৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ট্রাম্পের চেয়েও বড় নেতা

-

সুপার পাওয়ার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান একে অপরের প্রশংসায় আসমান-জমিন এক করে দিয়েছেন। হোয়াইট হাউজে ইমরান খানকে স্বাগত জানানোর পর ট্রাম্প পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে একজন ‘জনপ্রিয় ও মহান নেতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। প্রশংসার দৌড়ে ইমরান খানও পিছিয়ে থাকেননি। তিনি ফক্স নিউজকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ট্রাম্পের কথা বলার ভঙ্গিতে শুধু তিনিই নন, বরং তার সফরসঙ্গী পুরো দলটাই মুগ্ধ। এরপর এক টুইটবার্তায় ইমরান খান ট্রাম্পের মেহমানদারিকে বেশ ‘অমায়িক ও মনোজ্ঞ’ বলেছেন। উভয় নেতা একে অপরের ব্যাপারে বেশ সুন্দর সুন্দর কথা বললেন, কিন্তু তাদের মধ্যে আলোচনার তাৎক্ষণিক কোনো সুফল দেখা যাচ্ছে না।

এটা কোনো গোপন কথা নয়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সবার সাথে হৃদয়গ্রাহী আচরণ করেন না। ইমরান খানের সাথে তার হৃদয়গ্রাহী আচরণের নেপথ্যে উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাকিস্তান তার দেশকে আফগানিস্তানের যুদ্ধ থেকে এমনভাবে বের করে আনবে- বিশ্ব যেন আমেরিকার পরাজয়কে বিজয় হিসেবে দেখতে পায়। এ কঠিন কাজটি শুধু একভাবেই সম্ভব, আর সেটা হচ্ছে- আফগান তালেবানের নেতারা আলোচনার টেবিলে ওইসব শর্ত মেনে নেবেন, যা আমেরিকা ও তার মিত্রজোট আঠারো বছর ধরে যুদ্ধের ময়দানে মানাতে পারেনি। ইমরান খান কি আফগান তালেবানকে আমেরিকার স্বার্থের ট্রেতে রেখে ট্রাম্পের জন্য পরিবেশন করতে পারবেন? এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আমেরিকা সফরের প্রতিটি দিক নিয়ে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ করতে হবে।

পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আমেরিকা সফরের মধ্য দিয়ে কাশ্মির সঙ্কট আরো একবার গোটা বিশ্ববাসীর সামনে পরিপূর্ণ রূপে দৃশ্যমান হয়েছে। কাশ্মির সঙ্কটকে দৃশ্যমান করার কৃতিত্ব ওই সাংবাদিককে প্রদান করা যায়, যিনি ট্রাম্পকে কাশ্মির বিষয়ে প্রশ্ন করেছেন এবং ট্রাম্প জবাবে দাবি করে বসেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাকে কাশ্মির সঙ্কটের মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা রাখার জন্য আবেদন জানিয়েছেন এবং তিনি এ আবেদন কবুল করেছেন। ট্রাম্পের এ মন্তব্যের পর ভারতে মাতম ছড়িয়ে পড়েছে। ভারত সরকার ট্রাম্পের এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে। নির্ভরযোগ্য কূটনৈতিক সূত্র বলছে, ২০১৯ সালের জুনে ট্রাম্প ও মোদির দুইবার সাক্ষাৎ ঘটেছে। একবার সাক্ষাৎ ঘটে জি টোয়েন্টি দেশগুলোর ওসাকা সম্মেলনে। আর দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় জাপানের প্রধানমন্ত্রীও শামিল ছিলেন।

ওই সাক্ষাৎগুলোতে মোদি ভারতীয় পাইলট অভিনন্দনের মুক্তিতে ট্রাম্পের ভূমিকার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং ট্রাম্পকে বলেন, তিনি যেন কাশ্মির সমস্যার সমাধানেও ভূমিকা রাখেন। ট্রাম্প সাথে সাথে ইতিবাচক সাড়া দেন। কিন্তু ইমরান খানের উপস্থিতিতে মোদির ইচ্ছাকে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করে ট্রাম্প মোদির জন্য এক বিশাল সমস্যা দাঁড় করিয়ে দিলেন। আর ভারত সরকার মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে ট্রাম্পের দাবিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। ভালোই হয়েছে, কারণ মোদির আসল রূপ ট্রাম্প জানতে পারলেন। তারপরও প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে যে, এ প্রত্যাখ্যান সত্ত্বেও মোদির পক্ষ থেকে ট্রাম্পের মাধ্যমে কাশ্মির সঙ্কটের সমাধান বের করার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

মোদি কাশ্মির সঙ্কটের কী ধরনের সমাধান বের করতে চাচ্ছেন? এ প্রশ্নের জবাব বেশ সরল ও সহজ। মোদি কাশ্মির সঙ্কটের তেমন সমাধান চাচ্ছেন, যেমনটা আফগানিস্তানে ট্রাম্পের দরকার। মোদি চাচ্ছেন, পাকিস্তান জাতিসঙ্ঘের প্রস্তাবগুলোর আলোকে কাশ্মির সঙ্কটের সমাধানের ওপর জোর দেয়া ত্যাগ করুক এবং কূটনৈতিক আত্মসমর্পণকে নিজের সফলতা রূপে অভিহিত করে আনন্দের গান গাইতে শুরু করুক। এটা সেই ফর্মুলা, যাতে জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও মনমোহন সিং একমত হয়েছিলেন এবং হুররিয়াত কনফারেন্সের প্রবীণ নেতা সায়্যিদ আলি শাহ গিলানি যাকে কাশ্মিরিদের সাথে গাদ্দারি বলে অভিহিত করেছিলেন। মনে রাখবেন, ভারত যখনই পাকিস্তানের সাথে আলোচনা শুরু করবে, তখন বেশ শক্ত অবস্থান অবলম্বন করার পর এ বাঁকা কথা বলবে যে, অধিকৃত জম্মু-কাশ্মির তার কাছেই থাকুক আর পাকিস্তান আজাদ কাশ্মির নিয়েই সন্তুষ্ট থাকুক। ট্রাম্পের দাবিকে ভারত সরকারের প্রত্যাখ্যান অনেক বড় মিথ্যাচারিতা। কেননা আমেরিকা ও ভারত সরকারের মধ্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের আমেরিকা সফরে ড. আফিয়া সিদ্দিকীর ট্র্যাজেডি আরো একবার বিশ্বের সামনে উঠে এসেছে। শুরুতে ইমরান খান এ বিষয়ে কথোপকথন থেকে দূরে ছিলেন। কিন্তু পরে যখন এক মার্কিন সাংবাদিক শাকিল আফ্রিদি সম্পর্কে প্রশ্ন করে বসলেন, তখন ইমরান খান ড. আফিয়া সিদ্দিকীর কথা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, উভয়ের বিনিময় নিয়ে কথা হতে পারে। ইমরান খান বলেন, অ্যাবোটাবাদে ওসামা বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযান আইএসআইর সরবরাহকৃত তথ্যের ভিত্তিতে জানানো হয়েছিল। যদি এটা সত্য হয়ে থাকে, তাহলে ড. শাকিল আফ্রিদির অপরাধ কিসের? সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরে ড. আফিয়া সিদ্দিকী সম্পর্কে যথারীতি কোনো কথাবার্তা হয়নি। তবে ইমরান খান জাতির এ কন্যাকে যদি পাকিস্তানে ফিরিয়ে আনেন, তাহলে তার অনেক অপূর্ণতা ও ত্র“টি উপেক্ষা করা সহজ হবে। এ সময় তার জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আফগান তালেবানকে আগামী মাস সেপ্টেম্বরের আগে অস্ত্র সমর্পণে প্রস্তুত করা। অস্ত্র সমর্পণের ঘোষণা আফগান তালেবানের ওই আলোচনার টিমকে করতে হবে, যার নেতা মোল্লা আব্দুল গনি ব্রাদার।

মোল্লা ব্রাদারকে ২০১০ সালের ফেব্র“য়ারিতে আমেরিকার চাপে পাকিস্তানে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, ‘আপনি আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাইয়ের সাথে গোপন আলোচনা কেন করছিলেন?’ আট বছর পর আমেরিকার কথা মোতাবেক পাকিস্তান তাকে ২০১৮ সালের অক্টোবরে মুক্তি দিলে তালেবান তাকে তাদের আলোচনার জন্য প্রতিনিধিদলের নেতা বানিয়ে দেয়। যে ব্যক্তিকে পাকিস্তান আট বছর পর্যন্ত তাদের কয়েদি বানিয়ে রেখেছিল, এখন পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা এ সাবেক কয়েদির কাছে মিনতি জানাচ্ছেন যে, আপনি আফগানিস্তানে অস্ত্র সমর্পণ করুন। এ অস্ত্র সমর্পণ তালেবানের নয়, আমেরিকার প্রয়োজন। ২০০১ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে আফগানিস্তানে আমেরিকার আড়াই হাজার সৈন্য মারা গেছে। অপর দিকে, প্রাইভেট কোম্পানির মাধ্যমে আফগানিস্তানে এসে মারা যাওয়া মার্কিনিদের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। গত ১৮ বছরে আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর প্রাণহানির সংখ্যা ৬০ হাজারের বেশি। অপর দিকে, তালেবানের প্রাণহানির প্রায় ৫০ হাজার। আফগানিস্তানের যুদ্ধে আমেরিকাকে বার্ষিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। এ যুদ্ধ থেকে তালেবানের বের হওয়ার জন্য কোনো তাড়াহুড়া নেই। কেননা, তারা দেখতে পাচ্ছে তাদের বিজয় সন্নিকটেই।

ট্রাম্প ইমরান খানকে সামনে বসিয়ে পুরো আফগান জাতিকে হুমকি দিয়ে বসেছেন। তিনি বলেছেন, ‘মাত্র ১০ দিনের মধ্যে আফগানিস্তানকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে পারি। কিন্তু এটা করতে চাচ্ছি না।’ এই হুমকিতে আফগান সরকার ও তালেবান উভয়ে নিন্দা জানতে শুরু করেছে। ট্রাম্প তার হুমকির জন্য দুঃখ প্রকাশ না করলে পাকিস্তানের জন্য আফগান তালেবানকে অস্ত্র সমর্পণে রাজি করা বেশ কঠিন হয়ে যাবে। ট্রাম্পের দুঃখ প্রকাশ না করা ছাড়া আফগান তালেবানের অস্ত্র সমর্পণ ট্রাম্পের ‘হুমকির ফল’ বলে আখ্যায়িত করা হবে। আর আইএসআইএস এর ফায়দা উঠিয়ে আফগান তালেবানের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির চেষ্টা করবে।

সুতরাং ইমরান খানের আমেরিকা সফরের সময় ট্রাম্পের হুমকি আফগান সমঝোতা কার্যক্রমকে নতুন ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে। আমেরিকা সফরের সময় ইমরান খানকে বারবার পাকিস্তান মিডিয়ার ওপর সেন্সরশিপ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয়েছে। খান সাহেব বারবারই পাকিস্তানি মিডিয়াকে ‘স্বাধীন’ বলে অভিহিত করেছেন। অথচ বাস্তব অবস্থা জানেন সবাই। মিডিয়া সম্পর্কে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে ইমরান খানের বাচনভঙ্গিতে ওই দৃঢ়তা ছিল না, যা থাকা উচিত। অপর এক স্থানে তিনি স্বীকার করেছেন, আমি মিডিয়া সম্পর্কে ট্রাম্পের মতো কথা বলছি। তবে ট্রাম্প মিডিয়ার সমালোচনা করতে পারেন, কিন্তু কোনো টিভি চ্যানেল বন্ধ করতে পারেন না। ইমরান খান টিভি চ্যানেল বন্ধও করেন এবং তাদের পাত্তাও দেন না। এ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে বলতে হয়, ইমরান খান ট্রাম্পের চেয়েও বড় নেতা।

হামিদ মীর : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট,
প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)

পাকিস্তানের দৈনিক জং থেকে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব


আরো সংবাদ



premium cement