২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

শিক্ষাবিদ ফেরদাউস খানের আজ চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী

-

একুশে পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ মোহাম্মদ ফেরদাউস খানের আজ চতুর্থ মৃত্যুবার্ষিকী। তিনি (২০ ডিসেম্বর ১৯১৯-৩০ মার্চ ২০১৬) ছিলেন দেশের একজন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক ও প্রশাসক। তিনি ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তার রচিত গ্রন্থের সংখ্যা ৫০টি। তিনি পশ্চিমবঙ্গ আইন পরিষদের সাবেক সদস্য মোহাম্মদ আমানত খানের জ্যেষ্ঠ পুত্র। শিক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য তিনি ১৯৮০ সালে একুশে পদকে ভূষিত হন।
ফেরদাউস খানের মতো মেধাবী ও জ্ঞানী মানুষ বাংলাদেশে বিরল। দ্বিতীয় প্রজন্মের শিক্ষিত বাঙালি মুসলিমের মধ্যে ফেরদাউস খান বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছেন। তিনি পদার্থবিজ্ঞানে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএসসি (অনার্স) (১৯৪১), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএসসি (পদার্থবিজ্ঞান) (১৯৪৩), ডিগ্রি অর্জন করলেও তার বিশেষ ক্ষেত্র হচ্ছে শিক্ষা-বিজ্ঞান, শিক্ষা-পরিকল্পনা ও শিক্ষা-প্রশাসন। তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে শিক্ষক-প্রশিক্ষণ (বিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) (১৯৪৫); এমএ (শিক্ষা-বিজ্ঞান, ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন, লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়) (১৯৪৮) ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজে (১৯৪৪-৪৮) এবং চট্টগ্রাম কলেজে (১৯৪৮-৫২) বিজ্ঞান/পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়ে শিক্ষকতা করার পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শিক্ষা অধিদফতরে যোগ দেন।
শিক্ষা-প্রশাসনমূলক বিভিন্ন উচ্চপদে যেমন চেয়ারম্যান, ঢাকা শিক্ষা বোর্ড (১৯৬৩-৬৫) এবং ডাইরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন্স বা ‘ডিপিআই’ (১৯৫৫-৭৩) পদে তিনি অধিষ্ঠিত ছিলেন। দেশের শিক্ষা-সংক্রান্ত উন্নয়নকাজে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ‘ডিপিআই’ পদটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে সাত বছরকাল ‘ডিপিআই’-এর পদে কাজ করেছেন। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান গড়া ও উন্নয়নে ফেরদাউস বিরাট ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৭ সালে তিনি চাকরিজীবন থেকে অবসর নেন।
ফেরদাউস খানের সব শিক্ষাবিদ ও শিক্ষাপ্রশাসক হওয়ার পেছনে কিছু পটভূমি পাওয়া যায়। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৯১৫ সালে) তার বাবা আমানত খান (১৮৮৯-১৯৭১) কলকাতার স্কটিসচার্চ কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। সুশিক্ষিত আমানত খান তার সন্তান ফেরদাউসের জন্য সবচাইতে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (যেমন : চট্টগ্রাম মিউনিসিপাল স্কুল, চট্টগ্রাম কলেজ, প্রিসিডেন্সি কলেজ, কালকাতা) লেখাপড়ার ব্যবস্থা করেন। ফেরদাউস তার পিতামহ মসউদ খানের (মৃত্যু সম্ভবত ১৯৩৫) হাতে বৃহত্তর পাঠান-বংশের ব্যবসা ও পারিবারিক ব্যবস্থাপনা স্বচক্ষে দেখেন।
ফেরদাউস খানের একটি জিজ্ঞাসু মন ছিল। এই কৌতূহলবোধের কারণে তিনি শিক্ষা-বিজ্ঞান, ভাষাতত্ত্ব, বাংলাহরফ, ধর্মবিষয়ক (বিশেষ করে কুরআনের তরজমা-তাফসির, ইসলাম ধর্মে বিজ্ঞান), গণশিক্ষা, শিশু-মনোবিজ্ঞানবিষয়ক অনেক প্রবন্ধ লিখেছেন। তার প্রচুর কবিতা ও ছড়া রচনা আছে। স্কুলজীবন থেকে জীবনের শেষ অবধি (১৯৩৪-২০০২) তিনি সহজ ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন। বিচিত্র বিষয় যেমন: কৈশোর, প্রেম-ভালোবাসা, দেশাত্মবোধ, ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিকতাবোধ, সাক্ষরতা, নাতি-নাতনীÑ এসব বিষয় নিয়ে তিনি কবিতা-ছড়া লিখেছেন। তার রচনায় বিশ্লেষণধর্মী ও সৃষ্টিশীল দু-ধরনের প্রকাশনা পাওয়া যায়। শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক হিসেবে তার কাজের স্বীকৃতি হিসেবে তিনি একুশে পদক (১৯৮০) অর্জন করেন।
পারিবারিক জীবনে ফেরদাউস খান একজন সফল মানুষ। তার সহধর্মিণী খাতেমান আরা বেগম (মৃত্যু ২০১১) কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিটি (১৯৪৩) এবং এমএড (১৯৫৮) পাস করেন। তাদের সংসারে চার মেয়ে ও পাঁচ ছেলে। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানে (বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে) তারা অধ্যাপনা, গবেষণা, ব্যবস্থাপনা কাজে ব্যাপৃত আছেন। চট্টগ্রামের পাঠানবংশের যে শিক্ষা-দীক্ষা ও জ্ঞানার্জনের সাধনা বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে শুরু হয়েছিল, এক শ’ বছর পরে ফেরদাউস খান-খাতেমান আরার যুগল সাধনায় তা যেন আরো বাড়তি শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলেছে।
ফেরদাউস খান চট্টগ্রামের পাঠানটুলী গ্রামের সম্ভ্রান্ত খান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মোহাম্মদ আমানত খান ছিলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ আইন পরিষদের সদস্য এবং চট্টগ্রাম বন্দর ট্রাস্টের প্রথম মুসলমান চেয়ারম্যান। তিনি তার পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান। ফেরদাউস খান ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ ঢাকার ইবনে সিনা হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।


আরো সংবাদ



premium cement