২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ফান্দে পড়িয়া বগায় কান্দে রে

নরেন্দ্র মোদি - ছবি : সংগ্রহ

বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিতে পাকিস্তানের লাহোর গিয়েছিলেন। এরপর অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ ৪৮ বছর বয়োপ্রাপ্ত হলো, এখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অফিসিয়ালি একই আছে। কিন্তু কার্যত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির স্বরূপ কী? অনেকের মতে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দাঁড়িয়েছে পার্শ্ববর্তী একটি দেশের প্রভাব স্বীকার করে অন্যান্য দেশ থেকে উন্নয়ন সাহায্য এবং ঋণ গ্রহণ করার নীতিতে। এ কারণে সে দেশটিকে বাংলাদেশের দেদার বখরা দিতে হয়েছে এবং আজ রোহিঙ্গা সঙ্কটের মতো গুরুতর সমস্যায় আমরা পড়েছি। অধিকন্তু ভারতের সরকার প্রায় ৮০ হাজার মুসলমানকে বাংলাদেশে ঠেলে দেয়ার পাঁয়তারা করছে।

এ কথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত এবং ১৯৪৭ সালের পর থেকে ১৯৭১ সাল অবধি দেশটি ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তানের অংশ ছিল। এ দেশের মুসলমানেরা ধর্মপ্রাণ এবং তৎকালীন পাকিস্তান অর্জনে তাদের ভূমিকা ছিল প্রশ্নাতীত। সে পাকিস্তান প্রশাসনের ভুলনীতি এবং পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে ‘শত্র“দেশ’ ভারতের মধ্য দিয়ে হাজারোর্ধ্ব মাইলের ভৌগোলিক ব্যবধান তদানীন্তন দেশটির দুই অংশের লোকদের মধ্যে মানসিক দূরত্বের সৃষ্টি করে। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ মোজাফফর) বর্ষীয়ান নেতা ডা: আব্দুল মালেককে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তো ভারতে ছিলেন, ভারতীয় মুসলমানেরা আপনাদের কেমন সাহায্য সহযোগিতা করেছে?’ তিনি বললেন, “সেখানে মুসলমানদের কেউ আমাদের আশ্রয় দেয়নি এবং কোনো প্রকার সাহায্যও করেনি। উল্টো তারা বকেছে, ‘আমাদের পালানোর মতো একটা জায়গা ছিল, সেটাও নষ্ট করে এলেন!’ সাহায্য সহযোগিতা যা করার সেখানকার হিন্দুরাই সানন্দে করেছে।”


বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’; তবুও সবার ক্ষেত্রে কার্যকর করা যাচ্ছে না। সাম্প্রতিক নির্বাচনের প্রাক্কালে বিজয়ী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা জোরগলায় বলেছেন, ‘মুসলমান লোগোকো খতম কর দো’। ভারতের অহিংসাবাদী ধর্মীয় নেতা বিনোভা ভাবে কংগ্রেসের শাসনামলে গো-হত্যার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছিলেন। বিজেপি শাসনামলে গো-মাংস ভক্ষণের দায়ে ভারতের একাধিক অঞ্চলে বহু মুসলমানকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়েছে। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তার প্ররোচনায় ২০০২ সালে সেখানে প্রায় ২০০০ মুসলমানকে হত্যা করা হয়। তখন বিজেপি নেতা অটল বিহারি বাজপেয়ি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে কংগ্রেস নেতা নরসিমা রাওয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে বিজেপি নেতারা অযোধ্যার বাবরি মসজিদ সোল্লাসে ভেঙে ফেলেন। প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগে সেখানে রামমন্দির নির্মাণ করার প্রতিশ্র“তি দিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। তা সত্ত্বেও প্রথমে ২০১৪ সালে এবং এবার ২০১৯ সালে বিজেপি বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে মোদি পর পর দু’বার ভারতের প্রধানমন্ত্রী হলেন।

বিজেপি নেতারা বরাবরই ভারতে হিন্দুত্ববাদকে এগিয়ে নিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, যদিও কাগজ-কলমে, সংবিধান অনুসারে ভারত একটি সেকুলার রাষ্ট্র। আমি তখন টাঙ্গাইলে। ১৯৮৭ সালের এপ্রিল-মে মাসে ভারতের মিরাটে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয় এবং বেশ কিছু মুসলমান তাতে নিহত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় টাঙ্গাইলে হিন্দুদের কতেক মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হিন্দুদের মাঝে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এ অবস্থায় হিন্দুদের মনে সাহস জোগাতে টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগ সভাপতি শাহজাহান সাহেব টাঙ্গাইল পাবলিক লাইব্রেরির শহীদ মিনার চত্বরে এক জনসভা আহ্বান করেন। বক্তৃতার একপর্যায়ে মুসলমানদের উদ্দেশে বললেন, ‘পাকিস্তানিরা নির্যাতন করলে ভালো লাগে আর হিন্দুরা নির্যাতন করলে ভালো লাগে না। তাই না?’ আমি তার বক্তব্য শুনে অবাক হয়ে ভাবলাম- এ তো কোনো নেতার বক্তব্য হতে পারে না।

‘ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে সরাসরি বা কোনো মাধ্যম দিয়ে আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর একটা যোগাযোগ হয়েছিল বলে মনে হয়। এ কথা এ জন্য বলছি যে, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হওয়া ও প্রশিক্ষণ নেয়ার আগেই মুজিব বাহিনীর সদস্যরা প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পেতে শুরু করে।’ (এ কে খন্দকার, ১৯৭১ ভেতরে বাইরে, ২০১৪; পৃষ্ঠা ১৩৭)। ‘মুজিব বাহিনী অত্যাধুনিক অস্ত্রগুলো ভারতীয়দের কাছ থেকে পেয়েছিল। ভারতীয়রা তাদের যাতায়াতের জন্য পরিবহন এবং সম্মানীও দিত।’ (প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৫)। সব মিলিয়ে আওয়ামী লীগ ভারতের কাছে দায়বদ্ধ। ভারতে যে সরকারই আসুক। ভারতকে তাদের খুশি রাখতেই হবে। ভারতও চায় ছলে-বলে-কৌশলে তারাই বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসুক। তারা দেশে লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করেছে। সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় থাকাকালে প্রতি সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে চাঁদপুরের টাটকা ইলিশ পাঠাতেন।

বাংলাদেশ তিন দিক থেকে ভারত পরিবেষ্টিত জনভারাক্রান্ত একটি ছোট্ট দরিদ্র দেশ। এহেন ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের যেকোনো সরকারের জন্য ভারতকে খুশি রাখা শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যই শুধু নয়, দেশের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও জরুরি। ভারত সে সুযোগ নিচ্ছে। কোনো কারণে যদি ভারত বাংলাদেশের ওপর দিয়ে মার্চ করে যায়, তবে পৃথিবীর কোনো দেশ বিশাল ভারতকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়াবে বলে মনে হয় না। কারণ, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি দূরদর্শী হতে হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে। তাই মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের অমানুষিক নির্যাতন করে তাড়িয়ে দিলে তারা যখন নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করে দলে দলে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে, সেই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মিয়ানমার গিয়ে সে দেশের সাথে সংহতি প্রকাশ করে এলেন। এরপরও ভারত বাংলাদেশের ‘অকৃত্রিম বন্ধু’! এ যেন সেই প্রবাদ- ‘যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়/ তথাপি আমার গুরুর নাম নিত্যানন্দ রায়’। সেই মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের খাদ্যমন্ত্রী মিয়ানমারে চাল কিনতে গেছেন। একটি মুসলিম অধ্যুষিত দেশে আগত নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতি এর চেয়ে অমানবিক আচরণ আর কী হতে পারে!

১৯৮০-এর দশকে টাঙ্গাইল অবস্থানকালে এক মেঘলা দুপুরে সত্যেন চ্যাটার্জি নামে কাগমারী সরকারি কলেজের গণিতের এক শিক্ষক আমার বাসায় এলেন। হাতে তার একটি ফাইল ও একটি ফটোর অ্যালবাম। অকৃতদার সত্যেন তার মাকে নিয়ে ভারতের বিভিন্ন তীর্থস্থান ভ্রমণ করেন। অ্যালবামটিতে ভারতের নানা স্থানের মন্দিরের চিত্র। এসব মন্দিরের প্রায় সবই ভারতের স্বাধীনতার পর কংগ্রেস আমলে নির্মিত। তিনি বললেন, এমন অসংখ্য নতুন মন্দির ভারতে নির্মিত হয়েছে, যেগুলো দেখার জন্যই তিনি তার মাকে নিয়ে ভারতে যান। এসব মন্দিরে পুণ্যার্থী উপস্থিতির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। ফাইলটিতে তিনি যে ভ্রমণকাহিনী লিখছেন তার পাণ্ডুলিপি। আজ এত দিন পর নিশ্চিত হলাম, বিজেপির বীজ কংগ্রেস আমলেই বপিত হয়েছিল, যা পত্রপল্লবে বিকশিত হয়ে আজ তারা কংগ্রেসকে টপকে ক্ষমতায়। হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের ভয়ে হিন্দু অ্যাকটিভিস্টদের নির্মূলের কথা কংগ্রেস কোনো দিনই ভাবেনি।

আমাদের মুক্তির পথ একটাই- একতা। জাতি আজ শতধাবিভক্ত। ঈমান আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে পরবন্দনামুক্ত করতে পারে। এই লক্ষ্যে জাতিকে বিশ্বাস করতে হবে- ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, আল্লাহ তায়ালা তাদের ওয়াদা দিচ্ছেন যে, তিনি তাদেরকে পৃথিবীতে প্রতিনিধিত্ব দান করবেনই। যেমন তিনি প্রতিনিধিত্ব দান করেছিলেন তাদের পূর্ববর্তী লোকদেরকে এবং তিনি অবশ্যই তাদের জন্য সুদৃঢ় করবেন তাদের দ্বীনকে, যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তাদের ভয়ভীতির পরিবর্তে অবশ্যই তাদেরকে নিরাপত্তা দান করবেন। তারা আমার ইবাদত করবে এবং আমার সাথে কাউকে শরিক করবে না। এরপর যারা অকৃতজ্ঞ হবে, তারা তো সত্য ত্যাগী।’ (সূরা নূর ২৪, আয়াত ৫৫)। উপরন্তু ইসলামী বিধান মতে, মানুষে মানুষে কোনো ভেদাভেদ নেই এবং ‘সমগ্র মানবজাতি একই পরিবারভুক্ত আর আল্লাহর কাছে প্রিয় হচ্ছে ওই সৃষ্টি, যে আল্লাহর অপরাপর সৃষ্টিকুলের প্রতি অনুগ্রহ করে।’ (বায়হাকি, সূত্র : মিশকাত, পৃ. ৪২৫)। এরই অনুসরণ বাঞ্ছনীয়।

লেখক : অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার


আরো সংবাদ



premium cement