২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক’ মুশফিকুর রহিম

মুশফিকুর রহিম - ছবি - ইএসপিএন

বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যান ৬০ বলে ১০০ রান তুলছে এটা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও দেখা যায় না, মুশফিকুর রহিম সেই কীর্তি গড়েছেন ওয়ানডে ক্রিকেটে!

আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে দ্রুততম সেঞ্চুরির রেকর্ড গড়েছেন এই অভিজ্ঞ উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান।

মুশফিকুর রহিমের রেকর্ড গড়া দিনে বাংলাদেশও গড়েছে দলীয় সর্বোচ্চ ওয়ানডে স্কোরের রেকর্ড।

বাংলাদেশের ক্রিকেটে দ্রুততম ওয়ানডে সেঞ্চুরির মালিক এখন মুশফিক, এর আগে সাকিব ৬৩ বলে করেছিলেন সেঞ্চুরি।

সোমবার বিকেলে মুশফিকুর রহিম কেবল সেঞ্চুরিই করেননি, একটি বার্তাও দিয়েছেন যে এখনই ফুরিয়ে যাননি তিনি।

বাংলাদেশের একাদশে এখন ‘প্রতিযোগিতা’
বৃষ্টির কারণে পরিত্যক্ত এই ম্যাচের পরে লিটন দাস সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে নিজের বিস্ময়ের কথা বলেন।

‘সত্যি বলতে আমি যত দিন খেলছি, বাংলাদেশের কেউ শেষের দিকে নেমে এভাবে সেঞ্চুরি করেননি।’

লিটন দাস মনে করেন, মুশফিকের কারণেই প্রথম ওয়ানডেতেও ৩০০ এর বেশি রান হয়েছে, দ্বিতীয় ওয়ানডেতে হলো ৩৪৯।

প্রথম ওয়ানডেতে মুশফিকুর রহিম তুলেছিলেন ২৬ বলে ৪৪ রান।

ভারতের ক্রিকেট বিশ্লেষক অর্নব চোপড়া তার বিশ্লেষণে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ দলে বহু বছর ধরে যে ব্যাপারটি মিসিং ছিল সেটা হলো দলগত পারফরম্যান্স।’

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল অনেক সময়ই ব্যক্তিগত নৈপূণ্যে জয় পায়, কখনো সাকিব আল হাসান একাই ব্যাট হাতে রান ও বল হাতে উইকেট তুলে নেন, কখনো তাসকিন আহমেদের দুর্দান্ত কোনো স্পেল কখনো বা আফিফ-মিরাজের দৃঢ়তা।

কিন্তু ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজ থেকেই ব্যক্তিগত অর্জনের চেয়ে দলীয় সমন্বয় চোখে পড়ছে।

অর্ণব চোপড়ার মতে, ‘তিনজন ব্যাটসম্যানের ৭০ এর ওপর রান একজনের সেঞ্চুরি আরো একজনের ৪৯। এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটে বিরল। প্রত্যেকের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা আছে।’

এই বছর ভারতের মাটিতে হবে ক্রিকেট বিশ্বকাপ, এখানে খেলার জন্য মুখিয়ে থাকবেন যেকোনো ক্রিকেটার।

‘বিশ্বকাপের বছর সুযোগ পেলে এভাবেই খেলতে হবে, এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যও ইতিবাচক,’ বলেছেন অর্নব চোপড়া।

মুশফিক যে রান করেননি এমন নয়। কিন্তু ৯০-১০০ বলে ৬০ বা ৭০ রানের ইনিংস অনেক সময়ই দলের জন্য খুব একটা কাজে আসে না।

এই জায়গাটায় পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল, মুশফিক সেই চেষ্টাই করছেন।

মুশফিকুর রহিমের ব্যাটিং পজিশনে পরিবর্তন
মুশফিকুর রহিম ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ৯ নম্বরে ব্যাট করে, যেখানে সাধারণ বোলাররা ব্যাট হাতে নামেন।

কিন্তু বেশিদিন লাগেনি মুশফিকের লোয়ার অর্ডার থেকে টপ অর্ডারে উঠতে।

ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচ ইনিংসের মধ্যেই তিনে নামার সুযোগ পেয়ে ফিফটি করেন মুশফিকুর রহিম।

এরপর ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের স্মরণীয় জয়ে মুশফিক ৫৬ রানের একটি অপরাজিত ইনিংস খেলেছিলেন তিনে নেমে।

যদিও মুশফিকের ব্যাটিং অর্ডার তখনো ছিল অনিয়মিত।

ক্যারিয়ারের শুরুর সাত, আটেও ব্যাট করেছেন মুশফিকুর রহিম। কিন্তু টপ অর্ডারে খেলে তিনি সফল হয়েছেন।

কেবলমাত্র উইকেটকিপার মুশফিক থেকে ব্যাটসম্যান মুশফিকুর রহিম হয়ে ওঠার যাত্রায় প্রথমে পাঁচে নিয়মিত হন মুশফিক এরপর ২০০৯ সাল থেকে ছয় নম্বরে ব্যাট করা শুরু করেন মুশফিকুর রহিম।

টানা তিন বছর মুশফিকুর রহিম ছয় নম্বরে ব্যাট করে ৩৭টি ইনিংস খেলেন রান তোলেন আটশোর মতো, গড় ছিল ২৮।

এই সময়ে চারটি ফিফটি তোলেন মুশফিক।

মুশফিকুর রহিম ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি পান ২০১১ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে চার নম্বরে ব্যাট করে, তখন থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেটে দুই উইকেট গেলেই মুশফিকুর রহিম নামা শুরু করতেন।

যা এই আয়ারল্যান্ড সিরিজ শুরু হওয়া অব্দি চলেছে, এই সময় বিশেষ পরিস্থিতি বাদে মুশফিক চারেই খেলেছেন টানা ১২ বছর।

মুশফিকুর রহিম ক্যারিয়ারের সবচেয়ে ভালো সময়টা চার নম্বরেই কাটিয়েছেন, তার নামের পাশে যত রেকর্ড যত সংখ্যা সবই এসেছে এই ব্যাটিং পজিশনে ব্যাট করে।

এক শ’রও বেশি ইনিংস ব্যাট করে তিনি চার হাজারের বেশি রান তুলেছেন প্রায় ৪৪ গড়ে, স্ট্রাইক রেটও ছিল তুলনামূলক ভালো, ৮৩।

মুশফিকুর রহিম চার নম্বরে ব্যাট করে আটটি সেঞ্চুরি, ২৮টি হাফ সেঞ্চুরি তুলে নিয়েছেন।

তিনি তার নবম সেঞ্চুরিটি করেছেন সোমবার, এ সেঞ্চুরিটিই মুশফিকের বদলে যাওয়ার একটা ইঙ্গিত।

এর আগে ২০১১ সালে চারে নেমে সেঞ্চুরি করে নিজের জায়গা পাঁকা করেছিলেন, এবারে দলে জায়গা পাঁকা করছেন ছয়ে নেমে সেঞ্চুরি করে।

কারণ চার নম্বরে মুশফিকের সাম্প্রতিক বছরগুলো ততটা ভালো যায়নি, যতটা তার কাছ থেকে প্রত্যাশা ছিল।

রানের চেয়েও বেশি ভাবনার বিষয় ছিল মুশফিকুর রহিমের রান তোলার গতি।

আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটে এটা একটা চিন্তার বিষয়।

তাই মুশফিক যখন রানের গতি বাড়ালেন এবং সফল হলেন, বাংলাদেশ পরপর দুই ম্যাচে নিজেদের সর্বোচ্চ ওয়ানডে রানের রেকর্ডও গড়লো।

গত চার বছরে সাতটি ইনিংসে মুশফিক ১০০ বেশি স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করেছেন, যার মধ্যে শেষ দুই ইনিংসেই দুই বার ছয় নম্বরে নামার পর।

মুশফিকুর রহিম ব্যাটিংয়ে পরিবর্তন এনেছেন
ক্রিকেট বিশ্লেষক ও ঘরোয়া ক্রিকেটার সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামির মতে, মুশফিক টেকনিকের দিক থেকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দৃঢ় ব্যাটসম্যান।

এই বিশ্লেষকের মতে, বিশ্বকাপের বছর তাই সিনিয়র ক্রিকেটারদের এমন পারফরম্যান্স প্রয়োজন একই সাথে সিনিয়র ক্রিকেটার ও তারুণ্যের যে মিশেল এখন দেখা যাচ্ছে এটা দরকার ছিল।

তৌহিদ হৃদয় যেমন এসেই পাঁচ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছেন।

সৈয়দ আবিদ হুসেইন সামির মতে, ‘টেকনিকে কোনো সমস্যা না থাকলেও মুশফিকের বাস্তবায়নে খানিকটা গড়মিল হচ্ছিল যে কারণে মুশফিক ঠিক আগের মতো পারফর্ম করতে পারছিলেন না। এবারে মুশফিক বাস্তবায়ন করে আগ্রাসী ও আক্রমণাত্ম ব্যাটিং করতে পারছেন।’

৬০ বলে ১০০ রানের ইনিংসে মুশফিকুর রহিম স্কুপ শট খেলেছেন উইকেটকিপারের মাথার ওপর দিয়ে, ইনসাইড আউট খেলেছেন হাঁটু গেড়ে, উইকেটের চারিপাশে সাচ্ছন্দ্যে ব্যাট চালিয়েছেন।

এটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই ইতিবাচক বলে মনে করেন আবিদ হুসেইন।

মুশফিকুর রহিম বা মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের মতো ক্রিকেটারদের জন্য এই বছরটা গুরুত্বপূর্ণ।

একদিকে বিশ্বকাপ অন্যদিকে দুজনই ৩৬ বছর পার করে ফেলেছেন, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের টি-টোয়েন্টি দল থেকেও বাদ পড়েছেন সম্প্রতি।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement