২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

জরিমানাই যথেষ্ট নয়

-

খাবারে ভেজাল বা খাদ্যপণ্যে ভেজাল আমাদের দেশের একটা পুরনো সমস্যা। কিন্তু ইদানীং বিষয়টা মাত্রা অতিক্রম করেছে। জনস্বাস্থ্যের জন্য চরম অনিষ্টকর এই বিষয়টা নিয়ে যথাযথ প্রশাসনিক পদক্ষেপ না নেয়ায় দিনকে দিন সমস্যাটা আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে।

প্রশাসন পরিচালিত মোবাইল কোর্টের ভেজালবিরোধী অভিযানের কিছু খবরাখবর আমরা প্রতিনিয়তই গণমাধ্যমের কল্যাণে অবগত হই। তারা হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে ইদানীং খাবারের হোটেল এবং প্রতিদিনকার খাবার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে হানা দিচ্ছে। প্রশাসন বাসী, পচা, কাপড়ের রং মেশানো খাবারসহ নোংরা স্যাঁতসেতে পোকামাকড়ে ভরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার প্রস্তুত করে মানুষকে খাওয়ানো এবং বাজারজাত করার অপরাধে শাস্তি দিচ্ছে। কিন্তু তারা যে শাস্তি দিচ্ছে তা লঘুদণ্ডের চেয়েও কম। পঞ্চাশ হাজার থেকে দুই তিন লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে দু-তিন মাসের জেল দিয়ে মানুষের জীবন বিপন্নকারী এসব প্রতিষ্ঠানের অপকর্ম কোনোভাবেই দমানো যাবে না। এরা অর্থদণ্ড পরিশোধ করে দ্বিগুণ উৎসাহে একই কাজ করতে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য দু-তিন লাখ টাকা কোনো বিষয়ই নয়। এরা জানে বছরে এক দুইবার মোবাইল কোর্ট তাদের কিছু জেলজরিমানা করবে। বছরের বাকি দিনগুলোতে তারা চুটিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাবে।

পত্রিকায় দেখলাম, রংপুরে হোটেলগুলোতে ভেজালবিরোধী অভিযানের পর হোটেল মালিকরা ধর্মঘট ডেকেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারা বাসি পচা খাবার খাওয়াবে সেখানে প্রশাসন বাগড়া দিতে আসবে কেন? কত বড় স্পর্ধা! তাদের মানসিকতা এমন যে, মানুষকে তারা জোর করেই খাদ্যের নামে অখাদ্য খেতে বাধ্য করবে। অথচ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না।

বাংলাদেশের ৯৯ শতাংশ খাবার হোটেলে স্বাস্থ্যসম্মত খাবারের কোনো ব্যবস্থা নেই। হয় সেখানে বাসি পচা খাবার দেয়া হচ্ছে নয়তো নোংরা অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার প্রস্তুত করা হচ্ছে। একটানা একটা সমস্যা আছেই খাবার হোটেলগুলোতে। আগের দিনের বেঁচে যাওয়া খাবার পরের দিনের খাবারের সাথে মিশেল করে খাওয়ানো এদের কাছে কোনো বিষয়ই নয়। অথচ এসব বিষয়ে সামান্য পদক্ষেপেই এরা একজোট হয়ে ধর্মঘট ডেকে বসে। অপরাধীদের এই দৌরাত্ম্যের পেছনের শক্তি কারা তা প্রশাসনের খতিয়ে দেখা জরুরি। নেপথ্য শক্তির প্রভাব খর্ব করতে না পারলে এই নৈরাজ্য কোনোভাবেই দমানো যাবে না।

বাইরের দেশে দেখেছি হোটেল রেঁস্তোরাগুলোতে প্রতিদিন অভিযান চালানো হয়। আগের দিনের কোনো খাবার পেলে সাথে সাথে হোটেলের লাইসেন্স স্থগিত করা হয়। আমাদের দেশের ক’টি হোটেল আর রেস্তোরাঁর লাইসেন্স আছে তা আমরা জানি না। প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং নিয়মিত তদারকির অভাবে যেকোনো সেক্টরেরই নানা অপরাধপ্রবণতা দানা বেঁধে ওঠে। হোটেল রেস্তোরাঁগুলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বছরে এক-দুইবার এসব অভিযান আর দন্তহীন শিশুর কামড়ের মতো শাস্তি দিয়ে এই অপরাধী চক্রের জীবনঘাতী ব্যবসার টিকিটি নড়ানো যাবে না।

এ বিষয়ে কঠোর নীতিমালা, আইন এবং শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। একজন মানুষকে সরাসরি হত্যার অপরাধে যদি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকে তাহলে খাদ্যে ভেজাল দেয়ার অপরাধে বা খাবার বিষাক্ত করে খাইয়ে অসংখ্য মানুষকে অসুস্থ বানিয়ে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়ার অপরাধে একই শাস্তি কেন প্রযোজ্য হবে না? এ ক্ষেত্রে State power act 74-এর প্রয়োগ করলে অনেকখানি সমাধান হতে পারে। যেখানে এ ধরনের অপরাধের বিপরীতে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

আমাদের দেশের বড় ফুড আউলেটগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। এখানেও বছরে দু-একবার অভিযান। এসব মেগাসপের হিমায়িত খাবারগুলোর অবস্থা খুবই বাজে। ফ্রোজেন এসব খাবারের গায়ের উৎপাদন তারিখ দেখে চোখ বন্ধ করে আমরা দেদার কিনে ফেলি। কিন্তু এগুলো কতটুকু তাপমাত্রায় কিভাবে সংরক্ষণ করা হয় তার খোঁজ আমরা ক’জন রাখি। অথবা এসব খাবার ঠিক আছে কি না তা কে আমাদের নিশ্চিত করবে তার কোনো সমাধান নেই। এরপর প্রতিদিন যেসব প্রসেস করা মাছ গোশত আমরা সেখান থেকে কিনি তারও ভালোমন্দ নির্ণয়ের কোনো মাপকাঠি আমাদের সামনে থাকে না। যখনই মোবাইল কোর্ট অভিযান চালায় তখনি এসব খাবারের মধ্যে গলদ ধরা পড়ে। তার মানে প্রায়ই এসব কাঁচা খাদ্যদ্রব্যে সমস্যা থাকছেই।

এরপর খোলাবাজার থেকে যেসব মাছ গোশত আমরা কিনছি তার ভালো-মন্দ আমরা খরিদ্দাররা নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকে নির্ণয় করে কিনে থাকি। কিন্তু অসাধু বিক্রেতাদের কারসাজির কাছে আমাদের অভিজ্ঞতা কতটুকু কার্যকর আমরা কিভাবে নির্ণয় করব। যেমন ক’দিন আগের পত্রিকায় দেখলাম নিউমার্কেটের এক গোশতের দোকানে অভিযান চালিয়ে সেখান থেকে রং মাখানো গোশত উদ্ধার করা হয়েছে। জানা গেল ভারত থেকে নিয়ে আসা মহিষের গোশতে রঙ মেখে গরুর গোশত বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছিল। মাছের কানকায় রঙ মাখিয়ে পচা মাছ তাজা হিসেবে বিক্রির খবরটি আমরা সবাই জানি। আবার দেখলাম একটি নামকরা মিষ্টির দোকানের কারখানায় রাখা সারিসারি কড়াইয়ের মধ্যে মিষ্টি ভাসছে আর মিষ্টির সাথে ভাসছে অসংখ্য তেলাপোকা। এসব তেলাপোকার জীবাণু মিশ্রিত মিষ্টি স্তরে স্তরে সাজিয়ে রাখা হয় কাচের শোকেসে। আমরা প্রতিদিন চড়া দামে এই বিষাক্ত মিষ্টি কিনে খাচ্ছি।

খাদ্যে ভেজাল এবং নোংরা পরিবেশ নিয়ে বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরলাম। এখনই যদি আমরা এই জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক না হই তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ পুরোটাই অন্ধকার। নাগরিক হিসেবে আমাদের পরামর্শ এবং দাবি থাকবে হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি না করে খাদ্যে ভেজালকারীদের এবং বিষাক্ত খাদ্য বিপণনকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক। তার জন্য প্রশাসনিক জনবল ও সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং আইনের কঠোর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। সাথে সাথে গণমাধ্যমগুলো সমান্তরালভাবে গণসচেতনতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এ বিষয়ে নিজ নিজ ধর্মের অনুসারীদের সচেতন করতে পারে। সব ধর্মেই মানুষের জীবন বিপন্নকারী যেকোনো অনৈতিক কর্মের বিষয়ে কঠিনভাবে নিষেধ করা হয়েছে।

সর্বোপরি, সব মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই জীবনঘাতী, অপরিণামদর্শী, গর্হিত অপরাধ সমূলে বিনাশের উদ্যোগ গ্রহণ করা এখন সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দাবি।


আরো সংবাদ



premium cement