১১ মে ২০২৪, ২৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০২ জিলকদ ১৪৪৫
`


মান্না-মাহির ফোনালাপের রাজকথন

মান্না-মাহির ফোনালাপের রাজকথন - ছবি : সংগ্রহ

নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না আবারো ফোনালাপের কবলে পড়েছেন। আপাদমস্তক নিপাট ভদ্রালোক এবং বন্ধুবৎসল বলে পরিচিত মাহমুদুর রহমান মান্না ইতঃপূর্বে মোবাইল ফোনে কথা বলে কী যে দুর্ভোগে পড়েছিলেন, তা দেশবাসী কমবেশি সবাই জানেন। সেবার তিনি কথা বলেছিলেন একজন অপরিচিত মানুষের সাথে। রাজনীতিবিদ হিসেবে আমরা অনেকেই আমজনতার ফোন ধরি এবং পরিচিত-অপরিচিত কিংবা অজ্ঞাত লোকের সাথে আন্তরিকতা নিয়ে কথাবার্তা বলে নিজের মহত্ত্ব ও গণসম্পৃক্ততা প্রমাণের চেষ্টা করি। অনেক সময় কেউ হয়তো ফোন করেই জানতে চান- আমাকে চিনেছেন!

তখন আমরা উহ-আহ, হু-হা বলে এমন একটা ভাব করি যে-তাকে চিনতে পেরেছি; অথচ আদৌ চিনি না। মাঝে মধ্যে দু-একজন পাল্টা প্রশ্ন করে বলে ওঠেন, আচ্ছা বলুন তো আমি কে? তখন আমরা সত্যিকার অর্থেই বিপদে পড়ে যাই এবং আমতা আমতা করে বলি, চেনা চেনা লাগছে! বলুন তো কে আপনি! তারপর ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা নিজের নাম বলতেই আমরা না চিনলেও উচ্ছ্বাস দেখিয়ে বলি- উফ্! এবার চিনতে পেরেছি। তারপর আমরা মনোযোগ দিয়ে তাদের কথাবার্তা, অভাব-অভিযোগ, অনুযোগ-পরামর্শ শুনতে থাকি- আর এভাবেই অনর্থক কর্মকাণ্ডে বছরের পর বছর পার করে দাড়ি-চুল পাকিয়ে গরিবের সুন্দরী বউয়ের মতো পাড়া-মহল্লার কামুক পুরুষ এবং ঈর্ষাকাতর ধনবতী কুৎসিত রমণীর জ্বালাতন উপভোগ করে কবরের পথে এগোতে থাকি।

মাহমুদুর রহমান মান্না যে ফোনালাপের মাধ্যমে রাষ্ট্রদ্রেহোরে মামলার দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন, তা অনেকটা উপরিউল্লিখিত প্রকৃতিরই ছিল। কিন্তু মান্নার এবারকার ফোনালাপটি অবশ্য গতানুগতিক নয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডা: বি. চৌধুরীর আলোচিত এবং কারো কারো কাছে বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত এবং কর্নেল অলি আহমদের মতো লোকদের কাছে ব্যাপকভাবে সমালোচিত যুবক রাজনীতিবিদ মাহি বি চৌধুরীর সাথে মান্নার ফোনালাপের বিষয়টি এখন দেশের রাজনীতির চায়ের কাপে ঝড় তুলেছে। তাদের কথোপকথন নিয়ে যেভাবে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে তাতে মান্নার বিনয়, ভদ্রতা ও সৌজন্যতার বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। অন্য দিকে, যে বা যারা ফোনালাপটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন তারা প্রকারান্তরে মাহির ব্যক্তি ইমেজ ও রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে কালিমা লেপন করে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনার আগে দেশের সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ড. কামাল ও বি. চৌধুরীর ঐক্য এবং সেই ঐক্যের ভাঙন নিয়ে দু-চারটি কথা বলা অবশ্যক।

একাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সাম্প্রতিককালে বেশ কিছু রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরি হয়েছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের জোটের পরিধি বাড়াতে গিয়ে ইতোমধ্যে হেফাজত নেতা মাওলানা আহমদ শফী এবং সাবেক বিএনপি নেতা নজমুল হুদার সাথে ঐক্য করেছেন বলে পত্রপত্রিকায় এসেছে। তারা কয়েকটি ইসলামী দল বা জোট, কাদের সিদ্দিকী, কর্নেল অলিসহ সিপিবি-বাসদের মতো বাম ঘরানার দলগুলোর সাথে তলে তলে ঐক্য করে যাচ্ছেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। সরকারের শরিকদল এবং জাতীয় সংসদের অভিনব বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও রাজনৈতিক মোর্চা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা এখন পর্যন্ত তাদের ওপর সরকারের নির্দেশ, আদেশ ও পরামর্শের কোনো অনুলিপি হাতে পাননি। ফলে তারা দৃঢ়ভাবে বলতে পারছেন না যে, তারা কি আগামীতে ক্ষমতাসীন জোটের অংশীদার হিসেবে নির্বাচন করবেন, নাকি তাদেরকে নির্বাচনের সাপোজিটর হিসেবে এককভাবে কাজ করতে হবে। তারা এক দিকে যেমন সরকারের ভয়-প্রভাব-প্রতিপত্তি এবং তাদের ওপর সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি গা-ঝাড়া দিয়ে ফেলে রুখে দাঁড়াতে পারছেন না, আবার যদি দৈবাৎ কারণে বর্তমান সরকার পুনরায় ক্ষমতায় না আসে তবে কী পরিণতি এবং কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তার ব্যারোমিটারও খুঁজে পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় তারা সাদামাটা রাজনৈতিক বক্তব্য দিয়ে পত্রিকার পাতাগুলো ভরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

উপরিউল্লিখিত গতানুগতিক ধারার সাথে তাল মিলিয়ে প্রায় একই কাজ করে যাচ্ছিল রাজপথের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং তাদের মিত্রদলগুলো। বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে করা বাহারি মামলা মোকদ্দমা, হুমকি-ধমকি, কূটকৌশল, প্রচার-প্রপাগান্ডা ও তাপচাপে তারা প্রায় ভর্তা হয়ে যাওয়ার অবস্থায় পড়েছিল। নির্বাচনকালীন সরকারপদ্ধতি, নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনপূর্ব সংলাপ ইত্যাদি নিয়ে গতানুগতিক বক্তৃতা-বিবৃতির পাশাপাশি দলীয় কার্যালয়ে চলতি ঘটনার ওপর নিয়মিত প্রেস ব্রিফিং করেই তারা সময় পার করছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে ডা: বি. চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যপক্রিয়ার আহ্বানে বিএনপি শিবিরে নতুন-আশা-আকাক্সক্ষা ও আবেগ-উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে। পরে ড. কামাল, বি চৌধুরী, আ স ম আবদুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ বিএনপি এবং তাদের মিত্র বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবী ও সুশীলসমাজের সমন্বয়ে একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ঐক্য করে একাদশ সংসদ নির্বাচন সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করার একটি প্রক্রিয়া শুরু হলে রাজনীতির মাঠ বেশ আলোচিত হয়ে ওঠে এবং বিষয়টি সরকারের নজরে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।

দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে দীর্ঘ দিন থেকেই ড. কামালকেন্দ্রিক একটি প্রক্রিয়া নিয়ে গুঞ্জন ছিল। অন্য দিকে, বি. চৌধুরী এবং কাদের সিদ্দিকীকে নিয়ে গুঞ্জন ছিল যে, তারা আসলে শেষ পর্যন্ত কোন দিকে যাবেন- তা হলফ করে বলা যাবে না। কাদের সিদ্দিকী সম্পর্কে অন্যান্যের অভিযোগ হলো- তিনি অতিমাত্রায় অস্থির এবং প্রচণ্ড নাক উঁচু প্রকৃতির। কোনো সভা-সমিতি, অনুষ্ঠান কিংবা বৈঠকে তাকে পাওয়া এবং স্বস্তিতে সেই অনুষ্ঠান শেষ করা রীতিমতো কষ্টসাধ্য। কারণ তিনি কী চাইবেন বা কী বলবেন তা আয়োজকদের জন্য সব সময়ই ঝুঁকিপূর্ণ থাকে। নাগরিক ঐক্যের পক্ষে একবার তিনি নারায়ণগঞ্জে বক্তব্য দিতে গিয়ে এমনভাবে কথা বলেছিলেন, যা আয়োজকদের বিপক্ষে গিয়েছিল। তিনি কয়েকবার জিয়াউর রহমান, বিএনপি এবং খালেদা জিয়ার পক্ষেও যেমন বলেছেন, আবার তারেক রহমানসহ অনেককে যুগপৎভাবে তুলোধুনা করে দিয়েছেন। এসব কারণে তাকে নিয়ে অনেকেরই অস্বস্তি রয়েছে। কাজেই ঐক্যপ্রক্রিয়ায় যেকোনো কারণেই হোক তাকে দেখা যায়নি। বি. চৌধুরী সম্পর্কে সবারই একধরনের শ্রদ্ধা ও ভালো লাগার অনুভূতি রয়েছে। কিন্তু মাহিকে নিয়ে বিএনপি এবং শরিকদের অনেকেরই রয়েছে সুতীব্র অ্যালার্জি। কিন্তু তারপরও ঐক্যপ্রক্রিয়ায় তাদের অন্তর্ভুক্তিতে অনেকে অবাক হয়েছিলেন এবং সাধারণ বিএনপি-জামায়াতের লোকজন খুশি হয়েছিলেন।

বি. চৌধুরীর বিকল্পধারা এবং তার নেতৃত্বে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কয়েকটি বৈঠক এবং পরে ড. কামাল হোসেনের সাথে তাদের বৈঠকে মাহি বি চৌধুরীর কিছু বক্তব্য, দাবি ও মন্তব্যে সারা দেশে বিপরীতমুখী আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। তাদের জোটে বহু সিনিয়র নেতা থাকা সত্ত্বেও অপেক্ষাকৃত তরুণ মাহির কণ্ঠে এমন সব কথাবার্তা শোভা পাওয়া শুরু করল, যা কিনা তাদের জোটে বিএনপির অংশগ্রহণকে অনিশ্চিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছিল। নতুন জোটে পরোক্ষভাবে হলেও জামায়াত থাকতে পারবে না এবং সেই ঘোষণা বিএনপিকে প্রকাশ্যে দিয়ে তারপর জোটে আসতে হবে এমন শর্তের পাশাপাশি তাদের জোটকে ১৫০টি আসন দিতে হবে। ক্ষমতার ভারসাম্যের ব্যাপারে চুক্তি করতে হবে ইত্যাদি কথাবার্তা বলে মাহি এক দিকে যেমন জোটের ভেতর জনপ্রিয়তা হারাচ্ছিলেন, তেমিন সরকারি মহলে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল। এরই মধ্যে একদল লোক সমালোচনা শুরু করে যে, মাহি মূলত সরকারের এজেন্টরূপে কাজ করছে এবং জোটে ভাঙন ধরানোর মিশন নিয়েই তিনি পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছেন। মাহি সম্পর্কে লোকজন যতই বিরূপ মন্তব্য করুক না কেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি তাকে খুব কাছ থেকে চিনি বলেই আমি জানতাম যে, বিএনপির সাথে শেষ অবধি তার বা তার দল বিকল্পধারার ঐক্য হবে না- আর সে কারণেই তাদের গঠিত যুক্তফ্রন্ট টিকবে না এবং বৃহত্তর ঐক্যের সাথেও তারা থাকতে পারবে না।

বাংলাদেশের রাজনীতি-সংশ্লিষ্ট লোকজন খুব ভালো করেই জানেন, কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন বি. চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। পরে বিকল্পধারা গঠিত হলে তৎকালীন বিএনপি সর্বশক্তি নিয়ে নবগঠিত বিকল্পধারার ওপর আক্রমণ চালায় মেজর মান্নানের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে আগুন-ভাঙচুর, রেদওয়ান আহম্মেদের বাসাবাড়ীতে আক্রমণ এবং বি. চৌধুরীর বারিধারার বাড়িতে অগ্নিসংযোগের কাহিনী লোকজন হয়তো ভুলে যাবে, কিন্তু ঢাকা মহাখালী রেলক্রসিংয়ের কাছে বি. চৌধুরী ও মাহি বি চৌধুরীসহ বিকল্পধারার নেতাকর্মীদের ওপর পুলিশ এবং বিএনপির নেতাকর্মীদের যুগপৎ আক্রমণে যে ন্যক্কারজনক এবং মর্মান্তিক দৃশ্যের অবতারণা হয়- তা কোনো দিন ভুলবার নয়। বয়োবৃদ্ধ একজন সাবেক প্রেসিডেন্ট সে দিন প্রাণভয়ে যেভাবে অসহায় অবস্থায় পড়ে পালাচ্ছিলেন তা কেবল তার জন্য নয়- পুরো গণতন্ত্র তথা বাংলাদেশের জন্য একটি লজ্জাজনক অধ্যায়। রাগে, ক্ষোভে এবং অপমানে বি. চৌধুরী সাংবাদিকদের ক্যামেরার সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি আর কোনো দিন বিএনপিতে ফিরে যাবেন না।

উল্লিখিত ঘটনার পর বহু বছর কেটে গেছে। বিকল্পধারা থেকে কর্নেল অলি বের হয়ে গেছেন- বিএনপিও ক্ষমতা হারিয়ে ইতিহাসের ভয়াবহতম বিপর্যয়ে পড়েছে এবং রাজনৈতিক দল হিসেবে বিকল্পধারার কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতির নির্মম বাস্তবতায় বি. চৌধুরীর ঘনিষ্ঠজনেরা যেমন তাকে বিএনপিতে ফেরত যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, তেমনি বিএনপি নেতৃত্বকেও তাদের শুভার্থীরা পরার্মশ দিয়েছেন যে, বি. চৌধুরীকে সসম্মানে দলে ফিরিয়ে নেয়া হোক। এ অবস্থায় ২০১৫ বা ১৬ সালে হঠাৎ পত্রিকায় খবর বের হলো যে, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া বি. চৌধুরীর বাসায় গিয়েছেন। পরবর্তীকালে বি. চৌধুরীও বিএনপির ব্যাপারে নমনীয় কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করলে তিনি আওয়ামী লীগের কোপানলে পড়েন এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাকে বদু কাকা সম্বোধন করে ঠাট্টাছলে অনেক বিষোদগার করেন।

বিএনপি এবং বিকল্পধারার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, বি. চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে বিএনপি এবং বেগম খালেদা জিয়াকে পছন্দ করেন। তবে তিনি কিছুতেই তারেক রহমানের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব মানতে পারেন না। তারেকের কথা শুনলে তার মনে গোস্বা দেখা দেয়- মস্তিস্ক এলোমেলো হয়ে যায় এবং শরীরে অস্থিরতা ভর করে। একইভাবে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মাহি সম্পর্কে প্রচণ্ড অ্যালার্জি রয়েছে। যে অ্যালার্জির কারণে কর্নেল অলি বিকল্পধারা ত্যাগ করেছিলেন এবং সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির সাথে যুক্তফ্রন্টের ঐক্যের ব্যাপারে বিরোধিতা করেছিলেন। রাজনীতির অন্তরালের খবরাখবর যারা রাখেন, তারা সবাই তারেক-মাহির ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিযে মুদ্রণ অযোগ্য রসাত্মক ও ব্যাঙ্গাত্মক কথাবার্তা প্রচার করেন- যা আমার কাছে প্রায়ই ভ্রান্ত বলে মনে হয়। তবে একটি বিষয় লক্ষণীয়, তারেক-মাহির ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পরও তারা কেউ পরস্পরের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তো দূরের কথা একান্ত আলোচনাতেও একটি বিরূপ মন্তব্য করেননি।

অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশের পত্রপত্রিকা যখন গরম গরম খবর প্রকাশ করছিল- বিকল্পধারার নেতৃত্বাধীন যুক্তফ্রন্টের সাথে বিএনপির ঐক্য হয়েছে, তখন আরো অনেকের মতো আমিও অপেক্ষা করছিলাম ঐক্যে ফাটল ধরার খবর শোনার জন্য। কিন্তু কেউ কেউ যখন বি. চৌধুরী এবং মাহিকে সরকারের এজেন্ট বলে গালমন্দ করছিল, তখন বিষয়টি বিশ্বাস করতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। কারণ, রাজনীতির সূত্রমতে-তাদের সাথে সরকারের সুসম্পর্ক হতে পারে, কিন্তু সরকারের দোসর বা দালাল হওয়ার মতো দৈনতায় তারা পড়বেন এমন নিচু চিন্তা আমার মনে স্থান পায়নি। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হলো- অন্যসব রাজনৈতিক দল ও জোটের মতো বিকল্পধারাও ক্ষমতায় যেতে চায় বা ক্ষমতার সঙ্গী হতে চায়। সে ক্ষেত্রে তারা হয়তো একটি তৃতীয় শক্তি হিসেবে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করতে চাইবেন। তবে বিএনপির ছত্রছায়ার তুলনায় তারা বর্তমান সরকারকে যে নিরাপদ মনে করেন, তা তাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় বহুবার স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বিএনপির সাথে তাদের বৃহত্তর ঐক্য, জামায়াত প্রসঙ্গ এবং সংসদীয় আসনের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক এবং সর্বশেষে ঐক্যপ্রক্রিয়া থেকে ছিটকে পড়ার ঘটনার মধ্যে একটি কথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, ঐক্যজোটের সিনিয়র নেতারা তাদেরকে বিশ্বাস করতে পারেননিÑ যা মান্না ও মাহির টেলিফোন সংলাপে অনেকটা স্পষ্ট হয়ে গেছে।

আমরা যদি মান্না-মাহির টেলিফোন সংলাপ বিশ্লেষণ করি তবে লক্ষ করব যে, মান্না কথা বলতে বেশ ইতস্তত বোধ করছিলেন। অন্য দিকে, মাহি তার কথাবার্তা দিয়ে মান্নাকে বিব্রত, এবং বিভ্রান্ত করার পাশাপাশি তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, মান্নার কাছে মাহির ফোনালাপটি ছিল অপ্রত্যাশিত এবং তিনি কথা বলতে গিয়ে বারবার চিন্তা করছিলেন, তাদের ফোনটিতে আড়িপাতা হচ্ছে, যা তার জন্য নতুন বিপদের কারণ হতে পারে। এ কারণে তিনি কথার ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন এবং খুবই সতর্কভাবে কথাবার্তা বলছিলেন। অন্য দিকে, মাহির কথা শুনে মনে হচ্ছিলো- তিনি পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন এবং তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে তাদের সংলাপ রেকর্ড হচ্ছে, যা নির্দিষ্ট সময়ে প্রকাশিত হবে। কথার মাধ্যমে তিনি নিজেদের অসহায় ও দুর্বল বলে উপস্থাপন করে দর্শক-শ্রোতার সহানুভূতি লাভের চেষ্টা করছিলেন। তিনি তার বাবাসহ ড. কামালের বাড়িতে গিয়ে যেভাবে অপমানিত হয়েছেন, তা অত্যন্ত অভদ্রজনিত আচরণ। এ কথা বারবার বলে তিনি বুঝাতে চাচ্ছিলেন, ড. কামাল তো ইতঃপূর্বে এমন সৌজন্য বিবর্জিত ছিলেন না। বিএনপির সাথে ঐক্য করার পর তিনি হয়তো সৌজন্য ভুলে গেছেন। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোকো মারা যাওয়ার পর বেগম জিয়ার অফিসে গিয়ে যেভাবে অপমানিত হয়েছেন, ঠিক একই কায়দায় বিকল্পধারার বড় চৌধুরী এবং ছোট চৌধুরী সাহেবদ্বয় ড. কামালের বেইলি রোডের বাড়িতে গিয়ে অপমানিত হয়েছেন।

টেলিফোন আলাপে মাহির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং দ্ব্যর্থপূর্ণ বক্তব্যটি ছিল দেশবিরোধী চক্রান্ত নিয়ে। তিনি অনেকটা শিক্ষকসুলভ অভিব্যক্তি নিয়ে বেশ দৃঢ়তার সাথে মান্নাকে এমনভাবে বুঝাচ্ছিলেন, তাতে শ্রোতাদের মনে হতে পারে যে, মান্না লোকটি আসলে অবোধ-সে কিছুই বোঝে না। মাহি বলছিলেন, আরে মান্না ভাই আপনি জানেন না, এসব ঐক্যের পেছনে অনেক কিছু আছে- এটা কোনো ঐক্য না, এটা দেশবিরোধী চক্রান্ত। এই বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি ঐক্যপ্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত লোকেরা যে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার অভিযুক্ত আসামি হতে পারেন তার ইঙ্গিত দেন। তার বক্তব্যের জবাবে মান্না কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে কৌশলে পাশ কাটানোর চেষ্টার মাধ্যমে মাহির সম্পর্কে সাম্প্রতিক কালের গুঞ্জনকে জনগণের বিচারের জন্য একটি সুন্দর জায়গা করে দিয়েছেন। ফলে মান্না-মাহির টেলিফোন সংলাপ নিয়ে পত্রপত্রিকা, টকশো এবং সামাজিক মাধ্যমে যা আলোচনা হচ্ছে- তা তার জন্য শুভ ফল বয়ে নিয়ে আসবে, সেটা বিচার করার ভার সম্মানিত পাঠকদের ওপর ছেড়ে দিলাম।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য


আরো সংবাদ



premium cement
এক বছর পর দাউদকান্দিতে ড. মোশাররফ গোপালগঞ্জ বশেমুরবিপ্রবিতে সুষ্ঠুভাবে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা সম্পন্ন রাজধানীতে আ’লীগের শান্তি সমাবেশ আজ কুয়াকাটা সৈকতে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সমুদ্রস্নান সরকারি হাসপাতালে অবৈধ ক্যান্টিন ও ওষুধের দোকান বন্ধের নির্দেশ ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে আ’লীগ জনগণকে নাগরিক হিসেবে বাতিল করেছে : জোনায়েদ সাকি ইবিতে ‘সি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা টঙ্গী পর্যন্ত বর্ধিত হচ্ছে মেট্রোরেলের লাইন মালয়েশিয়ায় বিএমইটি কার্ডের নামে প্রতারণার ফাঁদ : সতর্ক করল দূতাবাস ফিলিস্তিনে হামলার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে খেলাফত মজলিসের বিক্ষোভ মিছিল আল মাহমুদপুত্র মীর তারিকের ইন্তেকাল

সকল