২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ঋণখেলাপিদের শাস্তি দিতে বাধা কোথায়?

- ফাইল ছবি

মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের ওপর ভর করে গড়ে উঠেছিল ব্যাংক ব্যবস্থা। কিন্তু সে আস্থা ও বিশ্বাস আজ তলানিতে। মানুষ তাদের কষ্টার্জিত অর্থ মুনাফার আশায় ব্যাংকে জমা রাখে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন আর সহায়ক নয়। বর্তমান সরকারের দশ বছরের শাসনামলে ব্যাংক খাতে যে লুটপাট হয়েছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। এই দায় সরকারও এড়াতে পারে না। গত ২২ জুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে দেশের ৩০০ জন শীর্ষ ঋণখেলাপির একটি তালিকা প্রকাশ করেছেন। তবে সরষের ভেতর ভূত প্রবাদটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রবল হয়ে উঠেছে। দেশের ব্যাংকিং সেক্টেরে ভূতের আছর না থাকলেও একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজের কারণে ব্যাংক ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

বাংলাদেশ ব্যাংকও সে ভূতকে পরাস্ত করতে পারেনি। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভয়ঙ্কর ধরনের উদার ঋণ বিতরণ করছে জনতা ব্যাংক। এক গ্রাহককেই মাত্র ছয় বছরে তারা দিয়েছে পাঁচ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণসুবিধা। অথচ জনতা ব্যাংকের মোট মূলধন ২ হাজার ৯৭৯ কোটি টাকা। মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ দেয়ার সুযোগ আছে। অর্থাৎ এক গ্রাহক ৭৫০ কোটি টাকার বেশি ঋণ পেতে পারেন না। অথচ এই ক্ষেত্রে ঋণ দেয়া হয়েছে মোট মূলধনের প্রায় দ্বিগুণ। কারো কারো মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, নিয়মবহির্ভূত এই কাজ কিভাবে সম্পন্ন হলো? জানা গেছে, সরকারের নিয়োগ দেয়া পরিচালনা পর্ষদই এই অন্যায় কাজটি করেছে। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবুল বারকাত সে সময় জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৪৯ সালের ব্যাংকিং রেগুলেশন অ্যাক্ট জারি হওয়ার পর ব্যাংকের পতন ঠেকানো যায়নি। ১৯৪৭ সালের পর থেকে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত গড়ে ৪০টি ব্যাংকের লালবাতি জ্বলেছিল। এমনকি আমেরিকায়ও ২০০৮ সালে সাব-প্রাইম সঙ্কটের জের ধরে কেবল ২০০৯ সালে ছোট ও মাঝারি আয়তনের প্রায় ১৩৩টি ব্যাংকের পতন ঘটে। অথচ ২০০৮ সালে এই সংখ্যা ২৫ ছিল।

বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থাও পতনের দিকে তা ঋণ প্রদানের হার দেখলেই অনুধাবন করা যাবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছরের মার্চ পর্যন্ত দেশের ব্যাংক খাতের ঋণ বিতরণ ৯ লাখ ৩৩ হাজার ৭২৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে ১১ দশমিক ৮৭ শতাংশই খেলাপি। প্রতিবেদনে দেখা যায়, মার্চ শেষে সরকারি খাতের ছয়টি ব্যাংকের এক লাখ ৬৭ হাজার ৩০৩ কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ৫৩ হাজার ৮৭৯ কোটি টাকাই খেলাপি। গড়ে ব্যাংকগুলোর ৩২ দশমিক ২০ শতাংশ ঋণই খেলাপি হয়ে গেছে। অর্থাৎ মোট খেলাপির ঋণের প্রায় অর্ধেকই সরকারি খাতের ছয় ব্যাংকের। অন্য দিকে বেসরকারি খাতের ৪০টি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ সাত লাখ পাঁচ হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৪৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকাই খেলাপি, যা মোট ঋণের ৭ দশমিক ০৮ শতাংশ। বিদেশী ৯টি ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি হয়েছে দুই হাজার ২৫৭ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ৬ দশমিক ২০ শতাংশ। বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ২৪ হাজার ৬০২ কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ চার হাজার ৭৮৮ কোটি টাকা, যা তাদের মোট ঋণের ১৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ ঋণই খেলাপি। (সূত্র : যুগান্তর ১১.৬.১৯)

ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের ঊর্ধ্বগতি কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। দিন দিন খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। এই খেলাপি ঋণের কারণে সুদহার লাগামহীনভাবে বেড়েই চলেছে। খেলাপি ঋণ কমলে সুদহার এমনিতেই কমে যেত। অথচ সরকার এ দিকে নজর না দিয়ে ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ করতে বলেছে এবং ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো নতুন করে সুযোগ দিচ্ছে। বিষয়টা এমন যে, ঘোড়ার আগে গাড়ি দৌড়াবে। অর্থমন্ত্রী গত ১০ জানুয়ারি সব ব্যাংক মালিকের সাথে বৈঠক শেষে বলেছিলেন, আজ থেকে খেলাপি ঋণ আর এক টাকাও বাড়বে না। অথচ এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত এই তিন মাসেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে খেলাপি ঋণ এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ কোটি টাকা।

স্বাধীনতার ৪৭ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের খেলাপি ঋণের চিত্র হচ্ছে, ২০১১ সালে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২২ হাজার ৬৪৪ টাকা, ২০১২ সালে ৪২ হাজার ৭২৫ টাকা, ২০১৩ সালে ৪০ হাজার ৫৮৩ টাকা, ২০১৪ সালে ৫০ হাজার ১৫৫ টাকা, ২০১৫ সালে ৫১ হাজার ৩৭১ টাকা, ২০১৬ সালে ৬২ হাজার ১৭২ টাকা, ২০১৭ সালে ৭৪ হাজার ৩০৩ টাকা, ২০১৮ সালে ৯৩ হাজার ৯১১ টাকা, ২০১৯ সালের মার্চ পর্যন্ত এক লাখ ১০ হাজার ৮৭৩ টাকা। (সূত্র : প্রথম আলো ১১.৬.১৯)

উন্নয়নের স্লোগান আর প্রবৃদ্ধির ঠেলায় ব্যাংক খাত বেসামাল। দেশের প্রবৃদ্ধি যেখানে ৮ শতাংশ ছাড়িয়ে যাচ্ছে, সেখানে ব্যাংক খাতে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কেন বিরাজ করছে? এ বিষয়টি উদঘাটন করা প্রয়োজন। বিনিয়োগের জন্য শিল্পঋণ পুরোটাই যেখানে ব্যাংকনির্ভর সেখানে চলছে অর্থ সঙ্কটের চরম হাহাকার। এ নিয়ে ক্ষমতাসীনদের মাথাব্যথা না থাকলেও অনেকের মনে প্রশ্ন, তাহলে ব্যাংকের এত টাকা গেল কোথায়? ব্যাংকিং ব্যবস্থার এত ভরাডুবি অতীতে ছিল না। ১৯৯১ থেকে ৯৫ সাল পর্যন্ত ব্যাংকিং ব্যবস্থার রিফর্ম ও পরিবর্তন হয়। এমনকি ব্যাংক খাত অনেকটা এগিয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে ব্যাংকের যা অবস্থা, তা গত ১০ বছরে হয়েছে। এ নাজুক পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক দস্যুতাই দায়ী। রাজনৈতিক বিবেচনায় বড় বড় ঋণ নিয়ম ভঙ্গ করে দেয়া হয়েছে। নিকট অতীতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে কিছু ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি বদল করা হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে বৃহত্তম ঋণখেলাপির বকেয়া আদায় করার প্রেক্ষিতে তাদের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রি করে হলেও বকেয়া ঋণ আদায় করার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে। ব্যাংকিং খাতের মহাসঙ্কটের সময়েও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কার্যকর ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি। বরং ঋণখেলাপিদের সুবিধা দিতে দফায় দফায় নীতিমালা পরিবর্তন করেছে।

একটি আধুনিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক ভিত্তি যখন দুর্বল হয়ে পড়ে সেখানে হাজারো অন্যায় অবিচার জুলুম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গণতান্ত্রিক দেশে বিরোধী দল ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে। সরকার ভুল করলে বিরোধী দল তা ধরিয়ে দেয়। কিন্তু যে দেশে সরকারি দল আর বিরোধী দল একই কোরাস গায়, সে দেশে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স থাকে কী করে? ব্যাংকিং খাতে এত অস্থিরতা অতীতে কখনো দৃশ্যমান হয়নি। ঋণদান পদ্ধতি পরিবর্তন করলেই সমস্যার সমাধান হবে না। এ সমস্যার সমাধান করতে হলে সবার আগে রাজনৈতিক দস্যুতা ও ক্ষমতার দাপটের প্রয়োগ বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক কারণেই ব্যাংকিং খাতের বেশির ভাগ দুর্নীতির বিচার হয়নি। বরং খেলাপিদের কিভাবে রক্ষা করা যায় সে বিষয়ে সহায়তা দেয়া হয়েছে। সাধারণ গ্রাহক যাদের টাকায় ব্যাংক চলে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়েই চলেছে। অনেক গ্রাহক বুঝতে পারেন না তারা কোন ব্যাংকে টাকা রাখবেন। অনেকে আবার মাটির ব্যাংকে টাকা রাখার চিন্তা করছেন। এভাবে যদি মানুষের আস্থার জায়গাটি নষ্ট হতে থাকে তাহলে অর্থনীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা সহজেই অনুমেয়।


আরো সংবাদ



premium cement