২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আজ ঔপন্যাসিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের জন্মবার্ষিকী

-

‘কিরীটি রায়’ খ্যাত জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের ১০৯তম জন্মবার্ষিকী আজ (৬ জুন) শনিবার। ১৯১১ সালের ৬ জুন নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। বাবার নাম সত্যরঞ্জন গুপ্ত ও মায়ের নাম লবঙ্গলতা দেবী। নীহাররঞ্জন গুপ্ত গোয়েন্দা ও রহস্য কাহিনী লেখক হিসেবে যেমন জনপ্রিয়, তেমনি চিকিৎসক হিসেবেও স্বনামধন্য। বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র ‘কিরীটি রায়’ এর স্রষ্টা হিসেবে উপ-মহাদেশে স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি। তার পরিবার ছিল বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয়। উইকিপিডিয়াসহ (মুক্ত বিশ্বকোষ) বিভিন্ন পাঠ্যপুস্তকে নীহাররঞ্জন সম্পর্কে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
চাকরিজীবী বাবা সত্যরঞ্জন গুপ্তের বিভিন্ন কর্মস্থলে অবস্থানকালে নীহাররঞ্জন গাইবান্ধা হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি স্কুলে পড়ালেখা করেন। ১৯৩০ সালে ভারতের কোন্ননগর হাইস্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন (এসএসসি) পাস করেন তিনি। পরে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে আইএসসি পাস করে ডাক্তারি পড়ার জন্য কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ থেকে ডাক্তারি বিদ্যায় পড়ালেখা করে কৃতকার্য হন। এরপর লন্ডন থেকে চর্মরোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তার বড় বোন বিষাক্ত পোকার কামড়ে মারা যাওয়ায় চিকিৎসার স্বপ্ন দেখেন তিনি এবং পরে সফলও হন।
কর্মজীবন : ডাক্তারি পাস করে বেশ কিছুদিন নিজস্ব ভাবে প্রাকটিস করেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন এবং বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় চাকরি করেন। তিনি মেজর পদেও উন্নীত হন। চাকুরি সূত্রে চট্টগ্রাম, বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার), মিসর পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে অবস্থান করে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেন। এক সময় চাকরি ছেড়ে কলকাতায় ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তারি শুরু করেন তিনি। অল্পসময়ের মধ্যেই চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে কলকাতায় বিশেষ পরিচিত লাভ করেন। ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৭ সালে পরিবারসহ স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করতে থাকেন।
সাহিত্য কর্ম : নীহাররঞ্জন গুপ্তের সাহিত্যে হাতেখড়ি শৈশব থেকেই। একসময় শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ গ্রহণসহ তার স্বাক্ষর বা অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেন। ১৬ মতান্তরে ১৮ বছর বয়সে তার প্রথম উপন্যাস ‘রাজকুমার’ মতান্তরে ‘রাজকুমারী’ প্রকাশিত হয়। ‘রহস্য’ উপন্যাস লেখায় ছিলেন তিনি সিদ্ধহস্ত। লন্ডনে অবস্থানকালে গোয়েন্দা গল্প রচনায় আগ্রহী হয়ে উঠেন। ভারতে এসে প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস ‘কালোভ্রমর’ রচনা করেন তিনি। এতে গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে ‘কিরীটি রায়’কে সংযোজন করেন, যা বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে এক অনবদ্য সৃষ্টি। পরে ‘কিরীটি রায়’ চরিত্রটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে বাঙালি পাঠকমহলে। তিনি বাংলা সাহিত্যে রহস্য কাহিনী রচনার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক। কেবলমাত্র রহস্য উপন্যাস নয়, তার সামাজিক উপন্যাসগুলোও সুখপাঠ্য। এ পর্যন্ত তার অন্তত ৪৫টি উপন্যাসকে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্রায়ন করা হয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের উপযোগী সাহিত্য পত্রিকা ‘সবুজ সাহিত্য’র সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন তিনি।
উপন্যাসের সংখ্যা : নীহাররঞ্জন গুপ্তের উপন্যাসের সংখ্যা দুই শ’রও বেশি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লিখিত উপন্যাসগুলো হলোÑ ‘মঙ্গলসূত্র’, ‘উর্বশী সন্ধ্যা’, ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘অজ্ঞাতবাস’, ‘অমৃত পাত্রখানি’, ‘ইস্কাবনের টেক্কা’, ‘অশান্ত ঘূর্ণি’, ‘মধুমতি থেকে ভাগীরতী’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘অহল্যাঘুম’, ‘ঝড়’, ‘সেই মরু প্রান্তে’, ‘অপারেশন’, ‘ধূসর গোধূলী’, ‘উত্তর ফালগুনী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’, ‘কলোভ্রমর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘কালোহাত’, ‘ঘুম নেই’, ‘পদাবলী কীর্তন’, ‘লালু ভুলু’, ‘কলঙ্ককথা’, ‘হাসপাতাল’, ‘কজললতা’, ‘অস্থি ভাগীরথী তীরে’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘সূর্য তপস্যা’, ‘মায়ামৃগ’, ‘ময়ূর মহল’, ‘বাদশা’, ‘রাত্রি নিশীথে’, ‘কনকপ্রদীপ’, ‘মেঘকালো’, ‘কাগজের ফুল’, ‘নিরালাপ্রহর’, ‘রাতের গাড়ী’, ‘কন্যাকেশবতী’, ‘নীলতারা’, ‘নূপুর’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মধুমিতা’, ‘মুখোশ’, ‘রাতের রজনী গন্ধা’ ও ‘কিশোর সাহিত্য সমগ্র’ উল্লেখযোগ্য।
নীহাররঞ্জনের অন্তত ৪৫টি উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘উল্কা’, ‘বহ্নিশিখা’, ‘উত্তর ফাল্গুনী’, ‘লালুভুলু’, ‘হাসপাতাল’, ‘মেঘ কালো’, ‘রাতের রজনীগন্ধা’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘নূপুর’, ‘ছিন্নপত্র’, ‘বাদশা’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘মায়ামৃগ’, ‘কাজললতা’, ‘কন্যাকুমারী’, ‘কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী’ প্রভৃতি। তার কালজয়ী উপন্যাস ‘লালুভুলু’ পাঁচটি ভাষায় চিত্রায়িত হয়েছে। ১৯৮৩ সালে উপন্যাসটি বাংলাদেশেও চিত্রায়িত হয় এবং দর্শকদের প্রশংসা অর্জন করে। তিনি ১৯৮৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার ইতনা গ্রামে ঔপন্যাসিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের আপনজন কেউ নেই। পৈতৃক বাড়িটি দীর্ঘ দিন ধরে ভগ্নদশায় থাকার পর ২০১৭ সালে সংস্কার করা হয়েছে। তার পৈতৃক ভিটায় রয়েছে দ্বিতল বাড়ি, পুকুরসহ গাছপালা।
নড়াইল প্রেস ক্লাবের সাবেক সহসভাপতি সাংবাদিক ও ফোকলোর গবেষক সুলতান মাহমুদ বলেন, বরেণ্য ঔপন্যাসিক নীহাররঞ্জন গুপ্তের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য তার জন্মভূমিতে তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। আমরা ভুলতে বসেছি তাকে। তরুণ প্রজন্মের অনেকেই জানেন না, নীহাররঞ্জন গুপ্ত কে? তিনি কি ছিলেন? তার জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীও সরকারিভাবে পালিত হয় না। এলাকার কিছু সাহিত্য-সংস্কৃতিপ্রেমী প্র্রতি বছর তার জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে থাকেন। তবে এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে বেসরকারি পর্যায়েও তেমন কোনো আয়োজন থাকছে না।


আরো সংবাদ



premium cement