২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঘাটাইল বনাঞ্চল থেকে হারিয়ে গেছে অর্ধশত জাতের ঔষধি গাছ

ঘাটাইলের বনাঞ্চলে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ঔষধি গাছ: নয়া দিগন্ত -

টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের ঘাটাইল গুইলার পাহাড়ের অংশের বিস্তৃত বনাঞ্চল থেকে বিগত ৪০ বছরে কমপক্ষে ৫০ জাতের ঔষধি গাছ ও লতাগুল্মজাতীয় গাছ হারিয়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে এ অঞ্চলের অবশিষ্ট জাতের ঔষধি গাছগুলো হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ফলে ধ্বংস হয়ে যাবে এ অঞ্চলের মানুষের নিজস্ব ঔষধি গাছের জ্ঞান যা তারা বংশপরম্পরায় অর্জন করেছিল।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মধুপুর গড়ের ঘাটাইল গুইলার পাহাড় অংশের শাল-গজারির বনের ফাঁকে ফাঁকে এক সময় কমপক্ষে অর্ধশত জাতের ঔষধি গাছ ও লতাগুল্ম পাওয়া যেত। এগুলোর মধ্যে অর্জুন, বহেড়া, হরীতকী, পিপুল, বানরলাঠি বা সোনালু, শটী, আমলকী, চান্দারমূল, সর্পগন্ধা, গোক্ষরকাঁটা, ভুঁইকুমড়া, সোনাপাতা, রাখালশসা, যজ্ঞডুমুর, ষষ্ঠীমধু, বচ, সিটকীগোটা, একাঙ্গী, মৌডাল, কতবেল, শতমূল, তেজবল, অশোক, তোকমা, ইসফগুল, যত্রিক, চালমুগড়া, কালোমেঘ, তেলাকুচা, ছাতিম, গুলঞ্চ, তরুকলা, দন্দকলস, একলা কানাই প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এসব লতাগুল্ম মানুষজন নানা ঔষধি কাজে ব্যবহার করত। স্থানীয় কবিরাজরা এ বন থেকে ঔষধি গাছ সংগ্রহ করে বাণিজ্যিকভাবে বিক্রি করত।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পর থেকেই গড়াঞ্চলে ব্যাপক হারে লুটপাট শুরু হয়। একদিকে বন লুট অপর দিকে ভূমি দখলের ফলে এ অঞ্চলে ঔষধি গাছের বিশাল সম্পদ এখন হুমুকির সম্মুখীন। ঘন শাল বনের ফাঁকে ফাঁকে গজিয়ে ওঠা ঔষধি গাছ এবং বিচিত্র লতাগুল্মের ঝোপঝাড় এখন আর নজরেই পড়ে না।
২০১০ সালের পর এ বনে পিপুল, বানরলাঠি এমনকি গুলঞ্চলতাও দেখেন না বলে জানালেন, ঘাটাইলের বিশিষ্ট ভেষজ চিকিৎসক মো: লিয়াকত আলী (৭০)। এ ব্যাপারে তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ১৫ থেকে ২০ বছর আগে এ বনের ভেতর মূল্যবান ঔষধি গাছ পাওয়া যেত। সে সময় তিনি প্রায় ৫০ জাতের ঔষধি গাছ দেখেছেন। অথচ চলতি বছর ফেব্র“য়ারি মাসে সারা দিন ঘুরে তিনি শুধু শটী আর মৌডাল গাছ পেয়েছেন। খুঁজলে হয়তো আরো দু-একটি লতাগুল্ম পাওয়া যেত। তবে তা পাওয়া খুব দুর্লভ। স্থানীয় বন বিভাগ সূত্র জানায়,গত শতকের নব্বইয়ের দশকে এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের সহযোগিতায় এ বনের ২০ হাজার হেক্টর জমিতে কৃত্রিম বন সৃষ্টি করা হয়। বিদেশী জাতের ইউক্যালিপ্টাস ও আকাশমণি গাছ দিয়ে কৃত্রিম বন সৃজনের ফলে এ এলাকার ঔষধি গাছগুলো হারিয়ে গেছে। বিদেশী গাছগুলো এ বনের হাজার বছরের জীব বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে দিয়েছে। সাধারণত বিদেশী গাছের নিচে কিংবা আশপাশে দেশী গাছপালা ও লতাজাতীয় গাছ জন্মায় না। এমনকি শাল-গজারির বনের স্বাভাবিক ঝোপঝাড়গুলোও এসব গাছের প্রভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।
ঘাটাইল বাজারের আশীর্বাদ কবিরাজি স্টোরের মালিক নিরঞ্জন কর্মকার জানান, বর্তমানে এ বনে চার-পাঁচ জাতের ঔষধি গাছ সামান্য পরিমাণে পাওয়া যায়, তাও আবার সেগুলো ব্যক্তি উদ্যোগে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এ বনের আদি জাতের গাছপালা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন শালিয়াবহ গ্রামের আব্দুল আজিজ। তিনি জানান, আগ্রাসী জাতের গাছ বাদ দিয়ে যদি দেশী জাতের ফলদ গাছ লাগানো হতো তাহলে ঔষধি গাছগুলো যেমন টিকে থাকত তেমন বনের পাখিগুলোও টিকে থাকত। বিদেশী গাছে পাখিও বাসা বাঁধে না। ব্যক্তি উদ্যোগে আজিজ কমপক্ষে ৩৫ জাতের ঔষধি গাছের বাগান করেছেন। প্রতিদিন অনেকে তার কাছে বিভিন্ন গাছের লতা, পাতা, ডাল ও শিকড় নিতে আসে।
প্রায় ৬০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ঘন শালবনে এক সময় যে বিচিত্র বৃক্ষলতা পাওয়া যেত তা এ অঞ্চলের বয়স্ক মানুষের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি।
প্রাকৃতিক বনের উপর বিদেশী জাতের গাছের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে ঘাটাইল উপজেলা রেঞ্জ অফিসার মো: সিরাজুল ইসলাম বলেন, বনের দেশী জাতের লতাগুল্মজাতীয় গাছ ধ্বংস হয়েছে মূলত বনের ভেতর মানুষের আনাগোনা বেড়ে যাওয়ার কারণে। সম্প্রতি সমতল এলাকা থেকে প্রচুর মানুষ বনের প্রান্তে এসে বাড়িঘর করছে। ফলে বনের প্রাণ বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।। ঔষধি গাছ ও লতাগুল্মজাতীয় গাছ রক্ষায় বন বিভাগের কোনো প্রকার পরিকল্পনা আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার এখন দেশী জাতের গাছপালা দিয়ে বনায়নের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে। বনের ভেতর যাতে মানুষ চলাচল করতে না পারে সে জন্য বেতকাঁটা রোপণ করা হচ্ছে। এর ফলে ঔষধি গাছ রক্ষা পাবে বলে তিনি মনে করেন।


আরো সংবাদ



premium cement