তরুণ জনশক্তি হয়ে উঠুক মানবপুঁজি
- মো: আবুল হাসান ও খন রঞ্জন রায়
- ২০ জুন ২০১৮, ০০:০০
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ প্রতি বছর বেকার থেকে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরে দেশে শিল্প খাতে নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে কম। সরকারি খাতে কিছু বড় বিনিয়োগ হলেও এতে কর্মসংস্থানের গতি খুবই ধীর। অন্য দিকে, দেশের আইটি খাতে চাহিদার তুলনায় বর্তমানে শ্রমিক কম রয়েছে ১৭ লাখ ২৭ হাজারেরও বেশি। রয়েছে মধ্যম সারির কর্মকর্তা সঙ্কটও। ফলে অনেক বেশি বেতনে বিদেশ থেকে দক্ষ জনশক্তি আনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, চীনসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় ১০ লাখ ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারী পেশাজীবী এনজিও, তৈরী পোশাক ও বস্ত্র খাতসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। বছরে তারা বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছেন ২০ হাজার কোটি টাকা। ইউএনডিপি আর বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে এ দেশে বেকারের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি। তার মধ্যে শিক্ষিত বেকার দুই কোটি ২০ লাখ। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বেসরকারি খাতে শ্রমিক ও প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন জনবলের দরকার ৭০ শতাংশ। কিন্তু বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের ৯০ শতাংশই সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত, যার সাথে শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনার সম্পর্ক থাকে না।
সন্তোষজনক চাকরি পাওয়া নিয়ে সাধারণ শিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। অথচ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন বিভাগ খুলছে, কিন্তু এসব বিভাগের আদৌ প্রয়োজন আছে কি না তা পরখ করে দেখছে না।
আন্তর্জাতিক শ্রমসংস্থার উপাত্ত মতে, বাংলাদেশের শ্রমশক্তি বছরে গড়ে ২ শতাংশ হারে বাড়ছে। এক হাজার শূন্য পদের বিপরীতে এক লাখ মানুষের আবেদন পড়লে ভয়াবহ সঙ্কটই তুলে ধরে। কর্মসংস্থানমুখী শিক্ষার ভূমিকা ছাড়া এই বিপুলসংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার যথাযথ রাষ্ট্রীয় নীতি, যা সব সরকারকে মেনে চলতে হবে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র শুধু বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখবে না, তাকে সবার স্বার্থই দেখতে হবে। সবার জন্য যথাযথ শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
চাকরি করাই জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। আমাদের উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা অর্জন করা জরুরি। সমাজ ও জাতির রাষ্ট্রকে এর জন্য শিক্ষা, প্রযুক্তি, অবকাঠামো, উপকরণ জোগানের ব্যবস্থা করতে হবে। সহজে ব্যাংকঋণ সরবরাহ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিপরীত চিত্র দেখি। যারা ঋণ ফেরত দেবেন না, তাদেরই ঋণ দেয়া হচ্ছে। এতে প্রকৃত উদ্যোক্তারা ঋণ পাচ্ছেন না। এর সমাধান করতে পারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার।
প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, ২০১৮ সালে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্রিপ্টো-কারেন্সি ও স্বচালিত বাহনÑ তিন ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসবে। তাদের ভাষ্য অনুযায়ী, সোস্যাল মিডিয়া বিহেভিয়ার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিস্তৃত ব্যবহার, ব্যবসায় ডিপ লার্নিং, এআই এবং আইওটি-ভিত্তিক আর্থিক সেবা এবং অগমেন্টেড রিয়ালিটিতে ব্যাপক অগ্রগতি হবে। এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ব্যাংকিং খাতে ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটির ব্যবহার বাড়বে। ইউরোপে লেনদেনসেবা নিয়ে নতুন নীতিমালা প্রকাশ করা হবে। এতে আর্থিক খাতের প্রযুক্তি বা ফিনটেক-ভিত্তিক স্টার্টআপগুলো ব্যাংক গ্রাহকদের তথ্য কাজে লাগানোর সুযোগ পাবে। এতে ব্যাংকিং খাতে নতুন উদ্ভাবনের সুযোগ সৃষ্টি হবে। বছরটায় আমাদের ব্যবহার করা অনেক যন্ত্র যেমন চাবির রিং, স্মার্টফোন, ইন্টারনেটে যুক্ত গাড়ি, স্মার্টঘড়ি ইত্যাদি লেনদেনের যন্ত্র হিসেবে আবির্ভূত হবে।
২০১৯ সালের মধ্যে ৫জি ফোন বাজারে আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সে হিসেবে ৫জি নেটওয়ার্ক চালুর বেশির ভাগ কাজ সম্পন্ন করতে হবে ২০১৮ সালের মধ্যেই। কয়েকটি দেশে ৫জি নিয়ে জোর প্রস্তুতি চলছে। পরীক্ষামূলক একাধিবার চালু করে দেখা গেছে, তাতে ৪জির তুলনায় ১০ গুণ পর্যন্ত বেশি গতির ইন্টারনেট পাওয়া সম্ভব, যা ইন্টারনেট অব থিংসের ব্যবহার আরো বাড়িয়ে দেবে। এখন শুরু হবে পঞ্চম প্রজন্মের নেটওয়ার্ক। এ বছর রাস্তায় নেমে আসবে রোবট। রেস্তোরাঁ কিংবা হাসপাতালে মানুষকে সাহায্য করতে বা খাবার সরবরাহের কাজে রোবট নিয়ে কাজ করছে অনেক প্রতিষ্ঠান।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে প্রবেশ করেছি আমরা। এই প্রযুক্তি দিন দিন শুধু যে উন্নত হচ্ছে তা নয়, একই সাথে বাড়ছে এর ব্যবহারও। আগে শুধু কিছু গেম এবং মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য এ প্রযুক্তির ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন নিত্যনতুন প্রায় সব ধরনের প্ল্যাটফর্ম, অ্যাপ কিংবা ডিভাইসে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা জুড়ে দেয়া হচ্ছে। যন্ত্রমানব সোফিয়াকে দেশে আনার মাধ্যমে একটা ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। এতে আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের মেধাবী তরুণেরা ডিজিটাল বাংলাদেশের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছে।
আমাদের মতো দেশে একটি বড় সমস্যা হচ্ছে ডিপ্লোমা শিক্ষার অভাব। এটা না থাকায় দেশে প্রযুক্তিতে দক্ষ লোকবলের অভাবে কাক্সিক্ষত হারে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ছে না। পণ্য ও পেশাভিত্তিক ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদ নিশ্চিত করতে পারে সরকার। যদি বিনিয়োগ বাড়ানোর পরিস্থিতি তৈরি করা যায়, তাহলে বেকারত্ব সমস্যা অনেকটা ঘুচে যাবে। এটাই এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। মধ্যবিত্তের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনা জরুরি। তাদের ছেলেমেয়েরা যেন ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের পথে বিশ্ব। যার প্রধান হাতিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির মাধ্যমেই ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করছে সরকার। এই কার্যক্রম আরো বেগবান করতে ডিপ্লোমা শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে তৃণমূলে।
প্রতি বছর ১৪ লাখ তরুণ এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে। এর মধ্যে ১১ লাখই গ্রামের কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, কামার ও কুমারের ছেলে। তারা দুর্গম হাওর, দ্বীপ, উপকূল, পাহাড় ও সীমান্তের অধিবাসী। তাদের মেধা ও মননে শহরের আলাল-দুলালের চেয়ে কম নয়। তাদের রোগ প্রতিরোগ ক্ষমতা বেশি। সামান্য ভালোবাসা, দিকনির্দেশনা, অর্থ ও মামার জোরের অভাবে তারা অগ্রসর হতে পারে না। গ্রামের অপরিচিত ছেলেমেয়েই ডিপ্লোমা শিক্ষা গ্রহণ করে ক’দিন পর হয়ে উঠতে পারে গুরুত্বপূর্ণ কেউ। আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা, প্রতিভা আর পরিশ্রমÑ সব কিছু দিয়ে চমকে দিতে পারে সবাইকে। গ্রামের বেশির ভাগ তরুণকে ডিপ্লোমা শিক্ষার সুযোগ করে দিতে হবে। এই শিক্ষা গ্রহণ করে নিজ গ্রামে শিল্পখামার, হাসপাতাল কিনিক ও স্কুল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। বেকারমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে হলে সবার জন্য ডিপ্লোমা শিক্ষা। প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে ১০টি সরকারি-বেসরকারি কৃষি, ভেটেরিনারি, লেদার, পলিটেকনিক, টেক্সটাইল, মেডিক্যাল টেকনোলজি, নার্সিং, ইনস্টিটিউট অব প্রাইমারি এডুকেশন, মেডিক্যাল ও ডেন্টাল অ্যাসিস্ট্যান্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক : যথাক্রমে সভাপতি ও মহাসচিব, ডিপ্লোমা শিা গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ
Khanaranjanroy@gmail.com
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা