২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দেশে কুষ্ঠ কেন আজো অবহেলিত বিষয়?

কুষ্ঠ নির্মূলের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০ বাস্তবায়িত হওয়া উচিত - প্রতীকী ছবি

প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের শেষ রোববার বিশ্বকুষ্ঠ দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এ বছর ২৭ জানুয়ারি দিবসটি উদযাপিত হবে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানে কুষ্ঠরোগের বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই দিবস পালন করা হয়।

এ দিবসের উদ্দেশ্য হলো কুষ্ঠ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এই রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সাহায্য করা। জনবিচ্ছিন্ন কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সমাজে পুনঃগ্রহণ, সর্বপ্রকার কুষ্ঠজনিত কুসংস্কার দূরীকরণ, এ সব লক্ষ্য সামনে নিয়ে জনসাধারণ এবং কুষ্ঠ আক্রান্ত ব্যক্তিদের সঠিক তথ্য ও শিক্ষা দেয়াই হচ্ছে এই দিবসের লক্ষ্য।

এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ‘বৈষম্য ও কুসংস্কার দূর করা’। জেনেভাভিত্তিক কুষ্ঠবিরোধী সংগঠনগুলোর আন্তর্জাতিক ফেডারেশন ‘আইলেপ’, যা ১৩টি আন্তর্জাতিক সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত, দিবসটি পালনে উদ্যোগ নেয়।
আইলেপের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা রাউল ফোলেরো বিশ্বব্যাপী কুষ্ঠরোগ বিষয়ক ব্যাপক সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে ও কুষ্ঠরোগের প্রতি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ১৯৫৩ সালে এ দিবস উদযাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।

কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। মানবসভ্যতার বিকাশ ও সামাজিক উন্নতির সাথে সাথে উন্নত দেশগুলাতে এই রোগের প্রাদুর্ভাব একবারেই কমে এসেছে। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কুষ্ঠ রোগের প্রাদুর্ভাব এখনো রয়ে গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশসহ ব্রাজিল, ভারত, নেপাল, মোজাম্বিক, অ্যাঙ্গোলা, কঙ্গো এবং তানজানিয়ায় কুষ্ঠরোগী শনাক্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশে কুষ্ঠ রোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হলেও এবং নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও এখনো রোগটি জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে রয়ে গেছে।

দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ (টিএলএমআইবি)-এর মতে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতি বছর প্রায় চার হাজার নতুন কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বাংলাদেশে শনাক্ত হচ্ছে।

কুষ্ঠ সাধারণত চিকিৎসাবিহীন সংক্রামক ধরনের রোগীর হাঁচি কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক ¯œায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘা ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। চামড়ার অবশ দাগ দিয়ে এই রোগ শুরু হয়, অনেক সময় দানা গুটিও দেখা দেয়।

চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো বাতাসের অভাব ইত্যাদি এই রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ।

১৮৭৩ সালে নরওয়ের চিকিৎসাবিজ্ঞানী ডা: আরমার হ্যানসেন কুষ্ঠরোগের জীবাণু ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রী’ আবিষ্কার করেন। এই আবিষ্কারের ফলে প্রমাণিত হয় যে, কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। হাজার হাজার বছর ধরে কুষ্ঠরোগ ও কুষ্ঠরোগাক্রান্ত ব্যক্তিদের অভিশপ্ত এবং অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হতো এবং অনেককেই দীপান্তরিত, বনবাস, গৃহচ্যুত করা হতো। সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যেত। হাজার হাজার কুষ্ঠরোগী মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতো।

হাজার বছরের অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কার মানুষের মনে এমনভাবে গেঁথে আছে যে, অনেক রোগী সামাজিক প্রতিক্রিয়ার ভয়ে যথাসময়ে চিকিৎসা নিতে দেরি করে এবং ভয়াবহতা ডেকে আনে। বিশ্বকুষ্ঠ দিবসের উদ্দেশ্য হলো এসব রোগীকে অভয় দেয়ার মাধ্যমে চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসা।

বিকলাঙ্গতাই হচ্ছে কুষ্ঠজনিত সব সামাজিক ও শারীরিক সমস্যার প্রধান কারণ। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই চিকিৎসায় আসা অতীব জরুরি প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য। কুষ্ঠরোগ প্রাথমিক পর্যায়ে চিহ্নিত হলে ও চিকিৎসার আওতায় এলে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

বাংলাদেশে কুষ্ঠ নির্মূলের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। সরকারিভাবে কম গুরুত্ব দেয়ার কারণে এ খাতে বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। বাজেট স্বল্পতার কারণে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগী খুঁজে বের করার জন্য প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব, এই রোগকে ঘিরে কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাব আছে। চিকিৎসকদের কুষ্ঠ বিষয়ে ধারণা কম থাকায় রোগী চিহ্নিত করা ও চিকিৎসা কাজ ব্যাহত হয়, দেশের সর্বত্র চিকিৎসা সুবিধা সমানভাবে প্রাপ্তিসাধ্য নয় এবং দেশে কুষ্ঠের কারণে বিকলাঙ্গদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার অভাব।

আমাদের দেশে কুষ্ঠের বিশেষায়িত সেবা খুবই অপ্রতুল। কুষ্ঠরোগীদের সেবা দেয়ার জন্য বাংলাদেশে তিনটি সরকারি কুষ্ঠ হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু এই হাসপাতালগুলোর পূর্ণাঙ্গ সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। অন্ততপক্ষে দেশের সব সরকারি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কুষ্ঠ সেবা দেয়ার জন্য উপযোগী করা দরকার। এতে করে স্থানীয় লোকজন এই সেবা সহজেই নিতে পারবে।

কুষ্ঠবিষয়ক প্রায় ৮০ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা এনজিও কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালগুলো দিয়ে থাকে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের এই সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এই পরিস্থিতিেিত সরকার এগিয়ে না এলে সমস্যা বাড়বে, প্রতিবন্ধিতা আরো বেড়ে যাবে। অধিকার কর্মীরা মনে করেন, কুষ্ঠের চিকিৎসা একীভূত ব্যবস্থার মাধ্যমে দিলে ভালো ফল আশা করা যেতে পারে।

কুষ্ঠ নির্মূলের জন্য কৌশলগত পরিকল্পনা ২০১৬-২০২০ পুরোপুরি বাস্তবায়িত হওয়া উচিত বলে অধিকার কর্মীরা মনে করেন। ওই পরিকল্পনায় কুষ্ঠ ও এর জটিলতা দূর করা, বৈষম্য দূর করা ও সামাজিক অন্তর্ভুক্তিকে উৎসাহিত করা, সময়মতো রোগী শনাক্তকরণে গুরুত্ব দেয়া, একীভূত চিকিৎসাব্যবস্থা চালু করা এবং পর্যাপ্ত সম্পদের নিশ্চয়তা দেয়া প্রভৃতি বিষয়ের ওপর জোর দেয়া হয়েছে।
জনগণকে স্বাস্থ্য শিক্ষা দেয়ার মাধ্যমে এমন একটি অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা দরকার সেখানে কুষ্ঠরোগীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিনামূল্যে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে এবং সামাজিকভাবে সব সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা যাতে নিশ্চিত হয় সেজন্য প্রয়োজনীয় বার্তা প্রচার করা উচিত। কোথায় চিকিৎসাসেবা পাওয়া যায় সে বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত বার্তা এই রোগ নির্মূলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কুষ্ঠ বিষয়টা যেন গুরুত্ব পায় সে বিষয়েও গণমাধ্যমের জোরালো ভূমিকা থাকা উচিত।

কুষ্ঠ আমাদের জাতীয় দুর্ভোগের কারণ। এ কারণে বিপুলসংখ্যক মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আসুন আক্রান্ত ব্যক্তিদের সামাজিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাই একত্রে কাজ করি এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে একটি কুষ্ঠমুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলি।
লেখক : ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক
ইমেল : sissabuj@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement