সে দিন ছিল জুমাবার। জুমার নামাজ পড়তে বের হয়েছিলাম আমি। সাথে ক্যামেরাটাও ছিল। বেশ কয়েক জুমা ধরে একটা প্লান মাথায় নিয়ে ঘুরছিলাম; কিন্তু হয়ে উঠছিল না। আমাদের গ্রামের এক মুরব্বিকে নিয়ে একটা ভিডিও ফুটেজ বানাবো। রমজানের শেষ জুমা। পথে দেখা হলো এ লোকটার সাথে। মানুষটি অনেক আগের চেনা। কয়েক দিন অন্তরই এ মানুষটির আওয়াজ কানে আসে। এক অভিনব সুরে ডাক ছাড়েন ‘নারকেলের পাটালি, নারকেলের পাটালি বলে’। বড্ড মজার মানুষ। এর আগে বেশ কয়েকবার কথা বলেছি এ চাচার সাথে। সাংসারিক অনেক গল্প শুনেছি উনার। উনার ছেলেদেরও চেনা আমার। ছেলেরা সবাই আমাদের রোডের বাস গাড়ির স্টাপ। কেউ ড্রাইভার, কেউ সুপারভাইজার আর কেউ হেলপার। চেহারার মিল খুঁজে পেয়ে এক দিন জিজ্ঞাসা করেছিলাম উনার এক ছেলের কাছে। পরে নিশ্চিত হয়েছিলাম।
আসসালামুওয়ালাইকুম চাচা পাঁচ মিনিট কথা বলতাম সময় হবে! চাচা মাজায় হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চাচা আপনার নারকেলের পাটালি বলার স্ট্যাইলটা সত্যি খুব ভালো লাগে। অনেকবার আপনার মতো করে বলতে চেষ্টা করেছি কিন্তু হয় না। মিচকি হেসে বললেন, ওই বলতে বলতে একটা অভ্যাস হয়ে গেছে তাই। রোজা আছেন নাহ! হ্যাঁ আছি। চাচা রোজা থেকে এই রোদ্রের ভেতর টইটই করে বেড়াতে আপনার কষ্ট হচ্ছে না? কষ্ট হলেই বা কী করা! যত দিন বেঁচে আছি তত দিন করতেই হবে। সে রোদই হোক আর ঝড়ই হোক। যত দিন শরীরে কুলাই তত দিন কাম ছাড়া ভাত নেই। আমি জিজ্ঞেস করলাম ছেলেদের সাথে আপনি কি আলাদা নাকি ছেলেরা খোঁজখবর নেই না? চাচা বললেই সবাই আমার খোঁজখবর নেয়। কিন্তু আমি অন্য প্রকৃতির মানুষ। কারো আসল্যে কথা কিংবা বাঁকা কথা সহ্য করতে পারি না। সহ্য হয়ও না। ওই আমারে একবেলা খাতি দিয়ে চোখ মোড়া মুড়ি করবা তা আমি দেখব কেন? আমার ১০টা টাকার দরকার সেটি আমি ছেলেদের কাছে চাইতে যাবো কেন? প্রয়োজনে তারা আমার কাছে চাক। সারাজীবন আমি দিছি এবং যত দিন বেঁচে থাকব তাদেরই দিয়ে যাবো। কিন্তু আল্লাহর কাছে এই দোয়া রাখি যেন তাদের কাছে হাত না পাততে হয়। আপনার কথার মধ্যে অনেক কষ্টের ঘ্রাণ পাচ্ছি চাচা। আপনি লুকাচ্ছেন। ‘লোকানোর কি আছে বাজান।’ আসল কথা হলো কপালে যার কষ্ট লেখা থাকে তার সুখ কি কেউ দিতে পারে। পারে না। এই বলে চাচা একটু নড়েচড়ে দাঁড়ালেন। ১০ বছর বয়সে মা-বাপরে হারিয়েছি। সব ভাইবোনদের মানুষ করেছি। সবাই নিয়ে ভেবেছি কিন্তু শেষে দেখি আমাকে নিয়ে কেউই ভাবেনি। আর ভাবতেও চায় না। চাচা কষ্টের কথা মনে করিয়ে কষ্ট দিচ্ছি আপনাকে তাই না। আচ্ছা চাচা আপনি কি রোজই বের হন? উত্তরে বললেন রোজই বের হয়; কিন্তু এক একদিন এক একদিক যান।
জিজ্ঞেস করলাম পাটালি কি আপনি নিজেই বানান? চাচা বললেন নিজেই বানান। কোথা থেকে শিখেছেন জানতে চাইলে বললেন নিজের ভাবনা থেকেই। কত টাকা ইনকাম হয় রোজ? ২৫০-৩০০ বা তার চেয়ে বেশি কোনো দিন আবার নয়তো এর থেকে কমও হয় কোনো দিন। এর ঠিক নেই। কত বছর ধরে এই নারকেলের পাটালি বিক্রি করছেন চাচা? ১৭ বছর। ১৭ বছর ধরে এ নারকেলের পাটালি বিক্রি করি আমি। নিজের খাবার নিজে রোজগার করে খায়। পাটালি বিক্রির আগে কোন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন এমনটি জিজ্ঞেস না করতেও চাচা আপনা আপনি বললেন এর আগে লেবারি করতাম। কখনো ট্রলারের লেবার, কখনো হাটের বিভিন্ন মহাজনের ট্রাকে, কখনো বা শহরের কাঁচামালের আড়তে। ছেলেপুলেগো মানুষ করেছি অবশ্য লেবারি করেই।
চাচা আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম। কিছু মনে করবেন না। আজ তো শুক্রবার জুমা নামাজ পড়বেন না! উনি বললেন আল্লাহ যদি পড়ায় তাহলে পড়বানি। আমি বললাম সেটা তো অবশ্যই চাচা। তবে নিজের ও তো ইচ্ছাটা থাকা চাই। চাচা হেসে বললেন তা তো ঠিকই বাজান। সামনে যেখানে সময় হয় সেখানে পড়বানি। অবশেষে চাচার ছবি তুলে বিদায় নিয়ে মসজিদের দিকে রওনা হলাম। বয়স ৭২ বছর হলেও তফসীর মোল্লার কথাবার্তায় রয়েছে এক তেজস্বী ভাব।
৭২ তাকে আঁকড়ে ধরতে পারেনি। বার্ধক্য তাকে পরাস্ত করতে পারেনি। এই বয়সী মানুষেরা যেখানে সামান্য নড়াচড়া করতেই ব্যর্থ সেখানে তফসীর মোল্লা গ্রামের পর গ্রাম হেঁটে নারকেলের পাটালি বিক্রি করে বেড়ান। শারীরিকভাবে বাধাগ্রস্ত হলেও মনের দিক থেকে তিনি এক সাহসী সৈনিক। মরতে রাজি তবু আত্মসম্মান ক্ষুণœ করতে একই প্রস্তুত নন। এ রকম তফসীর মোল্লারা বেঁচে থাকুক হাজার বছর।
শালিখা, মাগুরা
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা