্রাণহানি সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য প্রচারের নিন্দা ডিআরইউর ভয়াবহ দুর্ঘটনা, অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন উগ্র ইসরাইলি মন্ত্রী শেরে বাংলার সমাধিতে প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন হাত কাটা বন্দীর নেতানিয়াহুর সমালোচনা

সকল