২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সোনারগাঁওয়ের কারুশিল্প মেলা ছুটির দিনে জমে উঠেছে

ছুটির দিনে সোনারগাঁওয়ে কারুশিল্প মেলায় দর্শনার্থীদের ভিড় : নয়া দিগন্ত -


নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে মাসব্যাপী লোক কারুশিল্প মেলা ও লোকজ উৎসব জমে উঠেছে। সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের বিশাল চত্বর জুড়ে বসেছে এ মেলা। ফাউন্ডেশনই এ মেলার আয়োজন করেছে। গতকাল শুক্রবার দুপুর থেকে ক্রেতা-দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়। সন্ধ্যার পর এ ভিড় আরো বাড়ে। চলে দোকানে দোকানে কেনাবেচা। এ দিকে লোকজ মেলাকে কেন্দ্র করে আশপাশের সড়কগুলোতে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। যানজট নিরসনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হিমশিম খেতে হয়েছে।
দেশের কৃষিজীবী সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতি থেকে উৎসরিত লোক ও কারুশিল্পের ঐতিহ্যকে তুলে ধরার লক্ষ্যে এ বছর গত ১৮ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে মাসব্যাপী এ মেলা। প্রতি বছরই এ মেলার আয়োজন করে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন। এবারের মেলাও ভিন্নতায় এনেছে মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান। মেলায় শুধুই লোকজ ঐতিহ্যের পণ্য নিয়ে সাজানো হয়েছে। লোকজ কারুপণ্য ছাড়া অন্য কোনো কিছুই প্রদর্শন ও বিক্রি হবে না। নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর তাঁতশিল্প থেকে শুরু করে সোনারগাঁওয়ের হাতি ঘোড়া, জামদানি, রাজশাহীর শখের হাড়ি, বাঁশবেত, সোনারগাঁওয়ের দারুশিল্প, নকশী কাঁথা, টেপা পুতুল, সিলেট ও মুন্সীগঞ্জের শীতলপাটি, কিশোরগঞ্জের মৃৎশিল্প, মাগুরার শোলা শিল্প সবই আছে এই মেলায়।


গতকাল শুক্রবার মেলা এলাকায় সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে মেলা চত্বরে দর্শনার্থীর ঢল। সোনারগাঁওয়ে ভ্রমণে বা পিকনিকে এসে অনেকে মেলাকে বাড়তি পাওনা হিসেবে কথা বলছেন অনেকেই। ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে পিকনিকে আসা মিতুল, রকিব, আসমা, দোলন, রিতু, শিশির, নাদিয়া পল্লব, রায়হানসহ একদল দশনার্থী জানান, এখানে পিকনিকে এসে সোনারগাঁওয়ের ইতিহাস-ঐতিহ্য দেখার পাশাপাশি বাড়তি পাওয়া হিসেবে বাংলার হারিয়ে যাওয়া কারুশিল্প মেলাটি উপভোগ করলাম। নরসিংদীর বেলাবো থেকে আসা শিক্ষার্থী তনয়, মতিন, রাতুল জানায়, এক সময় গ্রাম বাংলায় তৈজসপত্র হিসেবে ব্যবহার হতো হাড়ি পাতিল, ঢুলা, ওসা, মাইট, মাছ ধরার চাই, পলো, ধান বানার ঢেকি। এখন এগুলো আর দেখা যায় না। হারিয়ে যাওয়া সব ব্যবহার্য এখানে আসলে দেখা মেলে। এগুলো সাথে তাদের পরিচয় ঘটে।
টাঙ্গাইল থেকে আসা দর্শনার্থী সিদ্দিক দেওয়ান দম্পত্তি জানান, সোনারগাঁওয়ের লোক ও কারুশিল্প মেলা দেশের একমাত্র লোকজ মেলা। দেশের হারিয়ে যাওয়া লোক ও কারুশিল্পকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করা হয় এ মেলায়। ফলে ছেলে মেয়েকে নিয়ে এ মেলায় ঘুরতে এলাম। এ মেলা দেখে নতুন প্রজন্ম আরো বেশি করে জানতে পারবে। তবে মেলায় এসে খুবই ভালো লেগেছে শুধু লোকজ কারুপণ্য বিক্রি ও প্রদর্শনের ব্যবস্থা রয়েছে।
ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মেলায় ঘুরতে আসেন সাইদুর রহমান। তিনি বলেন, আমার স্ত্রীকে নিয়ে মেলায় ঘুরতে এসেছি। বাংলার নানা ঐতিহ্যবাহী জিনিস দেখে খুব ভালো লাগছে। সব স্টল ঘুরে ঘুরে দেখেছি। আমার স্ত্রীর জন্য একটি জামদানি শাড়ি কিনেছি। আর কিছু সৌন্দর্যবর্ধক পণ্য কিনেছি। তবে আজ ছুটির দিন হওয়ায় মেলায় অনেক লোকসমাগম হয়েছে। এ কারণে একটু বেশি ভিড় হয়েছে।


রাজশাহী থেকে এসে মেলায় নকশী কাঁথার বাহারি পণ্য দিয়ে স্টল সাজিয়েছেন পারভীন আক্তার। ‘রাজশাহী নকশীঘর’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। তবে কারুশিল্প মেলায় তার স্টলের নাম দেয়া হয়েছে ‘সন্ধ্যামালতী’। পারভীন আক্তার বলেন, মেলার শুরু প্রথম শুক্রবার ও আজ শুক্রবার অন্য দিনের চেয়ে বেচাবিক্রি ভালো হয়েছে। তবে ক্রেতার তুলনায় দর্শনার্থীর সংখ্যা বেশি। অনেকে আমার নানা পণ্য পছন্দ করে যাচ্ছেন, পরে এসে কিনে নিয়ে যাবেন। আশা করছি এবারের মেলায় আমার স্টলের নকশীকাঁথার মনোমুগ্ধকর ডিজাইন বেশ সাড়া পাবে, ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবে।
রংপুর থেকে শতরঞ্জির নানা পণ্য নিয়ে মেলায় দোকান সাজিয়েছেন আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, শতরঞ্জি আইটেমের বিভিন্ন পণ্য দিয়ে দোকান সাজানো হয়েছে। ব্যাগ, জায়নামাজ, পাপস, টেবিল ম্যাটসহ নানা পণ্য তোলা হয়েছে। কটন সুতাসহ নানা সুতা দিয়ে এসব পণ্য তৈরি করা হয়েছে। শুক্রবার মেলায় অনেক লোক হয়েছে। তাই বিক্রি বেশি হয়েছে। আশা করছি, দিন দিন বিক্রি বাড়বে।


কারুশিল্পী রফিকুল ইসলাম বলেন, এ মেলায় কাঠের তৈরি পণ্যের কদর ভালো। প্লাস্টিক পণ্য না থাকায় এ মেলার ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে। ছুটির দিনে দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে মেলা প্রাঙ্গণ।
মেলার বিশেষ আকর্ষণ হলো আয়োজক প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রদর্শনী দেশের প্রথিতযশা কারুশিল্পীদের শিল্পকর্ম নিয়ে ‘কর্মময় কারুশিল্পী’ প্রদর্শনী। মেলার মূল চত্বরের মাঠের মাঝে এর অবস্থান। এ বিশেষ প্রদর্শনীতে ২৪টি স্টলে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ৪৮ কারুশিল্পী দেশের হারানো ঐতিহ্যকে আবার নতুন করে আবিষ্কার করছে। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলো কারুশিল্পীরা তাদের স্বহস্তে তৈরি করছে সোনারগাঁওয়ের দারুশিল্পের কারুকাজ, নকশী কাঁথা, হাতি ঘোড়া, মমী পুতুলের বর্ণালী-বাহারি পণ্য, রাজশাহীর মৃৎশিল্প-মাটির চায়ের কাপ, শখের হাঁড়ি, নকশীকাঁথা, মুন্সীগঞ্জের শীতলপাটি, ঢাকার কাগজের শিল্প, বাটিক শিল্প, খাদিশিল্প, মণিপুরী তাঁতশিল্প, রংপুরের শতরঞ্জি শিল্প, ঠাকুরগাঁয়ের বাঁশের কারুশিল্প, মাগুরার শোলাশিল্প, টাঙ্গাইলের বাঁশ-বেতের কারুপণ্য, সিলেটের বেতশিল্প, জামালপুরের তামা-কাঁসা-পিতলের শৌখিন সামগ্রী, সোনারগাঁওয়ের বাহারি জামদানি শিল্প, বগুড়ার লোকজ বাদ্যযন্ত্র, কিশোরগঞ্জের টেরা কোটা পুতুল, কক্সবাজারের শাঁখা ঝিনুক শিল্প, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুজনিকাঁথা, খাগড়াছড়ি ও মৌলভীবাজারের ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠীর কারুপণ্য, মৌলভীবাজারের বেতের কারুশিল্প, চট্টগ্রামের তালপাতার হাতপাখা, পাটজাত কারুপণ্য, লোকজ অলঙ্কার শিল্পসহ ইত্যাদি কারুপণ্য। শিল্পীরা এখানে বসেই তাদের নিপুণ হাতে নিজস্ব মেধা ও মননে তৈরি করছে বাহারি কারুপণ্য এবং তা প্রদর্শন ও বিক্রি করছে। প্রদর্শনীর গ্যালারিগুলোতে থরে থরে সাজানো কারুপণ্যের পসরা দেখে অনেকেই কেনাকাটা করছেন শখের চিত্রিত হাড়ি, শোলা শিল্প, কাঠের সামগ্রী, শতরঞ্জি, নকশী কাঁথাসহ বিভিন্ন কারুপণ্যসামগ্রী।


কারুশিল্প মেলার একপাশে আবহমান বাংলার গ্রাম্য সালিশ, দাদী-নাতির গল্প বলা, ঢেঁকিতে ধানভানা, নকশী পিঠা তৈরি,পালকিতে বর-কনে, কনে দেখা, বরযাত্রা, গায়েহলুদ, পণ্ডিত মশাইয়ের পাঠশালা, জামাইকে পিঠা খাওয়ানো ইত্যাদি জীবন্ত প্রদর্শনী চলছে। আবহমান বাংলার লৌকিক আচার এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতিই ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে এ প্রদর্শনীতে। সোনারগাঁওয়ের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা এতে অংশগ্রহণ করছে। মেলা বরাবরের মতো নাগরদোলা, বায়োস্কোপ, বিমান চড়কি, পুতুল নাচ রয়েছেই।
বিকেলে দেখা গেছে, মেলা দেখে আর কারুপণ্য কিনে ক্লান্ত শরীরে বিকেলে বসে শুনছেন ময়ূরাকৃতির সোনারতরী মঞ্চ থেকে ভেসে আসা লালন, হাছন, ভাওয়াইয়া, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, বাউলগান, পালাগান, কবিগান, হাছন রাজার গান।
মেলার আয়োজক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশনের পরিচালক এস এম রেজাউল করিম জানান, লোক কারুশিল্পের প্রসারের জন্য প্রতি বছরের মতো আকর্ষণীয় বিভিন্ন খেলা, গান, প্রদর্শনী অনুষ্ঠান ছাড়াও এবারের উৎসবে গ্রাম বাংলার আর্থসামাজিক জীবনের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপন করা হয়েছে বৈচিত্র্যময়ভাবে। এবারো শুধু লোকজ কারুপণ্য দিয়ে সাজানো হয়েছে মেলাটি। শুধু লোকজ কারুপণ্যের পসরা বসেছে মেলা চত্বরে।
এবারের মেলায় মোট স্টল রয়েছে ১০০টি। মুড়ি মুড়কি, মণ্ড মিঠাই থেকে শুরু করে গ্রামীণ হস্তশিল্প, বাঁশবেত, কাঠ, লোহা, পাটজাত দ্রব্যসামগ্রী বিলুপ্ত প্রায় কুটির শিল্পের পসরার বসেছে মেলায়। আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মেলা চলবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement