২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইরাকের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার অবসান হবে কবে?

-

ইরাকের মনোনীত নতুন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ তৌফিক আলাবি এক মাস ধরে একটি নতুন সরকার গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়ে সফল না হওয়ায় পদত্যাগ করেছেন। তিনি সরকারের প্রতি পার্লামেন্টের অনুমোদন লাভের জন্য বারবার উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর শেষ পর্যন্ত পদত্যাগে বাধ্য হন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো পার্লামেন্ট অধিবেশন বর্জন করার কারণে কোরাম সঙ্কট তীব্র হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পার্লামেন্ট অধিবেশনের আয়োজন করাটা কঠিন হয়ে পড়ে। এক টুইট বার্তায় আলাবি অভিযোগ করেন, ‘কিছু নির্দিষ্টসংখ্যক পার্লামেন্ট সদস্য তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তারা কয়েক মাস ধরে চলা রাজনৈতিক সঙ্কটকে দীর্ঘায়িত করেছেন।
বর্তমানে ইরাকে তিনটি পৃথক আন্তঃবিরোধ চলছে। দেশটির রাজনৈতিক শৃঙ্খলার প্রতি সবচেয়ে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনগণের অসন্তোষ ও জনপ্রিয় বিক্ষোভ। গত অক্টোবর থেকে ইরাকের প্রধান শহরগুলোতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। দেশটির দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতেই এই বিক্ষোভ চলছে। বিক্ষোভকারীদের বেশির ভাগই হচ্ছে বয়সে তরুণ। তারা দুর্নীতি নির্মূল করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ভিত্তিতে একটি নতুন প্রশাসন গড়ে তোলার দাবিতে সোচ্চার। নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ আলাবিকে নিয়োগ দেয়ার প্রতিবাদে ইরাকে নতুন করে সহিংসতা শুরু হয়। রাজধানী বাগদাদসহ দেশটির বড় শহরগুলোতে নয়া প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কয়েক হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। উল্লেখ্য, অব্যাহত বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী আদিল আবদুল মাহাদির পদত্যাগের পর নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ আলাবিকে নিয়োগ দেয়া হয়। আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, নতুন প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে তাদের কোনো দাবিই পূরণ হবে না। তাদের মতে, সঙ্কট সমাধানে তার কোনো যোগ্যতা নেই। বিক্ষোভকারীরা বলেন, আমরা এমন একজন প্রধানমন্ত্রী চাই যিনি স্বাধীন। ইরাকে ইতোমধ্যে প্রায় ৬০০ প্রতিবাদকারীকে হত্যা করা হয়েছে এবং সহিংসতায় আরো কয়েক হাজার প্রতিবাদী আহত হয়েছেন। ইরাকের বিভিন্ন রাজনৈতিক উপদলের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও ক্ষমতার লড়াই চলছে। তাদের প্রধান লক্ষ্য হলো ক্ষমতা দখল করা। ইরান এবং যুক্তরাষ্ট্র উভয়ে ইরাকে তাদের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য প্রাণপণ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক শক্তি এবং স্থানীয় সম্পদের মাধ্যমে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা চালাচ্ছে। আর ইরান তাদের শক্তিশালী শিয়া মিলিশিয়াদের মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। জানুয়ারির প্রথম দিকে মার্কিন হামলায় ইরানের শীর্ষ জেনারেল কাসেম সুলাইমানি এবং পপুলার মোবিলাইজেশন ইউনিটের (বিএমইউ) নেতা আবু মাহদি আল মোহানদিস নিহত হওয়ার পর উভয়পক্ষ ইরাকে প্রভাব বিস্তারের ব্যাপারে মরিয়া হয়ে প্রয়াস চালাচ্ছে। এই তিনটি প্রতিযোগী শক্তির স্বার্থ ও দাবির মধ্যে সমঝোতা না হলেÑ অদক্ষ ও অযোগ্য লোকেরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সেখানে অরাজকতা সৃষ্টি করে ইরাকের রাজনৈতিক পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটাবে। ইতোমধ্যেই তারা আলাবির নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রচেষ্টাকে ভণ্ডুল করে দিয়েছে। বিক্ষোভকারীরা দেশের রাজনীতি দ্বারা কলুষিত নন এমন একজন পরিচ্ছন্ন ব্যক্তি, যিনি আগে দায়িত্বে ছিলেন না এবং যিনি কেবল ইরাকি নাগরিক অন্য কোনো দেশের নাগরিকত্ব যার নেই, এ রকম একজন ব্যক্তিকেই প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিতে চান। তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সব বিবেচনায় আলাবি ব্যর্থ। কারণ তার ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আছে এবং তিনি দু’বার মন্ত্রী ছিলেন। তবে আলাবি বিক্ষোভকারীদের একটি প্রধান দাবি মেনে নিয়ে নিরপেক্ষ এবং টেকনোক্র্যাট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। তিনি বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরের লোকদের নিয়ে এবং কমিউনিটিভিত্তিক কোটা ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বের বাইরে গিয়ে এই মন্ত্রিসভা গঠন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বর্তমান পার্লামেন্ট সদস্যদের মধ্য থেকে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক বিরোধিতার সম্মুখীন হন। সুন্নি ও কুর্দি দলগুলো মনে করে তারা বর্তমান কোটা ব্যবস্থার মাধ্যমে লাভবান হচ্ছে। তাই তারা কোটা ব্যবস্থা ত্যাগ করতে অস্বীকৃতি জানান। দু’টি প্রধান শিয়া দল মোকতাদা আল সদরের সাইরোন জোট এবং হাদি আল আমিরির ফাত্তাহ ব্লক আলাবিকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করলেও পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ব্যাপারে আলাবির প্রচেষ্টা সফল করার ব্যাপারে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়নি। আল সদরের ভূমিকা ছিল রহস্যজনক। তিনি বাগদাদের রাজপথের বিক্ষোভকারীদের সমর্থনে আলাবির প্রধানমন্ত্রী প্রার্থিতার পক্ষে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেন। আবার ২৬ জানুয়ারি তিনি বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে তার লোকদের ক্ষেপিয়ে তোলেন এবং তাদের তাঁবুতে অগ্নিসংযোগ করে এবং তাহরির স্কোয়ারে হামলা চালিয়ে সেটি দখল করে নেন। অথচ আগে আল সদর প্রতিবাদকারীদের সমন্বিত সংস্কারের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়েছিলেন।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সোলাইমানি এবং আল মোহানদিসের মৃত্যু ইরাকি শিয়া মিলিশিয়াদের মধ্যে নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি করেছে। আল সদর এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে তার নিজের পরিচিতিকে নিশ্চিত করে বিক্ষোভকারীদের হটিয়ে দিয়ে মিলিশিয়াদের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন এবং ইরাকের ব্যাপারে অপ্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে নিজেকে জাহির করেন।
আলাবি যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরানের চাপের মুখে ছিলেন। আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও আলাবিকে তার মন্ত্রিসভায় শিয়া, সুন্নি এবং কুর্দি প্রতিনিধিত্বের একটি যথাযথ ভারসাম্য করে সুন্নি ও কুর্দিদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি আলাবিকে এটিও পুনরায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন যে, মার্কিন কূটনীতিক, সৈন্য এবং আমেরিকার স্বার্থ রক্ষা করার ব্যাপারে ইরাক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অপর দিকে, ইরানপন্থী ফাতাহ ব্লক আলাবিকে ইরাক থেকে মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহারের জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করার আহ্বান জানিয়েছিল।
আলাবির সরকার গঠনের উদ্যোগ ব্যর্থ হওয়ায় এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, তিনি চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার যোগ্য নন। ইরাকে বিভিন্ন গোষ্ঠীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এবং বাইরের চাপ সহ্য করে সরকার পরিচালনা করার মতো শক্তি ও সামর্থ্য তার নেই। আল সদরের বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালিয়ে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দিলেও প্রকৃত ব্যাপার হচ্ছে তারা দমে যায়নি।
ইরাকের রাজনীতিবিদরা দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন টিকিয়ে রাখতে তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখে দেশকে অনিশ্চয়তার পথে ঠেলে দিলেও দেশটির নতুন প্রজন্ম জেগে উঠেছে। দেশটির যুব সমাজের মধ্যে জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় পরিচিতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে দুর্নীতিমুক্ত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা নতুন করে গড়ে তোলার যে স্বপ্ন অভিনিবেশ তৈরি হয়েছে সেটির দীর্ঘমেয়াদি ফল দেশবাসী একদিন পাবে বলে পর্যবেক্ষক মহল মনে করে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement