২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সৎ ব্যবসায়ীর মহাপুরস্কার

-

একটি কাজের পুরস্কার যত বড়, বিপরীত দিকে তার শাস্তিও তত বড় হবে-এটিই স্বাভাবিক। কারণ কাজটির ব্যাপক পরিধি, গুরুত্ব ও বিশাল জনসম্পৃক্ততার দিক বিবেচনা করেই বিশেষ পুরস্কারের ঘোষণা করা হয়েছে। বলা হয়েছে- যারা সৎ ব্যবসায়ী তাদের হাশর হবে নবী, সিদ্দিকিন ও শুহাদাদের সাথে। কারণ ব্যবসায়ীরা শুধু ব্যবসাই করেন না; বরং বিশাল জনগোষ্ঠীর নিত্যদিনের মৌলিক চাহিদার জোগান দিয়ে মানবতার সেবা ও কল্যাণে নিয়োজিত আছেন। এখানে ভালো করে মনে রাখতে হবে, ব্যবসায়ীরা নবী, সিদ্দিক ও শহীদদের সাথী হবেন কিসের মানদণ্ডে? কারণ নবীরা এসেছিলেন মানবতাকে কল্যাণের পথ দেখানোর জন্য, সিদ্দিকরা সেই কল্যাণের পথকে সত্যায়ন করেছেন এবং শহীদরা সেই কল্যাণকে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বোচ্চ নজরানা স্বরূপ নিজের জীবনটুকু বিলিয়ে দিয়েছেন। ব্যবসায়ীরা সেই কল্যাণের কাজটিই করেন।
ইসলাম শুধু গোটা মানবসভ্যতার একমাত্র কল্যাণমূলক ধর্মই নয়; বরং দুনিয়া ও আখিরাতের এক বাস্তব সমন্বয় সাধনের নাম ইসলাম। একটি জীবনের দু’টি অধ্যায়। একটি অপরটির পরিপূরক। একটি ছাড়া অন্যটির সফলতা আশা করা ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছু নয়। ইচ্ছা করলেই মানুষ দুনিয়ার জীবন থেকে এক লাফ দিয়ে আখিরাতে পৌঁছে যেতে পারবে না। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদেরকে মুনাজাতের মাধ্যমে শিক্ষা দিচ্ছেন- ‘হে আমার রব! তুমি আমাকে দুনিয়া ও আখিরাতে কল্যাণ দান করো এবং আমাকে দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করো।’ (সূরা বাকারা-২০১) আখিরাতের সফলতা দুনিয়ার কার্যকলাপের ওপর নির্ভরশীল। পৃথিবীর অধ্যায়ে মানুষের বাঁচার জন্য দরকার রিজিক। আর এ রিজিক বনি ইসরাইলকে মান্না-ছালওয়ার মতো নয় যে, আল্লাহ মাঠে-ময়দানে ফেলে রাখবেন আর আমরা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই পেয়ে যাব; বরং পৃথিবীতে সংগ্রাম করে রিজিক আহরণ করতে হবে। রিজিক আহরণের জন্য মানুষ ব্যবসায়-বাণিজ্য, চাকরি করে থাকে। আম্বিয়ায়ে কেরাম, খোলাফায়ে রাশেদিন ও আয়িম্মায়ে মুজতাহিদিন- সবাই ব্যবসার সাথে জড়িত ছিলেন। বৈধ পন্থায় ব্যবসায়-বাণিজ্য করার জন্য ইসলামে বিশেষভাবে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- ‘এরপর নামাজ যখন সম্পূর্ণ হয়ে যায়, তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) সন্ধান করো। আর আল্লাহকে খুব বেশি বেশি স্মরণ করতে থাকো।’ (সূরা আল-জুমা-১০) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আরো বলেন-‘হে ঈমানদাররা! নিজেদের পবিত্র উপার্জন থেকে খরচ করো।’ (সূরা বাকারা-২৬৭) হজরত আয়েশা রা: বর্ণনা করেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাহাবিরা রুজি উপার্জনের জন্য নিজেরাই দৈহিক পরিশ্রম করতেন। এ কারণে তাদের শরীর থেকে ঘামের গন্ধ আসত। তাই তাদের বলা হয়েছিল, তোমরা গোসল করলে ভালো হতো।’ (বুখারি-২০৭১) হজরত আবু হুরায়রা রা: নবী সা: থেকে বর্ণনা করেছেন আল্লাহর নবী ইরশাদ করেন, ‘দাউদ আ: নিজের হাতে কাজ করে উপার্জিত খাদ্য গ্রহণ করে জীবন ধারণ করতেন।’ (বুখারি-২০৭৩) আবু হুরায়রা রা: বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন ‘তোমাদের যেকোনো লোকের জন্য মানুষের কাছে হাত পাতার চেয়ে রশি নিয়ে জঙ্গলে গিয়ে কাঠ সংগ্রহ করে জীবিকা অর্জন করা অনেক ভালো।’ (বুখারি-২০৭৪)
ইসলামের সোনালি যুগে রাষ্ট্রব্যবস্থার সব বিভাগের মতো ব্যবসায়-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও কল্যাণ ও অকল্যাণের বিষয়গুলো খুলে খুলে স্পষ্ট বর্ণনা করা হয়েছে। ব্যবসায় সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আল্লাহ ব্যবসায়কে হালাল করেছেন আর সুদকে করেছেন হারাম।’ (সূরা বাকারা-২৭৫) কিন্তু কালক্রমে ইসলামী সমাজব্যবস্থার অনুপস্থিতির কারণে ব্যবসায় নীতি-নৈতিকতার স্থলে শয়তানের আচরণ বাসা বেঁধেছে। সর্বনাশা এ আচরণগুলো মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে। আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘মানুষের সামনে এমন একসময় আসবে যখন কোনো ব্যক্তি অর্থ উপার্জনে হালাল বা হারাম পন্থায় অর্জিত হচ্ছে কি না এ কথা মোটেই চিন্তা করবে না।’ (বুখারি-২০৮৩) অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন- ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা পরস্পরের ধন-সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। (হ্যাঁ) ব্যবসায়-বাণিজ্য যা করবে তা পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে করবে এবং কখনো (স্বার্থের কারণে) একে অপরকে হত্যা করো না। অবশ্যই আল্লাহ তায়ালা তোমাদের প্রতি অত্যন্ত মেহেরবান।’ (সূরা আন নিসা-২৯)

উল্লিখিত আয়াতে ‘অন্যায়ভাবে’ বলতে এমন সব পদ্ধতির কথা বুঝানো হয়েছে যা সত্য ও ন্যায়নীতি বিরোধী এবং নৈতিক দিক দিয়েও সম্পূর্ণ অবৈধ। আমরা আমাদের ব্যবসায়-বাণিজ্যে যেসব প্রতারণা দেখতে পাই তা অন্যায় ও আল্লাহর রাসূল এগুলো করতে নিষেধ করেছেন। বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্যসহ অন্যান্য জিনিসে ভেজাল মেশানো, মজুদদারির মাধ্যমে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে ফায়দা লুটা, প্রতারণাপূর্ণ দালালির মাধ্যমে উচ্চ দাম হাঁকানো, মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের নিমিত্তে লোভনীয় কৃত্রিম কোনো উপায় অবলম্বন করা, মিথ্যা শপথের মাধ্যমে বিক্রয় করা, বিক্রীত মালামালের দোষত্রুটি গোপন করা, বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে বিশেষত মানুষের দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে ও লোভনীয় মিথ্যা বিজ্ঞাপন প্রচারের মাধ্যমে ব্যবসায় করা, চোরাই ব্যবসা করা, মাপে বা ওজনে কমবেশ করা- ইত্যাদি সব প্রকার কাজ ও কর্ম আয়াতে উল্লিখিত ‘অন্যায়ভাবে’-এর অন্তর্ভুক্ত। মাপে কমবেশি করার জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন- ‘ধ্বংস তাদের জন্য যারা মাপে কম দেয়। তাদের অবস্থা এই যে, লোকদের থেকে নেয়ার সময় পুরো মাত্রায় নেয় এবং তাদেরকে ওজন করে বা মেপে দেয়ার সময় কম করে দেয়। এরা কি চিন্তা করে না, একটি মহাদিবসে এদেরকে উঠিয়ে নেয়া হবে? যে সব মানুষ রাব্বুল আলামিনের সামনে দাঁড়াবে।’ (সূরা আল মুতাফফিফিন : ১-৬)

এ ছাড়া কুরআন মজিদের বিভিন্ন স্থানে ওজনে ও মাপে কম করার কঠোর নিন্দা এবং সঠিকভাবে ওজন ও পরিমাপ করার জন্য কড়া তাগিদ দেয়া হয়েছে। সূরা আনয়ামে বলা হয়েছে- ‘ইনসাফসহকারে পুরো ওজন ও পরিমাপ করো। আমি কাউকে তার সামর্থ্যরে চেয়ে বেশির জন্য দায়িত্বশীল করি না।’ (আয়াত-১৫২) সূরা বনি ইসরাইলে বলা হয়েছে- ‘মাপার সময় পুরো মাপবে এবং সঠিক পাল্লা দিয়ে ওজন করবে।’ (আয়াত-৩৫) সূরা আর রহমানে তাকিদ দেয়া হয়েছে- ‘ওজনে বাড়াবাড়ি করো না, ঠিক ঠিকভাবে ইনসাফের সাথে ওজন করো এবং পাল্লায় কম করে দিয়ো না।’ (আয়াত : ৮-৯) মাপে কমবেশি করার জন্য হজরত শোয়াইব আ:-এর সম্প্রদায়ের ওপর আজাব নেমে এসেছিল।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা: থেকে বর্ণিত- এক ব্যক্তি নবী সা:-এর কাছে বলল যে, ক্রয়-বিক্রয়ে সে প্রতারিত হয়। তিনি বললেন, ‘যখন তুমি খরিদ করবে তখন বলবে, যেন ধোঁকা না দেয়া হয়।’ (বুখারি-২১১৭, ২৪০৭, ২৪১৪, ৬৯৬৪, মুসলিম-১৫৩৩, আহমাদ-৫৪০৫) হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সা:-কে বলতে শুনেছি, ‘মিথ্যা শপথের দ্বারা পণ্যসামগ্রী বিক্রি হয়ে যায় বটে কিন্তু এতে বরকত বা কল্যাণ ধ্বংস হয়ে যায়।’ (বুখারি-২০৮৭, মুসলিম-১৬০৬, আহমাদ-২২৬০১) হজরত উমার রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেছেন, নবী সা: প্রতারণাপূর্ণ দালালি করতে নিষেধ করেছেন। (বুখারি-২১৪২, ৬৯৬৩, মুসলিম-১৫১৬) হাকিম ইবনে হিজাম রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন ‘যতক্ষণ ক্রেতা ও বিক্রেতা ক্রয়-বিক্রয় শেষে পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হবে ততক্ষণ ক্রয়-বিক্রয় বাতিল করার এখতিয়ার থাকে। যদি তারা উভয় সত্য কথা বলে এবং পণ্যের দোষ বর্ণনা করে, তাহলে এ ক্রয়-বিক্রয়ে উভয়কেই বরকত দান করা হয়ে থাকে। কিন্তু যদি মিথ্যা কথা বলে ও দোষ গোপন করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ (বুখারি-২০৮২, ২০৭৯) আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- নবী সা: বলেছেন, ‘তোমরা (বিক্রয়ের আগে) উষ্ট্রী ও বকরির বাঁটে দুধ জমিয়ে রেখো না।’ (বুখারি-২১৪৮, ২১৪০)
লেখক : প্রবন্ধকার


আরো সংবাদ



premium cement
বার্লিনে ফিলিস্তিনিপন্থী ক্যাম্প ভেঙে দিয়েছে জার্মান পুলিশ সেভ দ্য চিলড্রেনে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ বনশ্রীতে কিশোরী গৃহকর্মীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার সৌদি আরবে আরব ও ইইউ কূটনীতিকদের গাজা নিয়ে আলোচনা ইউক্রেনকে দ্রুত প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র দিতে যাচ্ছে পেন্টাগন ডিএমপির অভিযানে গ্রেফতার ৩৯ মিয়ানমারের জাতীয় গ্রন্থাগারে বাংলাদেশ দূতাবাসের বই অনুদান ক্ষমতায় যেতে বিএনপি বিদেশী প্রভুদের দাসত্ব করছে : কাদের ক্যান্সারে আক্রান্ত শিশু সুলতান মাহমুদকে বাঁচাতে সাহায্যের আবেদন গাজার নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরাইলি হামলায় নিহত ১৫ মুজিবনগরে ২ চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের সংঘর্ষ, আহত ১৩

সকল