০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জাপানে যৌন সহিংসতা নিয়ে চুপ থাকার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে লড়ছেন যে নারী

রিনা গোনোই - সংগৃহীত

ছোট থেকে রিনা গোনোইয়ের স্বপ্ন ছিল দুটি- সৈনিক হওয়ার এবং অলিম্পিকে জুডোতে প্রতিযোগিতা করার।

মাত্র চার বছর বয়সে তিনি জুডো শুরু করেন। বড় ভাইয়ের কাছে ছিল হাতেখড়ি। ১১ বছর বয়সে প্রথম তিনি প্রথম জাপানি সৈন্যদের তৎপরতা নিজ চোখে দেখেন।

জাপানি সেনাবাহিনী, যেটি জাপান সেলফ ডিফেন্স ফোর্স (এসডিএফ) নামে পরিচিত, ২০১১ সালে ভূমিকম্প এবং সুনামির পর আশ্রয়কেন্দ্রে রিনা গোনোইয়ের পরিবারকে সাহায্য করেছিল। ২৩ বছরের রিনা গোনোইয়ের পরিবার জাপানের মিয়াগি প্রিফেকচারের হিগাশি-মাটশুশিমা এলাকার বাসিন্দা যেটি ওই দুর্যোগে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।

এসডিএফের ওই ত্রাণ দলে নারী সৈনিকরাও ছিল। রিনা গোনোই বলেন, ‘তারা আমাদের খাবার দিত, একটি সুপ-কিচেনও তারা খুলেছিল। আমরা যাতে গোসল করতে পারি তার জন্য গরম পানি বয়ে আনতো তারা। আমি তাদের দিকে তাকিয়ে ভাবতাম- কত ভালো একটি কাজ। আমি ভাবতে লাগলাম আমি সমাজ ও মানুষের জন্য কিছু করতে চাই।’

ছোটবেলার দুটি স্বপ্নেরই পূরণ তার নাগালের মধ্যে চলে আসে যখন তিনি এসিডএফের স্থল বাহিনীতে যোগ দেন। কিন্তু দুটি স্বপ্নই খানখান হয়ে যায় যখন প্রশিক্ষণ শেষে নিজের ইউনিটে যোগ দেয়ার পর তিনি ‘প্রায় নিত্যদিন’ যৌন হয়রানির শিকার হতে শুরু করেন।

তিনি জানান, করিডোরের ভেতর জাপটে ধরতো। সহকর্মীরাও এ কাজ করতো, সিনিয়ররা করতো, মানুষের চোখের সামনেই করতো।

তবে, ২০২১ সালে আগস্টে পরিস্থিতি সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়।

পাহাড়ে একটি প্রশিক্ষণের সময়, গোনোইয়ের তিন পুরুষ সহকর্মী তাকে তাঁবুতে ডাকে। ওই সময় তারা মদপান করছিল।

তিনি বলেন, ‘গিয়ে শুনি তারা কথা বলছে মার্শাল আর্ট নিয়ে। কাউকে গলায় হাত দিয়ে মাটিতে ফেলে ঠেসে ধরা এ ধরনের লড়াইয়ের একটি অংশ। তারা আমাকে বললো, গোনোই লেগে পড়ো। বলেই তারা আমাকে বিছানায় ফেলে গলা চেপে ধরল।’

ওই সময় আরো ১০ থেকে ১২ জন সৈনিক চারদিক ঘিরে তা দেখছিল। তিনি বলেন, কিন্তু কেউই ওই তিনজনকে থামাতে চেষ্টা করেনি। তাদের কেউ কেউ এমনকি হাসছিল।’

তিনি আরো বলেন, ‘ওই ঘটনার পর আমি প্রচণ্ডভাবে হতাশায় ডুবে গিয়েছিলাম। ভাবতাম আমরা শরীর ও মন যেন কলুষিত হয়ে গেছে। কিভাবে এরপর আমি বাঁচব?’

কেউ সাক্ষী দেয়নি
তিনি সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে নালিশ করলেন, কিন্তু কেউ সাক্ষী না দেয়ায় তার অভিযোগ খারিজ হয়ে যায়।

পরে এসডিএফের পুলিশ ইউনিট ওই তিনজনকে অশোভন হামলার জন্য অভিযুক্ত করে বিচারের জন্য আদালতে পাঠায়। কিন্তু প্রমাণের অভাবে মামলা খারিজ হয়ে যায়।

শেষ পর্যন্ত রিনা গোনোই সিদ্ধান্ত নেন সেনাবাহিনী ছেড়ে দেয়া ছাড়া তার সামনে কোনো রাস্তা নেই। তিনি চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরে যান।

তিনি বলেন, ‘আমি শারীরিক এবং মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। বাড়িতে ফিরে নিজেকে একদম আড়াল করে ফেললাম।

যখন রিনা গোনোই সেনাবাহিনীতে তার দুঃসহ অভিজ্ঞতা জনসমক্ষে প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেন, তার পরিবার এবং ঘনিষ্ঠজনরা তাকে নিষেধ করে।

জাপানের পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে যৌন নির্যাতনের শিকার নারীরাই এমন চাপে পড়েন যে লজ্জায় তাদের মুখে তালা দিয়ে থাকতে হয়। যারা সাহস করে মুখ খোলেন তাদের ওপর সমাজ, এমনকি পরিবার থেকেও, প্রচণ্ড চাপ আসে।

সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে জাপানে ৭০ ভাগ যৌন সহিংসতার ঘটনা চাপা পড়ে যায়। পুলিশ অভিযোগই পায় না।

রিনা গোনোইও জানতেন তার কাজ সহজ হবে না। কারণ তিনি জাপানের সামরিক একটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লাগছেন।

প্রথমে তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা ইউটিউবে প্রকাশ করলেন। এবং প্রায় সাথে সাথেই সেই কাহিনী জাপানের সাধারণ মানুষ এবং মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলে।

তিনি জানান, ইউটিউবে পোস্ট করার পর অনেক নারী এবং পুরুষ তাদের যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা তার সাথে শেয়ার করতে শুরু করেন। তার মধ্যে সেনাবাহিনীর ভেতরের অনেক কাহিনীও ছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যাতে অভিযোগ তদন্ত করে তার জন্য তিনি এক লাখ মানুষের সই জোগাড় করলেন।

কিন্তু তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিরূপ প্রতিক্রিয়াও শুরু হয়।

তিনি বলেন, ‘কেউ লিখতো তুমি কুৎসিত। কেউ লিখতো আমার কান ফুলকপির মতো দেখতে। কেউ লিখতো তুমি পুরুষ নয়তো। আমি যখন সই জোগাড় করছি, একটি ই-মেল পাই যেখানে হুমকি দেয়া হয় যে আর এক পা এগোলেই তোমাকে খুন করব।’

রিনা গোনোইয়ের আগে জাপানে ২০১৯ সালে যৌন সহিংসতার আরেকটি ঘটনা এতটা গুরুত্ব পেয়েছিল যখন জাপানের নারী সাংবাদিক শিওরি ইতো আরেক নামকরা এক রিপোর্টারের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলেন। সেই বছরই দেশটিতে ‘ফুল নিয়ে বিক্ষোভ’ (ফ্লাওয়ার ডেমো) আন্দোলন শুরু হয়। ২০১৯ সালের এপ্রিল থেকে প্রতিমাসের ১১ তারিখ যৌন সহিংসতার শিকার মানুষজন এবং তাদের সমর্থকরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ বিক্ষোভ করে। তারা এসব অপরাধের তদন্ত ও বিচারের দুর্বলতার প্রতিবাদ করে, যৌন নির্যাতন আইন কঠোর করার দাবি জানায়।

আইনে ফাঁক-ফোকরের ঘটনা নিয়ে জোরেসোরে কথা শুরু হয় যখন ২০১৯ সালে যৌন নির্যাতনের চারটি গুরুতর মামলায় অভিযুক্তরা খালাস পেয়ে যায়।

একটি মামলার বিচারে তার ১৯ বছরের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত এক বাবাকে খালাস করে দেয়া হয়, যদিও আদালত স্বীকার করেছিল যে মেয়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাবা তার সাথে এ কাজ করেছেন।

বাবাকে ঠেকানোর ক্ষমতা মেয়ের ছিল না বলে বাবা তার সুযোগ নিয়েছে বলে সরকারি কৌঁসুলিরা যে যুক্তি তুলে ধরেন বিচারক তা প্রত্যাখ্যান করে দেন।

টোকিওতে তেমন একটি প্রতিবাদ সমাবেশের পর মিনোরি কিতাহারা বলেন, ‘আমি ফুল নিয়ে প্রতিবাদ শুরু করেছিলাম কারণ আমি খুবই রেগে গিয়েছিলাম। আমি জানতাম বহু নারী রাগে ফুঁসছে। কিন্তু তা প্রকাশের জায়গা তাদের নেই।’

ধর্ষণ প্রমাণের দায় অপরাধের শিকার নারীর
টোকিওর কেন্দ্রে ওই সমাবেশ ছিল আকারে ছোট, কিন্তু চোখ কাড়ার মতো। বিক্ষোভকারীরা বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড বহন করছিলেন। একটিতে লেখা ছিল ‘যৌন অপরাধ অমার্জনীয়’, আরেকটি প্ল্যাকার্ডে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘সম্মতিই সবকিছু’।

চুপ করে থাকার সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিমাসের একটি দিনে এই সমাবেশ প্রতিবাদের একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেল, সমাবেশে এক নারী- যদিও তার মুখমণ্ডল মাস্ক এবং স্কার্ফ দিয়ে অর্ধেক ঢাকা ছিল, মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলছেন কিভাবে তরুণী বয়সে তিনি তার তার বাবার হাতে যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছিলেন। তার কথা শুনে অনেক নারী পুরুষের চোখ দিয়ে পানি পড়ছিল।

চাপের মুখে ফেব্রুয়ারিতে জাপান সরকার আইন করে মেয়েদের যৌন সম্পর্কে সম্মতির বয়স ১৩ থেকে ১৬-তে উত্তীর্ণ করে।

কিন্তু বর্তমান আইনে, যৌন সহিংসতার শিকার নারীদেরই প্রমাণ করতে হয় যে তিনি কোন সম্মতি দেননি, বাধ্য হয়ে জবরদস্তির শিকার হয়েছেন।

কিতাহারা বলেন, ’আমার মনে হয় এই আইনে বৈষম্য করা হয়েছে। অন্য অনেক দেশের আইনের তুলনায়, যৌন হামলার শিকার নারীদের প্রতি বৈষম্য করা হচ্ছে। আমি যখন দেখি নির্যাতনের শিকার নারীরা মুখ খুলতে পারছে না, তখন আমরা মনে হয় এই আইনটিই ওই নারীদের প্রতি সাক্ষাৎ একটি অপরাধ। আমি জানি সম্মতির বয়স বাড়িয়ে ১৬ করা হচ্ছে, কিন্তু এতদিন পর্যন্ত সেটি যে ১৩ রেখে দেয়া হয়েছিল, সেটি একটি বড় ইস্যু।’

কিতাহারা মনে করেন, জাপানের সরকার সবসময় ‘বয়স্ক পুরুষদের’ দিয়ে গঠিত হয়, ফলে মেয়েদের যন্ত্রণা বোঝার ক্ষমতা তাদের থাকে না।

রিনা গোনোইয়ের ঘটনা মানুষের এতটাই নজর কাড়ে যে সেনাবাহিনী একটি অভ্যন্তরীণ তদন্ত করতে বাধ্য হয়। গত ডিসেম্বরে, পাঁচজন সৈনিককে বরখাস্ত করা হয় এবং ওই ইউনিটের কমান্ডারকে ছয় মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ এক তদন্তে দেখা যায় যৌন হেনস্থার এক শ’রও বেশি অভিযোগ চাপা পড়ে রয়েছে।

মন্ত্রণালয় রিনা গোনোইয়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে বিবৃতি দেয়।

সেনাসদস্যরা যেখানে ধর্ষণের আসামি
রিনা গোনোই, বলেন গুরুতর এই বিষয়টি ‘অবজ্ঞা’ করার দায় সরকারেরও রয়েছে। তিনি বলেন, তার নিজের প্রতিবাদের পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে অন্য নারীদের যাতে সেনাবাহিনীতে গিয়ে তার মতো অবস্থায় না পড়তে হয়।

তিনি বলেন, ‘আমি চাই এসডিএফের প্রতিটি সদস্য যেন সুরক্ষা পায়।

গত বছরের শুরুতে রিনা গোনোই পাঁচ অপরাধী এবং জাপান সরকারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। তাকে প্রচণ্ড মানসিক চাপে ফেলার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ওই পাঁচজনের কাছ থেকে ৫৫ লাখ ইয়েন (৪০ হাজার ডলার) এবং অপরাধ ঠেকাতে না পারার দায়ে সরকারের কাছ থেকে অতিরিক্ত ২২ লাখ ইয়েন ক্ষতিপূরণ দাবি করেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘটনা ফাঁসের পর থেকে যে চাপ তাকে সহ্য করতে হচ্ছে, তারপরও কেন তিনি এই মামলা করতে গেলেন?

এই প্রশ্নে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখালো তাকে। কিছু সময় পরে উত্তর দেন, ‘আমি এসডিএফকে (সেনাবাহিনী) খুবই পছন্দ করি। দুর্যোগে (২০১১) তারা আমাদের অনেক সাহায্য করেছিল। ফলে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর কোনো ইচ্ছা কখনো ছিল না, কিন্তু আমার আর উপায় ছিল না। আমি মনে করি যা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। আমি তা নিয়ে এখনও দুঃস্বপ্ন দেখি। ওই ঘটনায় আমার ভীষণ ক্ষতি হয়েছে।’

মার্চে রিনা গোনোইয়ের করা মামলায় ফুকুশিমার সরকারি কৌঁসুলিরা জাপান সেনাবাহিনীর তিন সাবেক সদস্যকে অভিযুক্ত করে।

ওই অভিযোগ দায়েরের পর রানা গোনোই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) জানান, তার কাজ বৃথা যায়নি এবং তিনি আশা করেন ওই তিন ব্যক্তি তাদের অপরাধ নিয়ে অনুশোচনা করবে।

তিনি বলেন, ‘আমি অনেক দিন ধরে ভেবেছি এবং মেনে নিতে পারিনি যে কেন তাদেরকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে না। প্রতিদিন মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছি।’

তিনি আরো বলেন, তিনি এখন সামনে এগোতে চান এবং ঘুরে বেড়াতে চান।

তিনি বলেন, ‘আমি মজা করতে ভালোবাসি, আমি মানুষকে হাসাতে ভালোবাসি, নিজে হাসতে ভালোবাসি। আমি মানুষকে দেখাতে চাই এত কিছুর পরও আমি ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বাঁচতে পারি, জীবন উপভোগ করতে পারি। আমি আমার মতো করে বাঁচতে চাই।’
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement