০৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বিচারক ও আইনজীবী তুলনামূলক আলোচনা

-

মানবদেহের রোগ মুক্তির দায় যেমন একজন ডাক্তারের ওপর অর্পিত থাকে, প্রকৌশলী তার ইটের গাঁথুনিতে অবকাঠামোর ভিত যেমন গড়েন, ঠিক তেমনি দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনে বিচারাঙ্গন বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে থাকে। দার্শনিক রোজার ডাটেন্স বলেছিলেন ‘বাঁচো এবং বাঁচতে দাওÑ এ হলো সাধারণ বিচারের কথা’। বিচার হলো মূলত বিবদমান দলের মধ্যকার বিরোধের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত বা রায়। কিন্তু বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে চূড়ান্ত রায়ে রূপান্তরিত করতে বিচারক, আইনজীবী, পক্ষ-বিপক্ষ, সাক্ষী একে অন্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আইনজীবী আদালতের সামনে সাক্ষ্য-প্রমাণ, জেরা, জবানবন্দী ও সংশ্লিষ্ট আইনের উপস্থাপন করে থাকেন। আদালতকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করাই আইনজীবীদের প্রধান কর্তব্য ও দায়িত্ব। এককভাবে আদালতের পক্ষে সত্যকে উদঘাটন করে আইনের সমর্থিত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব নয়। সে কারণেই আদালত ও আইনজীবীদের যৌথ সহযোগিতায় বিচারব্যবস্থার ভারসাম্য রক্ষিত হয়। এ সত্যতার স্বীকৃতি ঘটেছে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে।
কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য, আমাদের বহু জেলাতে আইনের কূটতর্কের বিষয়টি ব্যক্তিগত বিষয় হয়ে পড়ায় অনেক ক্ষেত্রে বার ও বেঞ্চের মধ্যকার উত্তেজনা বেড়ে যায় এবং একপর্যায়ে আদালত বর্জন অনুষ্ঠান চলে। এ অবস্থা ন্যায়বিচারপ্রত্যাশীদের ‘গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেয়া’র শামিল। আইন ও বিচারের প্রতি জনমানুষের শ্রদ্ধা যদি বাধার সৃষ্টি করে তবে সামাজিক শৃঙ্খলা ভেঙে পড়া স্বাভাবিক। কাজেই বিচারক, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে যার যার অবস্থানে থেকে সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে; যাতে পক্ষগণ অন্তত বুঝতে পারে যে, আদালতে ন্যায়বিচার করা হয়েছে। বিচারকের নীতিমালাতে স্পষ্ট বলা আছে, বিচারককে ভয় ভীতির ঊর্ধ্বে থেকে বিচারকার্য সম্পাদন করতে হবে। বিচারক অবশ্যই ন্যায়নিষ্ঠ এবং উন্নত চরিত্রের অধিকারী হবেন। বিচারকরা এমন কোনো সংগঠনের সদস্য হবেন না; যা ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ ভেদাভেদের কারণে গঠিত হয়। একজন বিচারক অন্য কারো ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য তার নিজের পরিচয় ও ক্ষমতার অপব্যবহার করবেন না। আইনজীবী আর বিচারপ্রার্থীদের প্রতি ধৈর্যশীল হবেন বিচারক এবং সম্মানজনক আচরণ প্রদর্শন করবেন। বিচারক বা তার পরিবারের কোনো সদস্য কারো কাছ থেকে বিচারিক ক্ষমতার বিনিময়ে উপহার, অনুরোধ, ঋণ বা সুবিধা চাইতে পারবেন না। এক কথায়, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা নিয়ে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস থাকে, এমন আচরণ করতে হবে।
বিচারকের ‘চোখ অন্ধ’, কারণ আদালতের সামনে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে, আইনের সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেকেই তিনি রায় ঘোষণা করেন। তার ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছা বাস্তবায়নের কোনো সুযোগ নেই। দেওয়ানি কার্যবিধির ১৫১ ধারা, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১(ক) ধারা আদালতকে বিপুল ক্ষমতা প্রদান করেছে। তবে আদালতের এই অন্তর্নিহিত ক্ষমতা আইনের বিকল্প নয়; বরং আইনের অনুপস্থিতিতে বিচারকের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যায়বিচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করা হয়। বিচারক আইন অনুযায়ী তার বিচারকর্ম সম্পাদনে সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচারের রায় কোনো এক পক্ষের অনুকূলে গেলে বিচারক পক্ষপাতদুষ্ট হবেন, এমন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। বিচারক শুধু তার কাছে উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণ, যুক্তিতর্ক বিবেচনায় রায় প্রদান করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে পক্ষদের দূরদর্শিতা, সময়োপযোগী পদক্ষেপ, আলামত সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সতর্কতা, সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন ইত্যাদি রায় নির্ধারণে বহুলাংশে ভূমিকা রাখে।
বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেঁদে যাবে বিচারকের অগোচরে। আর আইনজীবীরা মিথ্যাবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবেন! এ ক্ষেত্রে একটি উদাহরণের অবতারণা করা আবশ্যক। এক ব্যক্তির হাতে অপর একজনের মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটি ‘খুন’ বলে বিবেচিত। কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে একজন মানুষ অপর একজন মানুষ কর্তৃক নিহত হলেই তা খুন বলে বিবেচিত হবে না। ক্ষেত্রবিশেষে ‘নরহত্যা’ হিসেবে গণ্য হবে। আইনে নরহত্যা ও খুন দু’টি ভিন্ন অপরাধ যা দণ্ডবিধির ধারা যথাক্রমে ২৯৯ ও ৩০০-তে বর্ণিত আছে।
তেমনি একজন মানুষকে হত্যা করেও হত্যাকারী বেকসুর খালাস পাওয়ার দাবি রাখে, যা দণ্ডবিধির ৯৬ ধারায় (ব্যক্তিগত প্রতিরক্ষা অধিকার প্রয়োগকালে কৃত কোনো কিছুই অপরাধ বলে গণ্য হবে না) বর্ণিত হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে দেহ (১০০ ধারা) এবং সম্পত্তি (১০৩ ধারা) রক্ষায় আক্রমণকারীর মৃত্যু পর্যন্ত ঘটানো আইনের দৃষ্টিতে কোনো অপরাধ বলে গণ্য হবে না। এ ক্ষেত্রে একজন আইনজীবী যদি তার মক্কেলকে নির্দোষ দাবি করেন কিংবা এই যুক্তি উপস্থাপন করেন যে, আমার মক্কেল খুন করেননি, তা আইন সম্পর্কে অজ্ঞ ব্যক্তির সঠিকভাবে বোধগম্য হবে না। বরং তিনি আইনজীবীকে ‘মিথ্যাবাদী’ হিসেবে বিষোদগার করে যাবেন। এটিই স্বাভাবিক। কারণ আইনের এই সূক্ষ্ম ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ সম্পর্কে সঠিক জ্ঞানের অভাবহেতু তা অধরাই থেকে যাবে।
অতীতে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জ্ঞানপিপাসার অন্যতম খোরাক ছিল আইন। ফলে তাদের দক্ষতা, যোগ্যতা, মননশীলতা, উন্নত আচরণ আইন পেশাকে অনেক উঁচুতে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। জয় করেছিল মানুষের হৃদয়। কিন্তু এখন দিকভ্রান্ত পথিকের ভারে আইনপেশা দিগি¦দিকশূন্য! সাধারণ মানুষের মাঝে একটি ধারণা প্রচলিত রয়েছে যে, আইন পেশায় ‘আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া’র সুযোগ অনেক বেশি। তাই রাতারাতি ধনী হওয়ার আশায় অন্য পেশা ছেড়ে দিয়ে শেষ বেলাতে আইন পেশার দ্বারস্থ হন অনেকেই। নির্দিষ্ট বয়সসীমা না থাকায় অনেক সময় নীতি-নৈতিকতাহীন ব্যক্তিদের আগমনেরও সুযোগ ঘটে। ফলে হয়রানির শিকার হন বিচারপ্রত্যাশী অসহায় মানুষ। তাই বলে মুষ্টিমেয় কিছু লোকের প্রতারণার দায়ে একটি পেশাকে ঢালাওভাবে দোষারোপ করা উচিত নয়। তবে প্রতিটি পেশায় কিছু ব্যক্তি তাদের কৃতকর্মের সমালোচনা, ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তি প্রাপ্তির যোগ্য বটে। এ ক্ষেত্রে সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠায় বিচার বিভাগ গুরুদায়িত্ব পালন করে থাকে। কিন্তু বিচার বিভাগের একার পক্ষে তা অনেকাংশেই অসম্ভব।
আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি অধ্যাপক ইয়াজউদ্দিন আহমেদ ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল অতিরিক্ত বিচারকের পদ থেকে শাহিদুর রহমানকে সরিয়ে দেন। এর আগে ২০০৩ সালের এপ্রিলে হাইকোর্টের অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান সৈয়দ শাহিদুর রহমান। ওই বছরের অক্টোবরে নাসিম সুলতানা কণা নামে এক নারী ‘ঘুষের বিনিময়ে জামিন’ করানোসংক্রান্ত অভিযোগ আনেন এই বিচারকের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দেন। কাউন্সিল অভিযোগ তদন্ত করে জানায়, এই বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়নি। যেহেতু অভিযোগটি গুরুতর সেহেতু অতিরিক্ত বিচারক হিসেবে শাহিদুর রহমানের দায়িত্ব পালন করা উচিত নয়।’ এর ধারাবাহিকতায় ২০০৪ সালের ২০ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৯৬(৬) অনুচ্ছেদের ক্ষমতাবলে তাকে অতিরিক্ত বিচারকের পদ থেকে অপসারণ করেন। এ আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন শাহিদুর রহমান। ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্ট রাষ্ট্রপতির অপসারণ আদেশ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। পরে এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। আপিল আদালত ওই বিচারক আর বিচারক পদে আর ফিরতে পারবেন না বলে রায় দিয়েছেন।হ
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
seraj.pramanik@gmail.com

 


আরো সংবাদ



premium cement