০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


জিয়াউর রহমানের উত্তরাধিকার

- ফাইল ছবি

জিয়াউর রহমান অবশেষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭১ সালে অর্জিত স্বাধীনতার মাঝেও যে প্রযতœ ও পরনির্ভরশীলতা ছিল তা এ সময়ে বিদূরিত হয়। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহি-জনতার বিপ্লব’কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত মাইলফলক মনে করেন। দীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসন ও অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ এ অঞ্চলের মানুষকে কখনোই সার্বভৌমত্বের পরিপূর্ণ স্বাদ উপলব্ধি করতে দেয়নি। সেই সাথে গণতন্ত্রের অনুশীলনের অনুপস্থিতি এই জাতিকে নিয়মতান্ত্রিক ও সমঝোতার ভিত্তিতে বিরোধ-মীমাংসার সংস্কৃতি উপহার দেয়নি। ফলে স্বাধীনতা অর্জনের স্বল্পকালের মধ্যেই জাতি ‘এক নেতা এক দেশ’ তথা একদলীয় শাসনব্যবস্থার মুখোমুখি হয়। মধ্য আগস্টের নির্মম ঘটনাবলি ঘটে।

বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকতার পরিবর্তে সম্মোহনী নেতৃত্ব দিয়ে পরিচালিত হয়। সে কারণেই সমাজের গহিন গভীরে গণতান্ত্রিক মন-মানসিকতা প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সেই অনিশ্চয়তায় সৃষ্ট রাজনৈতিক শূন্যতা পূরণে জিয়াউর রহমান যখন জাতির ‘ত্রাণকর্তা’ হিসেবে আবির্ভূত হন, তখন গোটা জাতি তাকে স্বাগত জানায়। একটি গভীর শূন্যতা ও অনিশ্চয়তার সমাপ্তি ঘটে। জিয়াউর রহমান তার পাঁচ বছরের শাসনামলে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা সত্ত্বেও জনগণকে আস্থা, বিশ্বাস ও স্থিতিশীলতায় অভিষিক্ত করেন। অর্জিত হয় জাতীয় ঐক্য। প্রতিষ্ঠিত হয় বহুদলীয় গণতন্ত্র। আত্মজাগৃতির উন্নয়ন কৌশলে আন্দোলিত হয় রাষ্ট্র। সৃষ্টি হয় এক সচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণী। এই মধ্যবিত্ত শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আরো কিছুকাল ধরে। ‘জিয়ার পক্ষ থেকে এটাই ছিল সম্ভবত তার দেশের প্রতি শ্রেষ্ঠ উপহার। (সৈয়দ মাহমুদ আলী, ১৯৯৬ : ১৭২)। আর এভাবেই স্থাপিত হয় আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি।

জিয়াউর রহমান ছিলেন প্রথাগত সামরিক শাসক থেকে ব্যতিক্রম। সামরিক অভ্যুত্থান ও প্রতি-অভ্যুত্থানের ঘটনাবলির মধ্য দিয়ে তার শাসনক্ষমতার প্রতিষ্ঠা ঘটলেও তিনি সামরিক অভ্যুত্থানের নায়ক ছিলেন না। তিনি সামরিক আইন জারি করেননি। ইতিহাসের অপরিহার্যতায় নেপোলিয়ানের মতো তিনি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছেন মাত্র। তার শাসনব্যবস্থার প্রতি কোনো চ্যালেঞ্জ ছিল না। গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন ছিল না। বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানী তার সুশাসনের প্রতি এতটাই আকৃষ্ট ছিলেন যে, তিনি আশু নির্বাচনের পক্ষপাতী ছিলেন না। কিন্তু জিয়াউর রহমান দ্রুতই ‘বেসামরিকীকরণ প্রক্রিয়া’ শুরু করেন। বাকশাল ব্যবস্থায় যে বহুমাত্রিক রাজনৈতিক দলের বিলুপ্তি ঘটে, তিনি তার পুনরুজ্জীবন ঘটান। ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতির চূড়ান্তপর্যায় অর্জিত হয়। প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত অনেক সীমাবদ্ধতার মাঝেও এই সংসদকে সফল মনে করেন। (আলমা, ২০০১: ১৯৬)।

ক্রমেই সামরিক বাহিনী থেকে তার ক্ষমতার ভিত্তি স্থানান্তরিত হয় জনারণ্যে। সারা দেশে ‘সৎ মানুষের খোঁজে’ বের হন তিনি। অবশেষে গঠিত হয় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল- বিএনপি। সব ভেদাভেদ, সব বিভাজন ও রাজনৈতিক সঙ্কীর্ণতা অতিক্রম করে সব মত ও পথের দেশপ্রেমিক মানুষের সমন্বয়ে বিএনপি তার শাসনকালে প্রকৃত গণসংগঠনের রূপ পায়। জাতি গঠনের বিভিন্নপর্যায়- খাল খনন, খাদ্য উৎপাদন দ্বিগুণ করা, নিরক্ষরতা দূর করা, জনসংখ্যা রোধ, যুবসমাজকে গঠনমূলক কাজে নিয়োগ ও গ্রাম প্রতিরক্ষা দল গঠনের মাধ্যমে তিনি চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে গিয়ে জনগণকে উৎপাদন ও উন্নয়নে উদ্বুদ্ধ করেন। মার্কিন সাংবাদিক মার্কাস ফ্রান্দা বলেন, ‘তিনি হক সাহেব ও শেখ সাহেবের চেয়েও বাংলাদেশকে বেশি দেখেছেন।’

জিয়াউর রহমান জাতিকে শুধু বস্তুগত অগ্রগতি ও আধুনিক উন্নয়ন কৌশল দিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি জাতিকে মৌলিক আদর্শে উজ্জীবিত করতে চেয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত জাতিচরিত্র এবং একক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জাতি পরিচয় অনুধাবন করেন। তিনি অতীতের শাসকগোষ্ঠী অনুসৃত আরোপিত ও জনবিচ্ছিন্ন সাংবিধানিক বৈশিষ্ট্য নাকচ করেন। তিনি শাসনতন্ত্রে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নাড়ির পক্ষে অবস্থান নেন। জিয়াউর রহমান সংবিধানে ‘আল্লাহর প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস’ সংযোজন করেন।

সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্র প্রত্যাহার করেন। কথিত প্রতিবেশী প্রভাবিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে সমন্বয়মূলক বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের আদর্শ গ্রহণ করেন। জিয়াউর রহমান তার লিখিত ‘একটি জাতির জন্ম’ নিবন্ধে ভাষা, ধর্ম, নৃতত্ত্ব, ইতিহাস-ঐতিহ্য, মুক্তিযুদ্ধ এবং ভৌগোলিক বিভাজনের নিরিখে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের ভিত্তি রচনা করেন। উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও চরম ইসলামী জাতীয়তাবাদের মাঝামাঝি বাংলাদেশী জাতিসত্তা নির্ণয় করে তিনি বাস্তব মনোভঙ্গির প্রকাশ ঘটান। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা মনে করেন, আর কিছু না হলেও জাতিসত্তার এই নতুন পরিচিতির জন্য চিরকাল তিনি বেঁচে থাকবেন।

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, গতানুগতিক সামরিক চরিত্রের বিপরীতে জিয়াউর রহমান একদলীয় শাসনব্যবস্থা বাতিল করে বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৭ সালে যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু করেন, তখন আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল কার্যক্রম শুরু করে। আওয়ামী লীগ এ সময় ‘বাকশাল’ পুনরুজ্জীবিত না করে নতুন করে আওয়ামী লীগ গঠনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেনি। এরই ধারাবাহিকতায় জিয়াউর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা দেশে ফিরে আসেন এবং আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ১৯৭৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জিয়াউর রহমানের বিপরীতে ড. কামাল হোসেন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ১৯৭৯ সালের সংসদীয় নির্বাচনে পরিবেশ এতটাই অনুকূল ছিল যে, সব দল ও মতের অবাধ প্রতিনিধিত্ব লক্ষ করা যায়। জিয়াউর রহমানের বিপুল জনপ্রিয়তা এসব নির্বাচনে বিজয়ের প্রধান কারণ ছিল।

এভাবে জিয়াউর রহমান সেনাছাউনি থেকে জনগণের মধ্যে হিরো হয়ে যাওয়ায় সেনাবাহিনীর একটি অংশ তার ওপর অসন্তুষ্ট হয়। বিশেষ করে তাদের কথিত ‘স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি’কে ক্ষমতায়িত করায় তারা রুষ্ট হয়। তার মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে ২০ মে ১৯৮১ সালে অনুষ্ঠিত সেনাবাহিনীর কর্মকর্তাদের এক শীর্ষ বৈঠকে জেনারেল মঞ্জুর তার এসব ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করেন। (সৈমাআ, ১৯৯৬ : ১৫৪)। জিয়াউর রহমান তার অনুসৃত কৌশলের সপক্ষে জাতীয় উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। কিন্তু তার ব্যাখ্যা বিরোধী পক্ষের ক্ষোভকে প্রশমিত করেনি। পরবর্তীকালে জেনারেল মঞ্জুর পাকিস্তান-ফেরত জেনারেল এরশাদের নিয়োগ ও পূর্বোক্ত বিষয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের মধ্যে বিষ ছড়াতে থাকেন। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে তিনি মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের সমাবেশ ঘটান।

দুই.
চট্টগ্রাম সেনানিবাসে জেনারেল মঞ্জুরের নিয়োগের ঘটনাটি বিরোধের সূচনাপর্ব বলে মনে করা হয়। মঞ্জুর ঢাকা সেনা সদর দফতরে সিজিএস হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এটি সেনাপ্রধানের পরবর্তী পদ। সামরিক সরকারের ব্যবস্থাপনায় সিজিএস পদ ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জিয়াউর রহমানের বিশ্বস্ত ব্যক্তি হিসেবে তার পরিচিতি ছিল। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে জিয়ার উপপ্রধান থেকে প্রধান সামরিক শাসক হতে তার বলিষ্ঠ ভূমিকা ছিল। তিনি পরবর্তী সেনাপ্রধান হবেন বলে জনশ্রুতি ছিল। কিন্তু ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা হয় তা প্রতিহত করতে তার ব্যর্থতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। হতাশ জিয়াউর রহমান তাকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে জিওসি হিসেবে বদলি করেন। সিজিএসের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে চট্টগ্রামে অগুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োজিত হওয়ায় মঞ্জুর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তিনি তার নতুন নিয়োগকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি জিয়াউর রহমানের অবহেলা ও অবমূল্যায়ন হিসেবে তুলে ধরেন।

ইতোমধ্যে এরশাদকে সেনাপ্রধান করা হয়েছে। মঞ্জুর তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার দেখে চরমপন্থার দিকে অগ্রসর হন। জিয়াউর রহমান মঞ্জুরসহ মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কঠোর না হয়ে ভারসাম্যের নীতি অনুসরণ করেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা অংশ মঞ্জুরকে তাদের নেতা ও অভিভাবক মনে করে। তারা মনে করে, মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে দেশের শাসনব্যবস্থায় তাদের করণীয় রয়েছে। উল্লেখ্য, মিয়ানমার ও ইন্দোনেশিয়ার মতো যেসব দেশে সেনাবাহিনী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সেই উত্তরাধিকার তারা দাবি করে আসছে। উভয় দেশে এই সে দিন বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেও মূলত সেনাবাহিনী পর্দার অন্তরাল থেকে দেশ শাসন করছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সিলভার স্টেইন এদের ‘আর্মি অব দ্য লিবারেশন’ বা মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনী নামে অভিহিত করেছেন। যা হোক, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও একই অভিধা প্রয়োগ করা যায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অংশগ্রহণকারীরা পরবর্তীকালে তাদের কার্যক্রমের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ও জনস্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়ার অভিযোগ আনেন। একই অভিযোগ উত্থাপিত হয় জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে। মঞ্জুরের নেতৃত্বে সেনাবাহিনীর এই অংশ জিয়াউর রহমানকে হত্যার জন্য ১৯৮০-১৯৮১ সালে তিনবার উদ্যোগ নেয়। (ম্যাসকারেনহাস, ১৯৭৬ : ১৫৭-৫৯)।

জিয়াকে হত্যার প্রথম চক্রান্ত হয় ১৯৮০ সালের ১৯ ডিসেম্বর। তখন তিনি বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ক্যাডেটদের সমাপনী কুচকাওয়াজে অংশ নেন। নির্ধারিত নৈশভোজে মঞ্জুরের লোকেরা ব্যক্তিগত অস্ত্র নিয়ে প্রবেশ করতে চাইলেও অবশেষে তাদের নিরস্ত্র হয়েই ঢুকতে হয়। ফলে তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। তাদের দ্বিতীয় ষড়যন্ত্র ছিল ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এ সময় প্রেসিডেন্ট কক্সবাজারে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সম্মিলিত মহড়া দেখতে গিয়েছিলেন। ভোজসভায় তাদেরকে জিম্মি করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। নানা জটিলতায় এটিও পরিত্যক্ত হয়। প্রেসিডেন্টের প্রতি তৃতীয় এবং সর্বশেষ ব্যর্থ চেষ্টা নেয়া হয় প্রকৃত হত্যার মাত্র ২০ দিন আগে। প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রাম বন্দরে ড্রাইডক উদ্বোধন করতে গিয়েছিলেন। যে সুইচ টিপে তিনি তা উদ্বোধন করবেন, তা বিস্ফোরকে পূর্ণ ছিল।

তাতে হাত দেয়ার আগেই ষড়যন্ত্র উন্মোচিত হয়। এভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। এসব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ায় জিয়াউর রহমান অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। তার সব নিরাপত্তা কর্মকর্তার পরামর্শ অগ্রাহ্য করে তিনি শেষবারের মতো চট্টগ্রাম গমন করেন। মঞ্জুরের মতিগতির মোটামুটি খোঁজখবর তিনি রাখছিলেন। ২৫ মের দিকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে, তাকে ঢাকার কমান্ড অ্যান্ড স্টাফ কলেজে প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হবে। এ ধরনের পদ সম্মানজনক, কিন্তু কমান্ডবিহীন। ফলে মঞ্জুর হবেন সেখানের দাঁতবিহীন বাঘ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এ আদেশ বাস্তবায়ন হওয়ার আগেই প্রেসিডেন্ট আক্রান্ত হন।

নির্মম হত্যার ঘটনাটি ছিল পরিকল্পিত ও আকস্মিক। সাধারণ সৈনিক এবং অফিসারদের মাঝে জিয়াউর রহমান অসম্ভব জনপ্রিয় থাকায় ষড়যন্ত্রকারীরা হত্যার কথা গোপন রাখে। বলা হয়, প্রেসিডেন্টকে সেনানিবাসে নেয়া হবে। সেখানে তাকে দিয়ে কয়েকটি ঘোষণা স্বাক্ষরের পর ছেড়ে দেয়া হবে। এসব ঘোষণার মধ্যে রয়েছে- দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদদের পদচ্যুতি এবং সেনাবাহিনীর সরকার গঠন। এসব জনপ্রিয় কথায় সেনাবাহিনীর কিছু লোক তুষ্ট হয়।

এ দিকে ১ জুনের মধ্যে ঢাকায় যোগদান করতে বলায় এবং ৩০ জুন সকালে প্রেসিডেন্ট ঢাকায় চলে আসার মুহূর্তে মঞ্জুরকে সি অফ প্রোগ্রামে আসতে বারণ করায় সে ‘নাও অর নেভার’ অবস্থানে চলে যায়। আর সেই রাতেই মঞ্জুর তার অনুগত সেনাদের সার্কিট হাউজে পাঠায়। প্রেসিডেন্টের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা কর্নেল মাহফুজ বিশ্বাসঘাতকতা করে হত্যাকারীদের সহায়তা করে। রাতে বৃষ্টি হচ্ছিল। তার মধ্যেই কিছু ঘাতক অফিসার তিনটি গাড়িতে সার্কিট হাউজে আসে। রাত ৪টায় তারা কোনো রকম বাধা ছাড়াই সার্কিট হাউজে প্রবেশ করে। রকেটলাঞ্চার নিক্ষেপ করে তারা অপারেশনের জানান দেয়। অন্যরা সাবমেশিনগান, রাইফেল ও গ্রেনেড ব্যবহার করে। প্রবেশপথেই তারা একজন পুলিশ প্রহরী এবং দু’জন সশস্ত্র কর্মকর্তাকে হত্যা করে। প্রেসিডেন্ট গার্ড রেজিমেন্টের চারজন সৈনিককে হত্যা করে। প্রেসিডেন্টের কক্ষ শনাক্ত করতে না পেরে তারা ড. আমিনা রহমানের কক্ষের দরজা ভাঙে। হত্যাকারীরা চিৎকার করে বলে কোথায় প্রেসিডেন্ট? গভীর আস্থায় বিশ্বাসী প্রেসিডেন্ট কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসেন। প্রেসিডেন্টের পরনে ছিল তখন শুধু পাজামা। দু’জন জুনিয়র অফিসারকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন, কিন্তু ইতোমধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মতিউর তার এসএমজি থেকে গুলি নিক্ষেপ করে। এসএমজির ম্যাগজিন খালি না হওয়া পর্যন্ত মতি অনবরত গুলি বর্ষণ করে। প্রেসিডেন্টের রক্তাক্ত দেহ মেঝেতে পরে থাকে। এভাবে শেষ হয়ে যায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানের সাহসী জীবন। সমাপ্তি ঘটে এক মহানুভব শাসনের।

তিন.
জিয়াউর রহমানের জীবন অবসান ঘটেছে, কিন্তু জিয়াউর রহমানের আদর্শের অবসান ঘটেনি। পরবর্তী ইতিহাস প্রমাণ করেছে যে, ‘এক জিয়া লোকান্তরে, লক্ষ জিয়া ঘরে ঘরে’। মৃত্যুর চার দশক পরও তার জীবন, কর্ম ও আদর্শ চিরসমুজ্জ্বল। আজো বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ তার জন্য এবং তার উত্তরাধিকারের জন্য অশ্রুপাত করে। উত্তরাধিকারের অর্থ দুটো- রক্তের উত্তরাধিকার ও আদর্শের উত্তরাধিকার। যেহেতু তার রক্তের উত্তরাধিকারীরা এ সময় ক্ষমতার প্রতি একমাত্র চ্যালেঞ্জ, সেহেতু তাদের প্রতি আরোপিত হয়েছে জেল, জুলুম ও নির্বাসন। মিথ্যা অপবাদে জিয়াউর রহমানের অর্ধাঙ্গিনী এ দেশের কোটি কোটি মানুষের মহীয়সী নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ কারাগারে। তার রক্তের উত্তরাধিকার আর আদর্শের উত্তরাধিকার ‘যেথা এক দেহে হলো লীন’ সেই তারেক রহমান আজ নির্বাসনে। সেই সাথে নির্বাসিত গণতন্ত্র ও এ দেশের মানুষের মৌলিক মানবাধিকার। জিয়ার আদর্শের উত্তরাধিকারীরা আজ নিপীড়িত ও নিষ্পেষিত। জিয়াউর রহমানের এই মৃত্যুবার্ষিকীর পাদভূমিতে দাঁড়িয়ে আমাদের আশা- ‘সব রিক্ততার অবসান হবে নবপল্লব গৌরবে, শহীদ জিয়ার খুনে রঙ মেখে ফের ফুটিবে গোলাপ বাংলাদেশে।’ 

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement