‘ভয়ঙ্কর গোপন তৎপরতা চালাচ্ছে ডিসিরা’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে জেলা প্রশাসক তথা রিটার্নিং অফিসাররা ভয়ঙ্কর গোপন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটির অভিযোগ- পরিকল্পিত নীলনকশার মাধ্যমে অবৈধ সরকারের দলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য লোক দেখানো নির্বাচন আয়োজনে ফন্দি-ফিকির করছে। ক্ষমতাসীনদের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রহসনমূলক নির্বাচনী ছক তৈরি করে এগিয়ে চলছে। সুতরাং জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজানো এবং দলবাজ কর্মকর্তাদের নির্বাচনী মাঠ থেকে প্রত্যাহার করার দাবি জানায় বিএনপি।

বাংলাদেশ জাতীয়তবাদী দল- বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আজ সোমবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন। নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এই সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

রিজভী বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিদিন জেলা প্রশাসকরা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করছেন। ভোট ডাকাতি প্রস্তুতির শলাপরামর্শ করছেন। নির্বাচনে জাল-জোচ্চুরির সব প্রস্তুতি পাকা করছেন। আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জেনেছি, গতকাল রোববার সকল জেলার প্রশাসকরা স্ব স্ব এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের ডেকে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠকে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে চারটি বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ১) ডিসিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের বলেছেন, আপনারা জানেন সুষ্ঠু ভোট হলে বিএনপি বিজয়ী হয়ে যাবে, তাই এই সরকারকে আবারো ক্ষমতায় রাখতে হলে বুঝে শুনে কাজ করতে হবে। যেকেনো মূল্যে এই সরকারকে ক্ষমতায় আনতে হবে। কাজেই এদিক ওদিক করার মতলব থাকলে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন। ২) মাঠে কাজ করবে পুলিশ ও র‌্যাব। আপনাদের দায়িত্ব হলো তাদের কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা এবং সহযোগিতা প্রদান। ৩) প্রিজাইডিং অফিসারদের নিরাপদে কন্ট্রোল রুমে আসার ব্যবস্থা করবেন। ৪) প্রিজাইডিং অফিসারদের ব্ল্যাংক সিগনেচার নিয়ে রাখবেন। সেটা সময়মতো কাজে লাগানো হবে। এই সরকারকে যে কোনো প্রকারে হোক ক্ষমতায় রাখতে হবে। নির্দেশনায় বলা হয়, গভীর রাতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ভোটকেন্দ্রে নিয়োজিত পুলিশের সহযোগিতায় নৌকা প্রতীককে জয়ী করার জন্য ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে রাখতে হবে। সকাল হওয়ার পর ভোটগ্রহণের আগেই ধানের শীষের প্রার্থীর পক্ষের এজেন্টগণ তাদের দায়িত্ব পালনের উদ্দেশে স্ব স্ব কেন্দ্রে ঢুকতে গেলে সরকার দলীয় লোকজন তাদের ঢুকতে বাধা দিবে এবং কেন্দ্রে নিয়োজিত পুলিশ সহায়তা করবে।

রিজভী বলেন, আমরা বলতে চাই- সাজানো প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। জনপ্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং দলবাজ কর্মকর্তাদের নির্বাচনী মাঠ থেকে প্রত্যাহার করতে হবে। এই অবৈধ সরকারকে কোনো সহযোগিতা করবেন না। আপনারা এদেশের সন্তান। নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করুন।

তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার নিশ্চিত ভরাডুবির আশঙ্কায় অস্থির ও বেসামাল হয়ে পড়েছে। তারা বিএনপির বিরুদ্ধে অনর্গল মিথ্যাচার ও প্রোপাগাণ্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। মিডিয়া সন্ত্রাসে নেমেছে। প্রতিবেশী একটি দেশকে নিজেদের পক্ষে টানতে, অনুকম্পা ও সমর্থন পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের নেতাদের নামে আজগুবী ভিত্তিহীন কথা ছড়াচ্ছে। গতকাল আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান ধানমণ্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, পাকিস্তানি দূতাবাসে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাক্ষাৎ ও গোপন বৈঠক করেছেন। এই অপপ্রচার ও মিথ্যাচারের প্রতিবাদ জানিয়ে পাকিস্তান হাইকমিশন গতকাল সংবাদ মাধ্যমে বিবৃতি দিয়েছে। লিখিত বার্তায় তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছে। পাকিস্তানের কোনো কূটনীতিকের সাথে বিএনপির বৈঠক হয়নি। মিথ্যা ও কূৎসা প্রচারণায় বিকারগ্রস্ত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। গোষ্ঠী স্বার্থে দেন-দরবার করার ঐতিহ্যই হচ্ছে আওয়ামী লীগের। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভীই তো ৭ দিন পাকিস্তানে কাটিয়ে আসলেন। এই ধরনের মিথ্যাচার থেকে আওয়ামী লীগ ও তাদের অর্থপুষ্ট দালাল মিডিয়া বিরত থাকবে বলে আমরা আশা করি। আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ ও তাদের মদদপুষ্ট কিছু দালাল মিডিয়াকে বলবো- বিকৃত অপপ্রচার না চালিয়ে আওয়ামী লীগের গোপন দেন-দরবারগুলি প্রকাশ করলে জাতি উপকৃত হবে।

তিনি বলেন, ভারতের অন্যতম বাংলা পত্রিকা দৈনিক যুগশঙ্খ গতকাল উলফার কমান্ডার ইন চিফ পরেশ বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়ার একটি সাক্ষাতকার প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে,‘এক যুগেরও বেশি সময় পর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে ক্লিনচিট দিলো ভারতের স্বাধীনতাকামী সংগঠন ‘ইউনাটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসাম (উলফা)’। বিএনপি-জামায়াত আমলে উলফা নেতাদের আশ্রয় এবং সহযোগিতার যে অভিযোগ তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ছিল তা মিথ্যা, বানোয়াট ও কল্পনাপ্রসূত বলে উল্লেখ করেছেন উলফার কমান্ডার ইন চিফ পরেশ বড়ুয়া ও সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া।

পত্রিকাটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান আলোচনাপন্থী উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া বলেন, আওয়ামী লীগের অনেক নেতা আছে যাদের আমাদের বিপ্লবের প্রতি সমর্থন ছিল ও আছে। কিন্তু তারেক জিয়ার সাথে আমাদের কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক ছিল না।

রিজভী জানান, যুগশঙ্খ লিখেছে, উলফা-স্বাধীনের সেনাধ্যক্ষ পরেশ বড়ুয়া ও উলফার আলোচনাপন্থী নেতা অনুপ চেটিয়ার সাথে এ প্রতিবেদকের যোগাযোগ হয়েছিল। তাদের কাছে প্রশ্ন ছিল- খালেদাপুত্র তারেকের সাথে আপনাদের যোগাযোগ ছিল কি না? এর উত্তরে পরেশ বড়ুয়া ও অনুপ চেটিয়া তারেক রহমানের সাথে যোগাযোগের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা, ভিত্তিহীন ও কল্পনাপ্রসূত বলে জানান।

পরেশ বড়ুয়া বলেন,‘আমি কাউকে মিথ্যা কলঙ্ক দিতে পারবো না। পরেশ অসম ওরফে পরেশ বড়ুয়া এ প্রতিবেদককে বলেন,‘হাওয়া ভবন কোথায় আমি জানতাম না। যাওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর তারেক জিয়াকে কোনোদিন দেখি নাই। তার সাথে টেলিফোনে কখনো কথাও হয়নি। এই ব্যাপারে কোনো প্রমাণ থাকলে আমি সেটাকে গ্রহণ করবো। মানুষ না দেখে না বুঝে অনেক কথা বলে। সেটা তো কাউন্ট করা যায় না।’ অথচ গত দশ বছর ধরে আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপি ও দেশের জনপ্রিয় নেতা দেশনায়ক তারেক রহমানকে জড়িয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে যে কাল্পনিক ও বানোয়াট গালগল্পের ঢালাও প্রচার করে এসেছে সেটি যে ডাহা মিথ্যা অভিযোগ ছিল তা সুষ্পষ্টভাবে প্রমাণিত হলো উক্ত প্রতিবেদনে। আজ সত্য উন্মোচিত হওয়ার পর আমরা বলবো- তারেক রহমানকে ভিলেন সাজাতে তার সাথে পরেশ বড়ুয়া ও অনুপ চেটিয়ার ঘনিষ্ঠতার যে মহাকাব্য বিগত এক দশক ধরে রচনা করা হয়েছে তার জন্য আওয়ামী লীগ প্রধানসহ নেতাদের দুঃখ প্রকাশ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির এই নেতা।

তিনি জানান, বিটিভি (বাংলাদেশ টেলিভিশন) সরকারি সম্পদ নয়, এটা এখন আওয়ামী লীগের সম্পত্তিতে পরিণত হয়েছে। অতি আওয়ামী লীগ হওয়ার কারণে অতিরিক্ত সচিব বর্তমানে বিটিভির মহাপরিচালক পদে আসীন আছেন হারুন অর রশিদ, যুগ্মসচিব সুরথ কুমার সরকার ডিরেক্টর অব নিউজ পদে অধিষ্ঠিত আছেন, কিন্তু পদটি উপসচিবের; যুগ্মসচিব সাখাওয়াত হোসেন পরিচালক প্রশাসন পদে আসীন আছেন, এই পদটিও উপসচিবের। অত্যন্ত একনিষ্ঠ আওয়ামী লীগার নুর আনোয়ার হোসেন এবং মাহবুবা ফেরদৌস প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ পদে আসীন আছেন। এরা বিটিভির বর্তমান পদে আসীন থাকলে ভোটের ফলাফল পাল্টে দিয়ে একটা বড় মাপের মিডিয়া ক্যু ঘটাতে সক্ষম হবে। অবিলম্বে উল্লিখিত কর্মকর্তাবৃন্দকে বিটিভি ঢাকা কেন্দ্র থেকে প্রত্যাহার করে অন্যত্র বদলী করতে হবে। এই সমস্ত কর্মকর্তাবৃন্দকে না সরালে একটা বড় ধরণের বিপর্যয় তারা ডেকে আনবে।

এখনো দেশব্যাপী গ্রেফতারের চিত্র তুলে ধরে রিজভী বলেন, ভোলার লালমোহনে মোঃ গিয়াসউদ্দিনসহ ৫ জন নেতাকর্মীকে গতরাতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন বীরবিক্রম এর বাসার সামনে থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। কুমিল্লার লাকসামে কুমিল্লা-৯ আসনে ধানের শীষের প্রার্থী কর্নেল (অবঃ) আনোয়ারুল আজিমের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট তাজুল ইসলাম খোকনকে গতকাল ডিবি পুলিশ রাজধানীর মতিঝিল এলাকা থেকে তুলে নিয়ে যাবার পর অস্বীকার করলেও পরবর্তীতে তাকে আটকের বিষয়টি স্বীকার করেছে। গতকাল রাতে তাকে ভাসানটেক থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এছাড়া মনোহরগঞ্জ থানা বিএনপির মোঃ শাহীনের বাড়িতে হামলা চালিয়ে ভাংচুর করেছে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। একই থানাধীন উত্তর যলম ইউনিয়ন বিএনপির মোঃ আনিসকে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা বেদম প্রহার করেছে। কোনো ধরনের মামলা না থাকা সত্ত্বেও গোপালপুরে আবুল কালাম এবং মোঃ কিবরিয়া, বগুড়ার শেরপুরে হাসানুল মারুফ শিমুলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ঢাকা মহানগরীর বিএনপি নেতা মিন্নত আলীকে গতকাল পুলিশ গ্রেফতারের পর তার ওপর ব্যাপক শারীরিক নির্যাতন চালায়। মিন্নত আলী বর্তমানে স্থানীয় একটি হাসপাতালে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন আছেন। রিজভী পুলিশের এই বর্বরোচিত আচরণের তীব্র নিন্দা জানান। এছাড়া ঢাকা মহানগর, গাজীপুর জেলা, ময়মনসিংহ জেলা, দিনাজপুর জেলা, বাগেরহাট জেলায় নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও বাসাবাড়িতে তল্লাশির নামে ভাঙচুর চালানো হয়েছে বলে জানান রিজভী।

বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদেরকে গ্রেফতার এবং নেতাকর্মীদের বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশির নামে পুলিশি তাণ্ডবের ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারসহ অবিলম্বে নেতাকর্মীদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান তিনি।