২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনাকালে কৃষি অর্থনীতির সঙ্কট

-

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান তিনটি খাতের মধ্যে কৃষি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কৃষির চেয়ে ‘সেবা’ ও ‘শিল্প’ খাত থেকে বেশি জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন হলেও দেশের সর্বাধিক কর্মসংস্থানের জোগান দিয়ে আসছে কৃষি খাত। দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তির ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। বিগত কয়েক দশকে উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তথাপি ও কৃষিকে সম্মুখীন হতে হয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের অভাব, অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার।
এ কথা বলছি তখন, যখন ‘করোনাভাইরাস’ নামক প্রতিবন্ধকতায় বিশ্ব স্থবির হয়ে রয়েছে। বিগত সাড়ে ছয় মাস ধরে স্থবির রয়েছে দেশের ‘শিল্প’ ও ‘সেবা’ খাত। কমে এসেছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণসহ সব অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। সে ক্ষেত্রে দেশের অর্থনীতিতে এক বিরূপ প্রভাব পড়েছে। এক বিশাল জনগোষ্ঠী হারিয়েছে কর্মসংস্থান, হয়ে পড়েছে বেকার। বর্তমানে কিছু প্রতিষ্ঠান সচল হতে শুরু করলেও স্বাভাবিক হতে পারছে না। অন্য দিকে বিজ্ঞানীরা করোনার ফলে সৃষ্ট সঙ্কট, অর্থনৈতিক ধস ও করোনা-পরবর্তীকালীন সময়ে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করেছেন। এমন পরিস্থিতিতেও থেমে নেই কৃষি ও কৃষির উৎপাদন। মাঠে কাজ করছেন কৃষক। বর্তমানে দেশে অর্থনীতির ভিত্তি অনেকাংশেই কৃষিনির্ভর হয়ে উঠেছে।
কিন্তু এ সময় খাতটিকে সম্মুখীন হতে হচ্ছে লোকসানের। স্বল্পমেয়াদে কৃষির সব উপখাতের উৎপাদন বন্ধ না থাকলেও দেশী-বিদেশী অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকায় উৎপাদিত দ্রব্যমূল্যের ওপর নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। সঠিক সময়ে ফসল উৎপাদন করে দেশের জনগণের চাহিদার জোগান দিতে পারলেও পাচ্ছে না ন্যায্যমূল্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে ফসল বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক।
লকডাউনের সময় সরবরাহ ব্যবস্থা অবনতি ঘটায় নষ্ট হয়েছিল লাখ লাখ টন পণ্য। লকডাউন তুলে নেয়ায় সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত হলেও পণ্যের দামের ওপর যে নিম্নমুখী প্রভাব পড়ে ছিল তা এখনো ভীষণভাবে লক্ষণীয়। খুচরা বাজারে সব পণ্যের দাম চড়া হলেও কৃষক পর্যায়ে তা কেনা হচ্ছে পানির দামে। মাঠপর্যায়ে সর্বত্র ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।
এক দিকে সুপার সাইক্লোন আমফানে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে দেশের কৃষি খাত। সেই সাথে পরপর দু’বার বন্যার ফলে ব্যাহত হচ্ছে কৃষি উৎপাদন। করোনাকালীন মাঠপর্যায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষির প্রতিটি সেক্টর। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে কৃষিভিত্তিক ছোটখাটো ব্যবসা ও ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানগুলো সহজে ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না। ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক চেইন ক্ষতিগ্রস্ত। বর্তমানে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আবার উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ স্বল্পতায় ভুগছেন কৃষকরা। ফলে দেশজ উৎপাদন কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় চলতে থাকলে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে।
কর্মসংস্থান বন্ধ থাকায় এক দিকে কমে গেছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। পাশাপাশি এই সঙ্কট সৃষ্টির জন্য দায়ী এক শ্রেণীর মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, অসাধু ব্যবসায়ী, কালোবাজারি, সিন্ডিকেট। যারা করোনা মহামারীকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করছে ত্রাসের রাজত্ব। অচিরেই এ সমস্যা সমাধান করতে না পারলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েও দেশের অর্থনৈতিক ধস নেমে আসবে। শুধু কৃষি সেক্টরটাই ধসে পড়বে না, সাথে দেশের ভবিষ্যৎও হুমকিতে পড়বে।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষি উৎপাদন ও বিপণন ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। যদিও সেখানে দ্রব্য বাজারজাতকরণ ও ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির বিষয় উল্লেখ করা হয়নি। তবে পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। ১৫ এপ্রিল থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত সরাসরি কৃষক পর্যায় থেকে ন্যায্যমূল্যে প্রায় ১৯ লাখ টন শস্য কেনার ঘোষণা দেয় সরকার। নতুন অর্থবছরে বাজেটে তিন হাজার ১৯৮ কোটি টাকা কৃষির জন্য বরাদ্দের পাশাপাশি ২০০ কোটি টাকার ভর্তুকি মূল্যে কৃষি যান্ত্রিকীকরণ করা হয়েছে। কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে পাঁচ হাজার কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রায় সামগ্রিক কৃষি খাতে সর্বমোট ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়াও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে নানা রকম সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। যদিও আর্থিক প্রণোদনার মতো উদ্যোগগুলোর সুফল সঠিক প্রাপ্যজনের কাছে কতটুকু পৌঁছাতে পারে সে ব্যাপারে বিস্তর বিতর্ক রয়েছে।
কম সুদে জামানতবিহীন ঋণ প্রদান, প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা, ভর্তুকি প্রদান, প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি-সার-উন্নত মানের বীজ বিতরণ, সুনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা, সুনির্ধারিত দাম ব্যবস্থা, সরবরাহ ব্যবস্থা ও পণ্যের যথাযথ বাজারজাতকরণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সেটি সর্বক্ষেত্রে ফলপ্রসূ করতে হলে প্রয়োজন সরকারের কঠোর নজরদারির। মধ্যস্বত্বভোগী, অসাধু ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেট, উচ্চপদস্থ দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর হাতে দমন করা। ভোক্তা ও উৎপাদকের মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা। কৃষিযন্ত্র উৎপাদনে দেশীয় তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা এবং পারিবারিক কৃষির প্রসারে বাজেট বরাদ্দ রাখা। কৃত্রিম সঙ্কট এড়াতে সরকারি উদ্যোগে ন্যায্যমূল্যে পণ্য কিনে মজুদ রাখা। সব প্রণোদনা সহায়তার সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। সরাসরি মাঠপর্যায়ে কৃষকের কাছে সব সুবিধা পৌঁছাতে পারলে তা কৃষক মহলসহ গোটা দেশের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে।
অন্য দিকে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া খাতটির জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব। নিজেদের পণ্যে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পারলে আমদানি নির্ভরশীলতা অনেকাংশে কমে যাবে। জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। এ জন্য বিদেশের বাজারে আমাদের কৃষিপণ্যের আন্তর্জাতিক বাজার সম্প্রসারণে রফতানিযোগ্য কৃষিপণ্যের বৈশ্বিক সম্ভাবনার সুনির্দিষ্ট ক্ষেত্র চিহ্নিত করে তথ্য বিশ্লেষণ করতে হবে। কৃষিপণ্যের চেইনকে এমনভাবে প্রস্তুত করতে হবে, যাতে আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ঘাটতি ও এর চাহিদা বৃদ্ধির সাথে আমরা দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারি। করোনাকালীন রাষ্ট্রের অর্থনীতির যে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে, তা যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে কৃষি অনেকটাই পুষিয়ে দিতে সক্ষম হবে। তাই সরকারের সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি অর্থনীতির বিশাল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব।
লেখক : শিক্ষার্থী , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement
‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নতুন আংশিক কমিটি বাংলাদেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসায় বিনিয়োগ সম্ভাবনা অন্বেষণে থাইল্যান্ডের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

সকল