২০ মে ২০২৪, ০৬ জৈষ্ঠ ১৪৩১, ১১ জিলকদ ১৪৪৫
`


মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের ভবিষ্যৎ

মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের ভবিষ্যৎ - নয়া দিগন্ত

তুরস্ক এবং মিসরের সুসম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে। সম্প্রতি দুই দেশের একটি নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে ১৪ ফেব্রুয়ারি ’২৪ এরদোগানের মিসর সফরের মধ্য দিয়ে। দুই দেশের চুক্তির ফলে মিসরে মুসলিম ব্রাদারহুডের ভবিষ্যৎ কী হবে এ নিয়ে বিশ্লেষকরা অনেক হিসাব-নিকাশ করছেন। অনেকে প্রশ্ন রেখেছেন, একসময় সিসি বিদায় নেবেন তখন কি এরদোগান সমর্থিত ব্রাদারহুড ক্ষমতায় এসে মিসর পরিচালনা করতে সক্ষম হবে? মরহুম প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করা নিয়ে তুরস্ক মিসর বিরোধ বাধে। সিসি ২০১৩ সালের জুলাই মাসে ব্রাদারহুডের সদস্যদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নৃশংস দমন-পীড়ন শুরু করেন। ১৯২৮ সালে ব্রাদারহুড প্রতিষ্ঠার পর এটি সবচেয়ে বড় ধাক্কা।

তুরস্কের মাটিতে ব্রাদারহুড নেতাদের আশ্রয় প্রদান, শত শত সদস্যকে তুর্কি নাগরিকত্ব প্রদান এবং তাদের মিডিয়া চ্যানেল হোস্ট করা সত্ত্বেও আঙ্কারা ও কায়রোর মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই চুক্তি কি ব্রাদারহুডের পক্ষে ছিল? নিশ্চয় নয়। গাইড মোহাম্মদ বাদি, তার দুই ডেপুটি, খায়রাত আল-শাত এবং মাহমুদ এজ্জাতসহ মিসরজুড়ে হাজার হাজার ক্যাডার, সংসদীয় ডেপুটি এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেফতারের বেদনাদায়ক ইতিহাস তো সামনেই রয়েছে।

বলতে হয়, মিসরের প্রতি তুর্কি নীতির পরিবর্তন ব্রাদারহুডের জন্য একটি সঙ্কট তৈরি করেছে।
পর্যবেক্ষকরা বিশ্বাস করেন যে তুরস্কে ব্রাদারহুডের উপস্থিতি হ্রাস পেতে চলেছে, অথবা সম্ভবত তাদের কিছু নেতাকে ইউরোপীয় রাজধানীতে স্থানান্তর করার জন্য চাপ দেয়া হয়েছে, যাদের মিসরীয় কর্তৃপক্ষ চিহ্নিত করেছে। পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সদস্যদের ক্রিয়াকলাপ সীমাবদ্ধ করা এবং তাদের মধ্যে কয়েকজনের আবাসন নবায়ন না করার বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত। কায়রোর প্রতি বৈরী যেকোনো মিডিয়া বা রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করার কথাও উঠে এসেছে। এসব মেনে নেয়া এরদোগানের জন্য কঠিন।

এরদোগানের সাম্প্রতিক মিসর সফরে বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে যা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরেও প্রসারিত। এরদোগান গাজা সঙ্ঘাতের মধ্যস্থতায় আরো বিশিষ্ট ভূমিকা পালনের জন্য মিসরের সম্পর্ককে ব্যবহার করতে চাইছে। গাজার নিকটবর্তী হওয়া এবং ফিলিস্তিনি দলগুলোর সাথে ঐতিহাসিক সম্পর্কের কারণে মিসরের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সফর আঞ্চলিক গতিশীলতার সম্ভাব্য পরিবর্তনকে প্রভাবিত করে। তুরস্কের লক্ষ্য এই অঞ্চলে তার সক্রিয় ভূমিকা জোরদার করা। তা ছাড়া মিসরের বেশ কয়েকটি ইস্যুতে তুরস্ক জড়িত হতে চায়। এরদোগানের সফর এবং মিসরীয় কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা, সংলাপ ও সহযোগিতার এসব নতুন প্রতিশ্রুতির ইঙ্গিত দিয়েছে। গাজার পুনর্গঠনে সহযোগিতা আঞ্চলিক গতিশীলতার ইতিবাচক বিকাশকে প্রতিফলিত করে, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। এরদোগানের এই সফর আঞ্চলিক কূটনীতি, সঙ্ঘাত নিরসন এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতার ওপর প্রভাব ফেলেছে।

এরদোগানের সাম্প্রতিক মিসর সফর নিয়ে আঞ্চলিক কুশীলবদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা গেছে। মিসরের সাবেক রাষ্ট্রদূত আবদুর রহমান সালাহ এরদোগানের সফরকে আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি নতুন জোট গঠনের সুযোগ হিসেবে দেখছেন। মিসর ও তুরস্কের মধ্যে সহযোগিতা এই অঞ্চলের সমস্যাগুলো মোকাবেলায় সহায়তা করতে পারে। তাছাড়া গাজা, লিবিয়া, সুদান এবং জ্বালানি সম্পদসহ আঞ্চলিক ইস্যুতে স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। এরদোগানের সফর আঞ্চলিক অভিনেতাদের মধ্যে আগ্রহ ও আলোচনার জন্ম দিয়েছে, অভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উন্নত সম্পর্ক ও সহযোগিতার প্রত্যাশা দেখা দিয়েছে।

ব্রাদারহুডের কিছু নেতার তুর্কি নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার মতো বিষয়টি সংবেদনশীল। নতুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলি ইয়ারলি কায়ার দায়িত্ব গ্রহণের পরে অবৈধ অভিবাসন মোকাবেলা, অবৈধ অভিবাসীদের নির্বাসন এবং তুর্কি ভূখণ্ডে শরণার্থী এবং বিদেশী বাসিন্দাদের নথিপত্র নিয়ন্ত্রণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। গত বছরের জুলাই থেকে, বিশেষত ইস্তাম্বুলে একটি বিস্তৃত প্রচারণায় অবৈধভাবে বা চোরাচালান নেটওয়ার্কের মাধ্যমে দেশে প্রবেশ করা সব অভিবাসীকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়। আলি কায়ার মতে, এটি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা জাতীয়তাকে লক্ষ্য করে নয়।
ব্রাদারহুডের ভারপ্রাপ্ত দায়ী মাহমুদ হুসেনের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার বিষয়টি এরদোগানের মিসর সফরের আগে উত্থাপিত হয়েছিল। সংযুক্ত আরব আমিরাত এবং সৌদি আরবের মিডিয়া আউটলেটগুলো এক সংবেদনশীল সময়ে বিষয়টি উত্থাপন করেছে। সাধারণভাবে অভিবাসন ফাইলটি তুর্কি সরকারের এজেন্ডার শীর্ষে রয়েছে এবং এটি কেবল ব্রাদারহুডের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে নয়। অনেকে নাগরিকত্ব হারিয়েছেন তবে সেটি মুসলিম ব্রাদারহুডে থাকার কারণে নয় বরং তাদের মামলায় আইনি ফাঁকফোকর এবং নথি অসম্পূর্ণ ছিল। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এবং মিসরে নির্বাসিত যুবক মুহাম্মদ আবদেল হাফিজের মামলা ছাড়া তুরস্ক থেকে কাউকে বহিষ্কার করা হয়নি। ঘটনাটি তুর্কিরা তদন্ত করেছিল।

ব্রাদারহুডের শূরা সদস্য আল-হাদ্দাদ অস্বীকার করেছেন যে এরদোগান মিসর থেকে ফিরে আসার পরে হুসেনের তুর্কি নাগরিকত্ব বাতিল করেন। তিনি দাবি করেন যে, আন্দোলনের কিছু সিনিয়র কর্মকর্তাকে মিসরের কাছে হস্তান্তর না করে ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলে স্থানান্তর করার অনুরোধ অন্তর্ভুক্ত ছিল। অন্যরা তাদের মর্যাদাকে বৈধতা দিতে পারে এবং ব্রাদারহুডকে দেয়া রাজনৈতিক ও মিডিয়ার পরিসর হ্রাস করা হতে পারে, এর কার্যক্রম সীমিত করা যেতে পারে, যেখানে মিসরের সাথে সমস্যা হ্রাসের বিষয়ে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। চুক্তির পর তুর্কি কর্তৃপক্ষ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব মোয়াতাজ মাতার এবং মোহাম্মদ নাসেরকে আল-সিসি এবং তার পরিবারকে আক্রমণ না করার আহ্বান জানিয়েছে। তুরস্ক যেভাবে ব্রাদারহুডের ফাইল মোকাবেলা করছে তা আঙ্কারা ও কায়রোর মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতির বিষয়টি বিবেচনা করেই করছে। ফলে ব্রাদারহুডের আন্দোলন আরো বেশি সম্প্রসারণের অনুমতি পাচ্ছে না, এবং মিসরও তাদের ‘সন্ত্রাসী’ দল হিসাবে ডাকাডাকি করবে না। এই অবস্থান দুটি দেশ ও ব্রাদারহুডের জন্য আপাতত ভালোই মনে হয়।

মিসরের একসময়ের শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তি মুসলিম ব্রাদারহুড (এমবি) এক জটিল ভবিষ্যতের মুখোমুখি। ১৯২০-এর দশকে ইসলামী শাসন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে ওকালতি করে এমবির আবির্ভাব ঘটে। ২০১১ সালে মিসরের বিপ্লবের পর দেশটি নির্বাচনে বিজয় অর্জন করলেও প্রেসিডেন্ট আল-সিসির অধীনে দমন-পীড়নের মুখে পড়ে। এমবি এখন পরিচয় সঙ্কট, বৈধতার সমস্যা এবং সদস্যপদ হ্রাসের সাথে লড়াই করছে। নতুন ভারপ্রাপ্ত জেনারেল গাইড নির্বাচিত হয়েছেন সালাহ আবদুল হক। তার লো প্রোফাইল ব্রাদারহুডের পুনর্নবীকরণের সন্ধানের সঙ্কেত দিতে পারে। সিসি সরকার ভিন্নমত দমন করে, বিরোধীদের জন্য খুব কম সুযোগ রেখেছেন। তুরস্ক-মিসর সম্পর্কের কারণে নির্বাসিত সদস্যরা নিরাপদ আশ্রয়ের মুখোমুখি হয়েছেন। এমবির উত্তরাধিকার স্থায়ী ও রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী তথাপি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হচ্ছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে অপারেশন সম্প্রসারণ বেঁচে থাকার এক কৌশল হতে পারে। তাছাড়া ভবিষ্যৎ সঙ্কটের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়া এবং পরিবর্তিত মধ্যপ্রাচ্যে প্রাসঙ্গিকতাকে লক্ষ্য করে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করা রাজনৈতিক প্রজ্ঞার বহিঃপ্রকাশ হতে পারে।

ইসলামপন্থী ভার্চু পার্টি থেকে এরদোগানের দলত্যাগকে হুমকি হিসেবে দেখছে ব্রাদারহুড। মিসরে ব্রাদারহুডের জনপ্রিয় নেতাদের অনুরূপ দলত্যাগ তাদের অবস্থানকে দুর্বল করতে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। ব্রাদারহুডের প্রতি তুরস্কের দৃঢ় সমর্থন তার সদস্যদের একটি শক্তিশালী প্রবাসী অবস্থান তৈরি করেছে, এটি তুরস্কের পররাষ্ট্রনীতির উপর বোঝা হয়ে উঠেছে। কূটনৈতিক সম্পর্কের সাথে ব্রাদারহুডের সমর্থনের ভারসাম্য বজায় রাখা এরদোগান সরকারের জন্য বেশ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এ জন্য তুরস্কের ভেতরে এরদোগানের দলকে বিরোধী দলের প্রচুর সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে, যার কিছু বহিঃপ্রকাশ স্থানীয় নির্বাচনে বিস্ফোরিত হয়েছে। আঞ্চলিক গতিশীলতার পরিবর্তনের মধ্যে ব্রাদারহুড দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি।

মিসর এখন অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং মিসরীয় জনগণ মুদ্রাস্ফীতিতে ভুগছে। তাহলে কি ব্রাদারহুড একটি দুর্বল, ক্লান্ত ও পরনির্ভরশীল রাষ্ট্রে ক্ষমতা গ্রহণ করতে রাজি হবে? বাস্তবে বলতে গেলে, সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রথম কয়েক বছরের তুলনায় দেশে বা বিদেশে মুসলিম ব্রাদারহুডের উপস্থিতি এখন আর মিসরীয় সরকারের জন্য হুমকি নয়। এটা বাস্তবসম্মত যে, আল-সিসির তৃতীয় মেয়াদে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের আলোকে দেশে ও বিদেশে জটিল সমস্যাগুলো নিরসন বেশি প্রয়োজন। মুসলিম ব্রাদারহুড বর্তমানে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে। সিসির হাতে পড়ে এক শতাব্দী আগে একটি সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দলটির ভাগ্য নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়। বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে, ব্রাদারহুড মিসরের নাগরিক সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে এবং রাজনৈতিক বিরোধিতার একটি বিশিষ্ট উৎস হয়ে ওঠে। ব্রাদারহুড এখন একটি সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। হয় নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার, দর্শন করতে হবে, নয়তো ধীরে ধীরে অপ্রাসঙ্গিকতায় মিলিয়ে যেতে হবে।

লেখক: অবসরপ্রাপ্ত যুগ্মসচিব ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement
ঢাকা-তাসখন্দ সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনার উপর গুরুত্বারোপ রাষ্ট্রদূত ড. মনিরুলের নারীর জীবনমান উন্নয়নে পাশে থাকার অঙ্গীকার জাতিসঙ্ঘের আবাসিক প্রতিনিধির রাইসির স্মরণে জাতিসঙ্ঘে এক মিনিট নীরবতা পালন ইরানের নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাগেরি কানি বড় ভাই বিপিএলে, ছোট ভাই বিসিএলে নকল ডায়াবেটিস স্ট্রিপ ধ্বংস করতে ফার্মা সল্যুশনসকে হাইকোর্টের নির্দেশ চাটমোহর পৌর ছাত্রলীগ সভাপতি পায়েল বহিষ্কার দ্বিতীয় ধাপে ১৫৬ উপজেলায় ভোটগ্রহণ মঙ্গলবার ‘বাবে কাবা’ নামের উপহারের দামি কলমটি তোষাখানায় দিলেন পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি লোকসভা ভোট : রেকর্ড করল কাশ্মীরের বারামুলা বিএসটিআইকে আন্তর্জাতিক মানের করতে সরকার কাজ করছে : শিল্পমন্ত্রী

সকল