৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


বজ্রপাতে প্রাণহানি

-

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বদৌলতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার কৌশল এখন বদলেছে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্ব¡াসের পূর্বাভাস পাওয়ায় মানুষ এখন আগেই নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে পারছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানুষের জানমালের হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে এর নাম ‘বজ্রপাত’। সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতে দেশে বহু মানুষের প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। গণমাধ্যমের তথ্যমতে, চলতি বছর জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা ৩০০-এর কাছাকাছি। এপ্রিলে ২১ জন হলেও শুধু মে মাসের এক-তৃতীয়াংশ সময়ে মারা গেছেন শতাধিক মানুষ। ২০১৮ সালের এপ্রিলে মারা যান ৭৬ জন। ২০১৭ সালের একই সময়ে মৃতের সংখ্যা ছিল ৩২ জন। এর আগের বছর ছিল ৪৩ জন। ওই বছর প্রায় ৩৫০ জন মারা যাওয়ায় সরকার বজ্রপাতকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত করে।
গ্রীষ্মে কালবৈশাখীর সময় বজ্রপাতে প্রতি বছরই বাংলাদেশে প্রাণহানি ঘটছে। তবে গত কয়েক বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। বিশে^ বজ্রপাতপ্রবণ দেশ বা অঞ্চলগুলোর মধ্যে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটছে বাংলাদেশে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতি বছর বজ্রপাতে মোট মৃতের এক-চতুর্থাংশ এ দেশে হয়ে থাকে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই মাঠে, খোলা জায়গায় বা নদীতে কাজ করার সময় বজ্রপাতে আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছেন।
আবহাওয়া অধিদফতরের ভাষ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছরের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০ বার বজ্রপাত হয়। সাম্প্রতিক সময়ে করা যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণায় জানা যায়, হিমালয়ের পাদদেশ থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত বলেই বাংলাদেশ বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। আমাদের দেশের বেশ কিছু জায়গা বজ্রপাতপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল অন্যতম। গ্রীষ্মকালে এ অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশি থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সাধারণত যেসব এলাকায় গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, সেসব এলাকায় যে মেঘের সৃষ্টি হয়, তাতে বজ্রপাতের আশঙ্কা থাকে। বাংলাদেশের হাওরাঞ্চলে জলীয়বাষ্পের পরিমাণ বেশি বলে এ অঞ্চলে বজ্রপাতও বেশি হয়। সাধারণত আমাদের এখানে এপ্রিল মাসকে বজ্রপাত শুরুর সময় ধরা হয়। তবে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আকাশের ঘন কালো মেঘের উপস্থিতির কারণে বজ্রপাতের আশঙ্কা বিরাজ করে।
আন্তর্জাতিক মহলে জলবায়ু পরিবর্তনকে বিশ্বে বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার একটি কারণ বলা হলেও এটাকে প্রধান কারণ বলে স্বীকার করা হচ্ছে না। আবার বজ্রপাতের হার বেড়ে যাওয়ায় জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণতার বিষয়টি অপ্রাসঙ্গিকও বলা হচ্ছে না। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞের মতে, বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার পেছনে বায়ুমণ্ডলের উষ্ণতা বৃদ্ধির দায় সর্বাধিক। তাদের হিসাবে, তাপমাত্রা এক ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ১০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে দশমিক ৭৪ শতাংশ। সাধারণত বছরের এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত তাপমাত্রা স্বাভাবিক গড় তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। এ কারণে এ সময়েই বজ্রাঘাতের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে। মাত্রাতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে বায়ুমণ্ডল স্বাভাবিকভাবে উত্তপ্ত হয়ে আছে। এর মাত্রা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এ কারণে জলীয়বাষ্প যখন এর সংস্পর্শে আসছে বজ্রপাতও আগের তুলনায় বেশি হচ্ছে। এটা ছাড়া বিভিন্ন কাজে জ্বালানির অত্যধিক ব্যবহার, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া, বায়ুমণ্ডলে গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বৃদ্ধি, অব্যাহত বায়ুদূষণ, আবহাওয়ার বিরূপ পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত বেড়ে যাওয়া, মোবাইল ফোনের ব্যবহার বৃদ্ধি ইত্যাদি বজ্রপাত বেড়ে যাওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। আমাদের দেশে বজ্রপাত সম্পর্কে যথাযথ সচেতনতা ও সতর্কতার অভাব, জনসংখ্যার মাত্রাতিরিক্ত ঘনত্ব, বড় গাছপালা কমে যাওয়া, মোবাইল ফোনের টাওয়ার, সুউচ্চ ভবনে বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা নিশ্চিত না করায় বজ্রাঘাতে মানুষের মৃত্যু আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০১০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে সারা দেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা দুই হাজার ৮১ জন। বজ্রপাত এমন একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যার নির্দিষ্ট দিন বা ক্ষণ আগে বলা যায় না। তবে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং সচেতনতা বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। পশ্চিম, দক্ষিণ-পশ্চিম, উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর আকাশে মেঘের গর্জন শুনলেই নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়া এবং কোনো অবস্থাতেই তখন খোলা জায়গা যেমনÑ মাঠ, রাস্তাঘাট, নদী, সাগরপাড়ে অবস্থান না করা।
আবহাওয়াবিদদের মতে, বজ্র ঝড় শুরুর তিনটি ধাপ আছে। শুরুতেই বজ্রপাত হয় না। প্রথমে মেঘ তৈরি হতে থাকে এবং ওই সময় আকাশের অবস্থা খুব ঘন কালো হয় না। একটু কালো মেঘের মতো তৈরি হয়। সামান্য বৃষ্টি ও হালকা বিদ্যুৎ চমকের সময় যদি মানুষ সচেতন হয়; তবে মৃত্যুঝুঁকি কমতে পারে। তা ছাড়া পানি বিদ্যুৎপরিবাহী বলে বজ্রপাতের সময় পানির সংস্পর্শে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ। এসব প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
সাম্প্রতিক সময়ে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ব্যবহৃত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও বজ্রপাতসংক্রান্ত সচেতনতা ও সতর্কতা বিস্তৃত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। তবে বজ্রপাতের মতো পূর্বাভাসহীন দুর্যোগে মৃত্যুর হার কমাতে সচেতনতা ও সতর্কতার পাশাপাশি জ্বালানি ও মোবাইল ফোনের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি। আর সর্বাপেক্ষা যেটি খুব গুরুত্বপূর্ণ তা হলোÑ বজ্রপাতপ্রবণ এলাকা বা অঞ্চলে বড় বড় গাছ যেমনÑ তাল, বাবলা, বট, সুপারি প্রভৃতিরর পরিমাণ বাড়ানো। কারণ বজ্র সরাসরি মাটিতে পড়ে না, বিদ্যুৎপরিবাহীর ওপর পড়ে। এরপর পরিবহন পদ্ধতিতে বজ্রের বিদ্যুৎ মাটিতে গিয়ে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। মানুষের শরীর বিদ্যুৎপরিবাহী। এ কারণে মানুষের ওপর বজ্রপাত হয়। তাই ফাঁকা জায়গায় বজ্র পড়ার মতো কোনো বিদ্যুৎপরিবাহী পদার্থের পরিবর্তে মানুষ থাকলে তখন তা মানুষের ওপর আঘাত হানে। আমাদের দেশে বেশির ভাগ গাছ লাগানো হয় সড়কের পাশে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে বজ্রপাতে মানুষের আঘাতের আশঙ্কা খুব একটা কমে না। তাই তারা খোলা মাঠে বা কৃষিজমির আইলে গাছ লাগানোর কথা বলেন। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে টেকসই পরিকল্পনার ভিত্তিতে লম্বা গাছ লাগানো দরকার। হ
লেখক : শিক্ষক, ভাগ্যকুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বান্দরবান সদর।

 


আরো সংবাদ



premium cement