০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


আইনের প্রয়োগ

-

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদ মতে, ‘আইন’ অর্থ হচ্ছে ‘কোনো আইন, অধ্যাদেশ, বিধি, প্রবিধান, উপ-আইন, বিজ্ঞপ্তি ও অন্যান্য আইনগত দলিল এবং বাংলাদেশে আইনের ক্ষমতাসম্পন্ন যেকোনো প্রথা বা রীতি।’ এ আইন দিয়েই ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও রাষ্ট্রের করণীয় নির্ণীত হয়। কিন্তু দেশে আইন মেনে চলার নমুনা দেখলে হতাশই হতে হয়। আইন হাতে তুলে নেয়া, আইনের তোয়াক্কা না করা, আইন না জানা মানুষের সংখ্যাই যেন বেশি। তাই হতাশ হয়ে হয়, আইন অমান্যে শাস্তির বিধানের পাশাপাশি আইন মান্যেও পুরস্কারের বিধান যদি থাকত, তা হলে দেশে আইন মেনে এমন হতাশাজনক হতো না। এর সাথে দেশের মানুষ সুশিক্ষিত, সামাজিক, দেশপ্রেম, ধর্মভীরুতা; তথা নাগরিকবোধ এবং আইন প্রণয়নে সদিচ্ছা ও প্রয়োগে জবাবদিহি থাকলে প্রতিটি আইনই ঈপ্সিত অর্জন করতে পারত। এর সুফল পেত দেশের সব নাগরিক। গত বছর জুনে সংসদে আইনমন্ত্রীর দেয়া তথ্যমতে, ১৭৯৯ থেকে ১০ জুন ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশে প্রচলিত আইনের সংখ্যা এক হাজার ১৪৮টি। যদিও বিশেষায়িত আইনগুলো সবার জন্য প্রযোজ্য নয়, তবুও দেশের আইনের আধিক্যে ধরে নিতে পারি, আমাদের আচরণ অধিকতর সুশৃঙ্খল এবং রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত। কিন্তু আইনের আধিক্য নাগরিকদের আনুগত্যের আধিক্য নির্দেশ করে নাকি একটি রাষ্ট্রের আইনের অকার্যকারিতাও প্রমাণ করেÑ এটি গবেষণা ও বিতর্কের বিষয়। কিন্তু আমাদের সিক্সথ সেন্স বলে, দেশে আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সাধারণ নাগরিকদের আইনের প্রতি স্বেচ্ছা আনুগত্য থাকলে এত আইন প্রণয়নের আদৌ হয়তো প্রয়োজন হতো না। অলিখিত সংবিধান দিয়ে ব্রিটেনের মতো দেশ পরিচালিত হচ্ছে; কিন্তু আমাদের দেশের সংবিধান লিখিত, আইনের সংখ্যা সহস্রাধিক; এর পরও আমরা আইন জানি না, আইন মানি না।
একজন মানুষ যদি আরেকজনকে সজ্ঞানে খুন করে, তা হলে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারা অনুযায়ী শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং তাকে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা যাবে। কিন্তু খুনি খুন করার পর যদি বলে, ‘দণ্ডবিধি তো আমি পড়িনি, ৩০২ ধারা তো আমার জানা নেই’, তা হলে ছাড় পাবে কি? আইন অনুসারে ছাড় পাওয়া অসম্ভব। তাকে শাস্তি পেতেই হবে। কিন্তু বইয়ে লেখা এ আইনের প্রয়োগকারীরা (আদালত, প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) যদি আইনের কালো হরফের নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করেন, তা হলে ‘মানুষ খুনেরও’ কোনো শাস্তি হবে না। অথবা হতে পারে, মানুষ আইন মানে না বলেই আইনের প্রয়োগ হয় না। এটি যদি মেনে নিই, তা হলে আইন প্রয়োগের দায়িত্ব আসলে কার? এ দায়িত্ব কি তবে সাধারণ মানুষের উপরেই ন্যস্ত হয়ে যাচ্ছে না? আর সত্যিকার অর্থে যদি তা-ই হয়, তা হলে তো শুধু আইন প্রণয়নের কেন্দ্র ‘সংসদ’ থাকলেই হয়। সংসদে আইন পাস করে লিপিবদ্ধ করে বই আকারে রেখে দিলেই তো সব দায়িত্ব শেষ। প্রয়োজন থাকবে না আদালত, পুলিশ ও প্রশাসনের।
তবে আইনের সফল প্রয়োগে কিন্তু প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অবদানকেই সবচেয়ে বড় করে দেখা হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, বিরোধী দল ও মত দমনমূলক আইন প্রয়োগে আইন প্রয়োগকারী এসব পক্ষের যতটা তৎপরতা ও ক্ষিপ্রতা লক্ষ করা যায়, অন্য আইন বাস্তবায়নে এমন নিষ্ঠা থাকাও স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবে এমনটি হচ্ছে না বলে অন্যসব আইনের লঙ্ঘনের ঘটনাও অনেক বেশি। ‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫’ এর ধারা-৪ এ বর্ণিত পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহনে ধূমপান বিষয়ক নির্দেশনাটি দেশের ক’জন ধূমপায়ী মেনেছে, কিংবা এ ধারার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে কী ভূমিকাই বা রেখেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা? উল্লেখযোগ্য ভূমিকা দেখা যায় না বলেই মনে হয়। খুব নগণ্য শাস্তি আর জরিমানার বিধানও হয়তো আইনের ধারাটির বিফলতার অন্যতম কারণ। আইনের শাস্তি নগণ্য বা তুচ্ছ পরিমাণ হলে, সে আইনের প্রয়োগে ঢিলেমি চলে আসে, পরিপালনেও ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব চলে আসে। ‘সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন-২০১৮’ অনুযায়ী মাস্ক না পরার শাস্তি সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। কিন্তু এ আইনেই মাস্ক না পরার কারণে একজনকে কেবল ৫০ টাকা জরিমানা করলে, তা মানুষকে আইন মানতে বাধ্য করার চেয়ে আইন ভাঙতেই যেন উৎসাহ জোগায়। করোনাকালের গত চার মাসে মানুষ মাস্ক পরতে পরতে ক্লান্ত হয়ে এখন অনেকেই যেখানে মাস্ক পরা ছেড়ে দিয়েছে, কেউ আবার পরলেও সেটা দিয়ে নাক ঢাকে না, অথবা নাক-মুখ কোনোটাই না ঢেকে থুতনিতে নামিয়ে রাখে, সেখানে আবার ২১ জুলাই স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এক পরিপত্রের মাধ্যমে ১১টি ক্ষেত্রে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আদেশ জারি করেছে। এ আদেশটি অবশ্যই সময়োপযোগী। কিন্তু আদেশ জারির পরদিন বাইরে বের হওয়া কতজন মাস্ক ব্যবহার করেছেন তা না বলাই ভালো। জরিপ করলে দেখা যাবে, সঠিক নিয়মে মাস্ক পরেন মাত্র ১৫ শতাংশ মানুষ।
তার মানে হচ্ছে, এখানে আইন অমান্যের চিত্রই লক্ষ করলাম। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, কে নিশ্চিত করবে ১৬ কোটি মানুষের দেশের প্রত্যেককে নাকে-মুখে মাস্ক পরাতে? আমরা কি অতটাই অনুগত হয়ে গেছি যে, রাষ্ট্রীয় আদেশ পেলেই আমরা তা সুবোধ বালকের ন্যায় পরিপালন করব, নাকি মাসে একবার মোবাইল কোর্ট বসিয়ে জনা দশেক মানুষকে ৫০-১০০ টাকা করে জরিমানা করলেই এ আদেশ বাস্তবায়িত হবে? আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে মানুষকে যেমন আইন জেনে আইনের প্রতি সচেতন ও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে, ঠিক তেমনি বিচার বিভাগ এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকেও যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে আইন মানার জন্য এর সঠিক প্রয়োগই সবচেয়ে বড় মহৌষধ। আইন যদি প্রয়োগ করা না হয়, তা হলে সে আইন তৈরি করায় কোনো অর্থ বহন করে না। প্রকৃতপক্ষে, প্রয়োগহীন যেকোনো আইন নখদন্তহীন বাঘের মতো। আইনের প্রয়োগ হলেই তা দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করে এবং অবাধ্য ও দুষ্কৃতকারীদের মনে ভয় জাগিয়ে তোলে। তাই প্রত্যাশা, এই করোনাকালে মাস্ক পরা নিশ্চিত করাসহ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন, মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট সবাই নিজ নিজ ভূমিকা পালন করবেন। না হলে মনে হবেÑ আইন তৈরি করা হয় শুধু ভাঙার জন্যই, মানার জন্য নয়।হ
লেখক : ব্যাংকার ইমেইল : mosharafmau.200117@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement