২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

গজব আসার কারণ

-

আল্লাহ তায়ালা মানবজাতি সৃষ্টি করে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে ভূষিত করেছেন। সৃষ্টির সেরা জীব যদি তার মালিককে ভুলে যায় এবং তাঁর আদেশ-নিষেধ অমান্য করে, তাহলে তার মালিক তার প্রতি শুধু অসন্তুষ্টই হন না, বরং তাকে শাস্তি দিতে বাধ্য হন। তবে আল্লাহ তায়ালা যেহেতু অতিশয় মেহেরবান ও দয়াময়, তাই তিনি তাৎক্ষণিক শাস্তি প্রয়োগ করেন না। তিনি অবকাশ দিয়ে, তাওবা করে ফিরে আসার সুযোগ দেন। আমাদের প্রিয়নবী সা: আল্লাহ তায়ালার কাছে এ দোয়া করেছিলেন যে, তাঁর উম্মতকে যেন আগেকার উম্মতের মতো শাস্তি তথা মানবাকৃতিকে বানর, শূকর ইত্যাদির আকৃতিতে রূপান্তর, পাথরের বৃষ্টি, ভূমি উল্টিয়ে দেয়ার মতো কঠিন প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিনষ্ট করা না হয়।
আল্লাহর গজব নাজিল হওয়ার কিছু কারণÑ
১. হত্যাযজ্ঞ বৃদ্ধি পেলে : অন্যায়ভাবে হত্যা করা কবিরা গুনাহ। আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোনো মুমিনকে হত্যা করে, তার শাস্তি হলো জাহান্নাম, সে সদা সেখানে অবস্থান করবে।’ (সূরা নিসা-৯৩) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘আমার পরে তোমরা পরস্পরকে হত্যাকারী কাফেরদের মতো হয়ে যেও না।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘অবৈধ হত্যাকাণ্ড না ঘটানো পর্যন্ত বান্দার আর সব গুনাহ মাফ হওয়ার অবকাশ থাকে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘কিয়ামতের দিন সবার আগে হত্যার বিচার করা হবে।’ তিনি আরো বলেছেন, ‘আমার কাছে কোনো মুমিনের হত্যাকাণ্ড সমগ্র পৃথিবীর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার চেয়েও মারাত্মক।’ রাসূলুল্লাহ সা: অন্যত্র ইরশাদ করেন, ‘তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক বিষয় থেকে দূরে থাকবে। সাহাবিরা জিজ্ঞাসা করলেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ! বিষয়গুলো কী কী? রাসূলুল্লাহ সা: বললেনÑ ১. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করা; ২. জাদুটোনা করা; ৩. যথাযথ কারণ ছাড়া কাউকে হত্যা করা, যা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন; ৪. সুদ খাওয়া; ৫. এতিমের সম্পদ গ্রাস করা; ৬. রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা ও ৭. মুসলিম সরলা নির্দোষ মহিলাদের নামে ব্যভিচারের দুর্নাম রটনা করা।’ (সহিহ বুখারি : ২৭৬৬)
মহানবী সা: বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তি মুসলমানদের সাথে শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ কোনো অমুসলিমকে হত্যা করে, তাহলে সে জান্নাতের ঘ্রাণও পাবে না। অথচ জান্নাতের সুঘ্রাণ ৪০ বছরের দূরত্ব থেকেও পাওয়া যায়।’ (ইবনে মাজাহ-২৬৮৬)
২. দুনিয়াপ্রীতি বৃদ্ধি পেলে : মুমিন দুনিয়ার ওপর আখিরাতকে অধিক ভালোবাসে। সাহাবায়ে কিরাম দুনিয়ার চেয়ে আখিরাতকে প্রাধান্য দিতেন এবং দ্বীনের জন্য মরণকে বেশি পছন্দ করতেন। রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেনÑ আমার উম্মতের ওপর এমন দুঃসময় আসবে, যখন অন্যান্য জাতি তোমাদের ওপর এমনভাবে ঝাঁপিয়ে পড়বে যেন ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। একজন সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সা:! তখন কি আমরা সংখ্যায় কম হবো? রাসূলুল্লাহ সা: বলেন ‘না, বরং তোমরা সংখ্যায় অনেক হয়েও বন্যার ফেনার মতো ভেসে যাবে। দুশমনদের অন্তর থেকে তোমাদের ভয়ভীতি ও প্রভাব-প্রতিপত্তি উঠে যাবে। তোমাদের অন্তরে ওহান (কাপুরুষতা) সৃষ্টি হবে।’ একজন সাহাবি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ওহান কী? রাসূল সা: বললেন, ‘দুনিয়ার মহব্বত ও মৃত্যুর ভয়।’ (আবু দাউদ) রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘চারটি বিষয় ক্ষতিকরÑ ক. চোখ নষ্ট হওয়া; খ. কলব শক্ত হওয়া; গ. দীর্ঘ আশা করা ও ঘ. পার্থিব লোভ।
৩. পাপের সীমা ছাড়িয়ে গেলে : পাপের সীমা ছাড়িয়ে গেলে, তখনই তাদের প্রতি আল্লাহর শাস্তি নাজিল হয়। পাপিষ্ঠ ফেরাউনকে আল্লাহ তায়ালা তখনই ধরেছেন, যখন সে পাপের সীমা ছাড়িয়ে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করেছে। আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হে মূসা! তুমি ফেরাউনের কাছে যাও, সে অত্যন্ত উদ্ধত হয়ে গেছে।’ (সূরা ত্বাহা-২৪) আল্লাহ তায়ালা নমরুদকে তখনই শাস্তি দিয়েছেন, যখন সে নিজেকে প্রভু বলে দাবি করেছে। অনুরূপভাবে আদ, সামুদ প্রভৃতি জাতিকে তাদের সীমাহীন পাপাচারের কারণে ধ্বংস করে দিয়েছেন। বনি ইসরাইলরা আল্লাহর কিতাব তাওরাতকে অস্বীকার, উত্তম জিনিস তথা মান্না ও সালওয়ার পরিবর্তে ভূমির উৎপন্ন জিনিস চাওয়া, আমালেকা সম্প্রদায়ের সাথে যুদ্ধ করতে অস্বীকৃতি জানানোর কারণে চির লাঞ্ছনা ও আল্লাহর ক্রোধে পতিত হয়েছে।
৪. বিধর্মী কার্যকলাপ বৃদ্ধি পেলে : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন সরকারি মালকে নিজের মাল মনে করা হয়, আমানতের মালকে নিজের মালের মতো ব্যবহার করা হয়, জাকাতকে জরিমানা মনে করা হয়, ইসলামী আকিদাবর্জিত বিদ্যা শিক্ষা করা হয়, পুরুষ স্ত্রীর অনুগত হয়, মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়, বন্ধুদের আপন মনে করা হয়, বাবাকে পর ভাবা হয়, মসজিদে শোরগোল করা হয়, পাপি লোক গোত্রের নেতা হয়, অসৎ ও নিকৃষ্ট লোক জাতির চালক হয়, ক্ষতির ভয়ে কোনো লোককে সম্মান করা হয়, গায়িকা ও বাদ্যযন্ত্রের প্রচলন অধিক হয়, মদ্যপানের আধিক্য ঘটে, পরবর্তী সময় লোকেরা পূর্ববর্তী লোকদের বদনাম করতেন যেন তারা অপেক্ষা করে লু হাওয়া (গরম বাতাস), ভূমিকম্প, ভূমিধস, মানব আকৃতি বিকৃতি, শিলাবৃষ্টি, রক্তবৃষ্টি ইত্যাদি কঠিন আজাবের, যা একটার পর আরেকটা আসতে থাকবে, যেমন হারের সুতা ছিঁড়ে গেলে মুক্তার দানাগুলো একটার পর একটা পড়তে থাকে।’ (তিরমিজি)
৫. ব্যভিচার, মাপে কম দেয়া ইত্যাদি অপকর্মের ফলে : রাসূলুল্লাহ সা: মুহাজিরদের উদ্দেশ করে বলেছেন, ‘পাঁচটি মন্দকাজ এমন আছে, যদি তোমরা তাতে জড়িয়ে পড়ো বা তা তোমাদের মধ্যে বাসা বাঁধে, তবে খুবই খারাপ পরিণতির সম্মুখীন হবে। আমি আল্লাহর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি যেন এ পাঁচটি মন্দকাজ তোমাদের মধ্যে জন্ম না নেয়।’
ক. ব্যভিচার যদি কোনো সম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তাদের মধ্যে এমন এমন রোগ দেখা দেবে, যা আগে ছিল না। খ. মাপে কম দেয়া। এ মন্দ কাজ যদি কোনো জাতির মধ্যে জন্ম নেয়, তবে তাদের মধ্যে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং তারা অত্যাচারী শাসকের শিকারে পরিণত হয়। গ. জাকাত না দেয়া। এ মন্দ কাজ যাদের মধ্যে দেখা দেয়, তাদের ওপর আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ বন্ধ হয়ে যায়। যদি সে অঞ্চলে পশু বা পাখি না থাকত, তবে আদৌ বৃষ্টি হতো না। ঘ. আল্লাহ ও রাসূলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা। এ মন্দ কাজ যখন সমাজে দেখা দেয়, তখন আল্লাহ তায়ালা তাদের ওপর অমুসলিমদের আধিপত্য চাপিয়ে দেন। আধিপত্যবাদীরা তখন মুসলমানদের সহায়-সম্পদ কেড়ে নেয়। ঙ. কিতাব অনুযায়ী শাসনকার্য পরিচালনা না করা : ‘যদি মুসলমান শাসকরা আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী শাসনকার্য না চালায়, তবে আল্লাহ তায়ালা মুসলিম সমাজে ভাঙন সৃষ্টি করে দেন। তারা নিজেদের মধ্যে পরস্পর লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে এবং সমাজে সন্ত্রাস ও খুন-খারাবি শুরু হয়ে যায়।’ (বায়হাকি, ইবনে মাজাহ, হাদিস-১০১৯)
৬. অন্যায় কাজে বাধা না দেয়ার ফলে : সৎ কাজের আদেশ এবং অসৎ কাজে বাধা দেয়া ফরজ। মুমিন এ কাজ থেকে বিরত থাকতে পারে না। হজরত হুজাইফা রা: থেকে বর্ণিতÑ মহানবী সা: বলেছেন, যার হাতে আমার প্রাণ নিবদ্ধ তাঁর শপথ! তোমরা অবশ্যই ন্যায় কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায় কাজ থেকে (মানুষকে) বিরত রাখবে। অন্যথায় আল্লাহ তাঁর পক্ষ থেকে তোমাদের ওপর আজাব পাঠাবেন। অতঃপর তোমাদের পরিত্যাগ করা হবে এবং তোমাদের দোয়াও কবুল করা হবে না।’ (তিরমিজি)
৭. ধনীরা কৃপণ হলে : রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘যখন তোমাদের উত্তম লোকরা তোমাদের নেতা (রাষ্ট্রপ্রধান) হয়, ধনীরা দানশীল হয় এবং রাষ্ট্রীয় কার্যাবলি পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পাদিত হয়, তখন তোমাদের জন্য জমিনের নি¤œভাগ থেকে জমিনের উপরিভাগ উত্তম। আর যখন তোমাদের মধ্যে ধনী লোকরা কৃপণ হয়, কার্যাবলি মহিলাদের নির্দেশমতো চলে, তখন তোমাদের জন্য জমিনের উপরি ভাগ থেকে জমিনের নি¤œভাগ উত্তম।’ (জামে তিরমিজি, পৃষ্ঠা-৪৫৯)
লেখক : প্রধান ফকিহ, আল জামেয়াতুল ফালাহিয়া কামিল মাদরাসা, ফেনী


আরো সংবাদ



premium cement