২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অকার্যকর সরকারের প্রমাণ

- ফাইল ছবি

সরকারের কার্যকারিতা যে যথার্থই কমে গেছে, সাম্প্রতিক ঘটনাবলি তা প্রমাণ করে। গত দুয়েক সপ্তাহের ঘটনাবলি নাগরিক সমাজে আলোচিত ও সমালোচিত হচ্ছে। দেশব্যাপী গণপিটুনিতে অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনা সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার নির্দেশক। এসব ঘটনা যে আকস্মিকভাবেই ঘটছে, তা বলার উপায় নেই। সমাজ বা রাষ্ট্রে যে গতি-প্রকৃতি ও স্বভাব-বৈশিষ্ট্য প্রতিভাত ও প্রমাণিত হয়, সেগুলো সমাজেরই রোগ শোক ও ক্ষোভ ক্রোধকে ধারণ করে। দীর্ঘকাল ধরে লালিত এসব সঙ্কট সমস্যার দায় সরকার কখনো অস্বীকার করতে পারে না। অতীত যেমন বর্তমান নির্মাণ করে এবং নির্দেশ করে, ভবিষ্যৎ ঠিক তেমনি প্রতিটি ঘটনার পেছনে যে ঘটনা রয়েছে তা অনুধাবন করতে পারলে ওইসব সমস্যার উৎসমূল খুঁজে পাওয়া যাবে।

আমাদের এই সমাজ নিরবচ্ছিন্নভাবে ভালো বা মন্দের পরিচয় বহন করে না। ভালো-মন্দ মিলেই সমাজ। সমাজে যেমন অপরাধপ্রবণ মানুষ আছে, তেমনি আছে ভালো মানুষের সমাহার। মানুষকে আল্লাহ বলেছেন, আশরাফুল মাখলুকাত- সৃষ্টির সেরা জীব। আবার এই মানব চরিত্র সম্পর্কে বারবার উচ্চারিত হয়েছে ভর্ৎসনা। জাগতিক মনীষীরা মানব চরিত্র সম্পর্কে ইতিবাচক ব্যাখ্যার চেয়ে বরং নেতিবাচক ব্যাখ্যাই বেশি দিয়েছেন। মনীষী হবস ‘স্বার্থপরতা, সঙ্কীর্ণতা, সীমাবদ্ধতা, নিষ্ঠুরতা ও পাশবিকতা’ বিবেচনা করে। মানব চরিত্র নির্ণয় করেছেন। প্রাচীন ভারতের বিদ্বজ্জনেরা মানুষের পাঁচটি মৌলিক নেতিবাচক বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন। এগুলো হলো- ‘কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ ও মাৎসর্য’।

মানুষের সমাজে ইতিবাচক গুণের চর্চা হয়ে থাকে। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র মানুষের ভালো গুণ- দয়া-মায়া, সাহস-সততা, নিষ্ঠা-কর্তব্যবোধ ও সহযোগিতা-সহমর্মিতা লালন করে। যখন এর বিপরীত চর্চা হয়, তখন মানুষের ওপর পশুত্ব বিজয় অর্জন করে। রাষ্ট্র যখন দুষ্টের দমনের পরিবর্তে লালন শুরু করে, তখন সৎ গুণাবলির বিনাশ ঘটে এবং অসৎ গুণাবলি প্রভুত্বের আসন দখল করে। গোটা সমাজ ও রাষ্ট্রে অচিরেই এর ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আর এ দায় থেকে সাধারণ মানুষ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও শাসকশ্রেণী- কেউই মুক্তি পেতে পারেন না।

সমাজের প্রভুত্ব, নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব যেহেতু শাসক শ্রেণীর। সুতরাং তাদের দায়ভার সামগ্রিক। নাগরিকদের জীবন, সম্মান ও সম্পদ রক্ষা করা সরকার ও রাষ্ট্রের মৌলিক কর্তব্য। বর্তমান সরকার রাষ্ট্রের এই মহান কর্তব্যকে ভুলে গিয়ে প্রায় নিত্যই তাদের জীবন সংহার করছে, সম্মানহানির কারণ ঘটাচ্ছে ও সম্পদ লুটে নিচ্ছে। বন্দুকযুদ্ধ, পুলিশি হেফাজতে মৃত্যু ও জঙ্গি নিধনের পর কয়েক সপ্তাহ ধরে সাধারণ মানুষের জীবনের জন্য যা হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হচ্ছে গণপিটুনি। মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিস কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ৩৬ জন গণপিটুনিতে মারা গেছে। জুলাই মাসের প্রথম দিকে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৩-এ। এ লেখা প্রকাশিত হওয়ার সময় হয়তো সংখ্যাটি ৫০ অতিক্রম করতে পারে।

গত দু-এক সপ্তাহে পদ্মা সেতুর জন্য মানুষের মাথা প্রয়োজন এবং শিশুদের দিয়ে এই মাথা পূরণ করা হবে- এই গুজবে জনমতে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। এই গুজব ও আতঙ্ককে কেন্দ্র করে কারণে-অকারণে মানুষ ব্যাপক সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠেছে। শিশু সংশ্লিষ্ট যে কেউ পথেঘাটে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হচ্ছেন। জনগণ বিবেক ও বিচারবোধ হারিয়ে উন্মত্ত আচরণ করছে। পিটিয়ে মারছে হয়তো নিরীহ মানুষকে। দুয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করা যাক, তসলিমা বেগম রেনু নামের একজন মা তার সন্তানকে। একটি স্কুলে ভর্তি-সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। জনগণ সন্দেহ করে তাকে। সহিংস আক্রমণের শিকার হন এই মহিলা। ২৩ জুলাই নয়া দিগন্ত ১৪ জনের গণপিটুনির সংবাদ প্রকাশ করে। প্রকাশিত অন্যান্য সংবাদে জানা যায়, দুয়েক দিনে ৯ জেলায় গণপিটুনিতে আহত হয়েছে ৩০ জন।

এটি যেন মহামারীর আকার ধারণ করেছে। কী কারণে এই ভয়াবহতার সৃষ্টি হলো, তার কারণ বিশ্লেষণও চলছে। বিবিসি বাংলার একটি প্রতিবেদনে বলা হয়- মানুষের মধ্যে আতঙ্কবোধ, বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা, সহনশীলতার অভাব, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অকার্যকারিতা ইত্যাদি হচ্ছে গণপিটুনির প্রধান কারণ। একজন সমাজ বিশ্লেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ গণপিটুনির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে লিখেছেন, ‘রাষ্ট্রে যখন আইনের শাসন থাকে, ন্যায়বিচার থাকে, মানুষের মনে শান্তি থাকে, তখন অপরাধের মাত্রা থাকে খুব কম। অব্যক্ত চাপা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে। অব্যক্ত ক্ষোভ ও হতাশার কারণে অসুখী মানুষের মধ্যে নির্যাতনস্পৃহার প্রবণতা দেখা যায়। শক্তিমানের অপকর্মের যখন প্রতিবাদী হওয়ার পরিবেশ থাকে না, তখন অসহায় ও দুর্বলকে নির্যাতন করে একশ্রেণীর মানুষ অপার আনন্দ পায়। গণপিটুনিতে মানুষ হত্যাকে সেই শ্রেণীতে ফেলতে পারি।’

সরকারের অকার্যকারিতার প্রমাণ সর্বত্র। প্রথমত, গুজব রোধে সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট। সরকারের প্রশস্তি প্রচারে তারা সব গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে। অথচ এ ক্ষেত্রে তাদের কোনো তৎপরতা তেমন চোখে পড়ে না। পুলিশ সদর দফতরের সর্বশেষ প্রতিবেদনটি ঘটনা প্রকাশ করেছে। অথচ তারা আর একটু সচেতন হলে গুজব ছড়ানোর সাথে সাথে ব্যবস্থা নিতে পারত। দ্বিতীয়ত, গণপিটুনির ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, পুলিশ মানুষের জীবন রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে। মারমুখো জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন কাজ। এ কঠিন কাজকে শুধু শক্তি প্রয়োগ করে দমন করা যায় না। ইতঃপূর্বে সরকারবিরোধী তৎপরতা দমনে পুলিশের সাথে সাথে তাদের ডাণ্ডা বাহিনীর অনুসরণ লক্ষ করা যেত। ডাণ্ডা দিয়ে ঠাণ্ডা করার পক্ষপাতী আমরা নই। কিন্তু সচেতনতা বাড়ানো ও অঘটন প্রতিরোধে তাদের সংগঠনগুলোর কোনো ইতিবাচক কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। তৃতীয়ত, জনগণের ধারণা পুলিশে দিলে তারা ঘুষ খেয়ে অপরাধীকে ছেড়ে দেবে।

এই ধারণা থেকে তারা অপরাধীকে নিজেরাই শাস্তি দিতে চায়। আইন ও শৃঙ্খলার কাজ সাধারণের হাতে তুলে নেয়া কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু তাদের আস্থা-বিশ^াস ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রেফতার ও মামলা কোনো সমাধান নয়, বরং এগুলো সাধারণ মানুষের জন্য আরো দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তা ছাড়া পুলিশ যেকোনো ঘটনাকে ব্যবহার করে যে কাউকে হয়রানি করতে পারে। তাই সরকার যে আস্থা ও বিশ^াসের সঙ্কট অতিক্রম করছে, সেই নির্মম সত্য তাদের অনুধাবন করতে হবে। এ ব্যাপারে পুলিশের ত্বরিত ও কার্যকর ব্যবস্থায়ই মানুষের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে। চতুর্থত, যেকোনো ঘটনাকে রাজনৈতিক মাত্রা দেয়ার সরকারি প্রবণতা। রানা প্লাজা ধসের কারণ বিএনপি-জামায়াতের ধাক্কাÑ এ কথা বলে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর হাসির খোরাক হয়েছিলেন। এবার প্রায় একই রকম কথা বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, ‘গণপিটুনি বিএনপি-জামায়াতের ষড়যন্ত্র।’ মন্ত্রীর বক্তব্য এ রকমÑ ‘সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে কোনো একটি ঘটনা ঘটলে কিছু দিন ওই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

যেমন পুরান ঢাকার অগ্নিকাণ্ডের পরবর্তী কিছু দিনের মধ্যে পরপর কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটল। আবার পরপর কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটল। এখন আবার গণপিটুনি দিয়ে সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটছে। এগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়। এগুলো আসলে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরের নিখুঁত ষড়যন্ত্র।’ মন্ত্রীর এ মন্তব্য ইতোমধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছে। পঞ্চমত, প্রশাসনের নিকৃষ্ট দলীয়করণ হচ্ছে মানুষের আইন হাতে তুলে নেয়ার আরেকটি যুক্তি। দীর্ঘকাল ধরে ওসি ও ডিসিরাই হচ্ছেন জনগণের মালিক-মোক্তার। দাবি করা হয়, তারা নিরপেক্ষ ও নৈর্ব্যক্তিকভাবে ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করবেন এবং ব্যবস্থা নেবেন। দীর্ঘ এক যুগের আওয়ামী শাসনে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা ও ন্যায়বিচার বিনষ্ট হয়েছে। এ কথা প্রমাণ করার জন্য সাম্প্রতিক ঘটে যাওয়া নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনাবলি উল্লেখ করা যায়। এখন আর দল ও সরকারের মধ্যে, স্থানীয় আওয়ামী নেতৃত্ব ও তৃণমূল পর্যায়ের প্রশাসনের মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। সবই একাকার। ফলে কারো ওপরই মানুষ আস্থা রাখতে পারছে না মানুষ। এভাবে রাজধানী থেকে গ্রাম পর্যন্ত যে আইন ও প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল তা এখন বিপর্যয়ের মধ্যে রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিকতার শেষ ভরসাটুকুও চলে গেছে। সুতরাই ‘হতাশা থেকে হিংস্রতার জন্ম’ স্বাভাবিক বিষয়।

সমাজ এ কয়েক সপ্তাহের রাজপথের নির্মমতায় গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিদ্বজ্জনেরা এখন স্বীকার করছেন, এটাও সত্যি কথা যে, মানবিক মূল্যবোধের বড় রকমের অবক্ষয় ঘটেছে। আর সে ব্যর্থতার দায়ও সরকারের। তার কারণ তাদের প্রচলিত রাষ্ট্র ও সরকার মানবিক মূল্যবোধ গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। আরো স্পষ্ট করে বলা যায়, সমাজের মধ্যে পারস্পরিক হিংসাবিদ্বেষ ও সহিংসতা বাড়াতে সরকার অব্যাহতভাবে উনকানি দিয়ে যাচ্ছে। যারা সমাজে ন্যায় ও সত্যের প্রতীক বলে বিবেচিত তারা আজ সমাজে সবচেয়ে নিগৃহীত। এমনকি সমাজে ভালো কথা বলার ও ভালো কাজ করার পরিবেশ পর্যন্ত নষ্ট করে দিয়েছে এই সরকার। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত সবাই।

জনগণের পকেট কেটে নিজেদের পকেট ভারী করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত সবাই। নাগরিক সাধারণকে নৈতিক শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে একটি সৎ ও সাহসী জাতি গড়ে তুলতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। তত্ত্বগতভাবে এবং বাস্তব কার্যক্রমে কোথাও সততা ও সাহসিকতা পুরস্কৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে একটি নৈতিক জাতি গড়ে উঠবে, শাসক দলের সোনার ছেলেদের হাতে তা আজ বিপর্যস্ত। গণমাধ্যম আজ তোষামুদি ও চাটুকারদের দখলে। আমলাতন্ত্র সরকারের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে। বিচারকরা যে কত অসহায়, সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার বড় প্রমাণ। সুতরাং অকার্যকর সরকারব্যবস্থায় উন্মত্ত জনতার কার্যকারিতা শাসক দলের অপশাসনেরই অনিবার্য প্রতিক্রিয়া। গণসম্পৃক্ত বিধিব্যবস্থা তথা গণতন্ত্রের প্রয়োগ ও প্রতিষ্ঠা হতে পারে এর একমাত্র প্রতিষেধক।

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement

সকল