১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলকদ ১৪৪৫
`


বাবরি মসজিদ : সময়ের দাবি

বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সেই দিন - সংগৃহীত

৬ ডিসেম্বর ১৯৯২। মানবতার ইতিহাসের একটি কলঙ্কিত দিন। ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী ও কট্টর সাম্প্রদায়িক ‘সঙ্ঘ পরিবার’ সেদিন ঐতিহাসিক ‘বাবরি মসজিদ’ গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার তৎকালীন সরকার এর প্রতিরোধে ব্যবস্থা না নিয়ে বরং মদদ দিয়েছে গণতন্ত্র, সভ্যতা ও ন্যায়নীতির দুশমনদের।

ভারতের উত্তরপ্রদেশের অযোধ্যার ৫০০ বছরেরও পুরনো ‘বাবরি মসজিদ’ মুসলমানদের সাথে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে বিশ্বহিন্দু পরিষদের উন্মত্ত করসেবকদের হাতে বিনা বাধায় গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। পুরনো এই কাঠামোটি ভাঙতে করসেবকদের সময় লাগল ঠিক পাঁচ ঘণ্টা। আর, কাঠামোর রক্ষণবেক্ষণের দায়িত্ব যাদের হাতে ন্যস্ত ছিল, উত্তরপ্রদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন সেই সিআরপিকে কোনো রকম নির্দেশ দেয়া হলো না।

প্রাদেশিক সশস্ত্র বাহিনী (পিএসসি) বা উত্তরপ্রদেশের পুলিশ ফৈজাবাদের স্পেশাল পুলিশ সুপার (এএসপি) ডিবি রায়ের কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার নির্দেশও উপেক্ষা করল। ভাঙচুরের পর করসেবকরা যাওয়ার সময় প্রত্যেক বিতর্কিত কাঠামোর স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে একটি করে ইট নিয়ে যায়। মসজিদ কাঠামো ভাঙতে গিয়ে আহত হয়েছে শ’ দেড়েক করসেবক। দেয়াল চাপা পড়ে মারা গেছে চারজন।

বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতে। সাম্প্রদায়িকতার লেলিহান শিখায় রাজ্যে রাজ্যে রক্ত ঝরে মুসলমানদের। এক সপ্তাহের মধ্যে নিহতের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। প্রতিক্রিয়া পড়ে সারা বিশ্বেও। সংশয় দেখা দেয় ভারতের সংহতি রক্ষা নিয়েও। আসলে ভারত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে বরাবর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে সরকারগুলো। এটা ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ওই প্রতিবেদনে ১৯৫৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত ৩৯ বছরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সংখ্যা ১৩ হাজার ৫৫৮, নিহতের সংখ্যা ১৪ হাজার ৪২১ এবং আহতের সংখ্যা ১১ হাজার ৫৫৮, নিহতের সংখ্যা ১৪,৪২১ এবং আহতের সংখ্যা এক লাখ ১৫ হাজার ১৩ জন উল্লেখ করা হয়। বিস্তারিত পরিসংখ্যানটি ‘হংকং মুসলিম হ্যারাল্ড’ পত্রিকায় পাওয়া যায়। ওই প্রতিবেদনে ভারতে প্রতিদিন গড়ে একটি করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কথা উল্লেখ করা হয়। পরবর্তীতেও এই পরিস্থিতির খুব বেশি উন্নতি হয়নি।

বাবরি মসজিদের ইতিহাস
প্রথম মুঘল সম্রাট জহির উদ্দিন শাহ্ বাবরের শাসনামলে ১৫২৮ সালে বর্তমান ফৈজাবাদ জেলার অন্তর্গত অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। বাবরের সেনাপতি মীর বাকি বানিয়েছিলেন এই মসজিদ। মসজিদ নির্মাণের সময় অথবা অব্যবহিত পরে এ সম্পর্কে স্থানীয় হিন্দুদের মধ্যে কোনো বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল না। বরং সম্রাট বাবরের শাসনের অসাম্প্রদায়িক নীতি, ধর্ম নির্বিশেষে সব ঐতিহাসিক কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে।

কিন্তু মুঘল সম্রাটদের উদারতা সত্ত্বেও বারবার হামলা চালানো হয়েছে। অযোধ্যাকে রামের জন্মভূমি হিসেবে চিহ্নিত করে মসজিদ ভাঙার চেষ্টা করা হয়েছে। ইতিহাসে পাওয়া যায় হুমায়ুনের আমলে দশ বার ও আকবরের আমলে কুড়ি বার হামলা চালানো হয়েছে। সম্রাট আকবর ছিলেন ধর্মীয় ব্যাপারে অত্যন্ত উদার। তিনি একটি সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছিলেন।

ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার পরপরও কয়েকবার হামলা হয়েছে। হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ হয়েছে। ১৮৮৫ সালে মহন্ত রঘুবর দাস নামে একজন ব্যক্তি ফৈজাবাদ সাবজজ আদালতের কাছে বাবরি মসজিদ প্রাঙ্গণে একটি মন্দির নির্মাণের অনুমতি চাইলেন। তার আবেদনে দাবি করা হয়েছিল, স্থানটি রামচন্দ্রের জন্মভূমি। এ ঘটনায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল। সংঘর্ষও হয়েছিল। সংঘর্ষের শেষে হিন্দুরা বাবরি মসজিদ দখল করে নিয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল ৭৫ জন মুসলমানকে।

এর পরের উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে ১৯৩৪ সালে। আবার সংঘর্ষ ও দাঙ্গা। রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল নিকটবর্তী সরযূ নদীর পানি। এই দাঙ্গার পেছনে ছিল ব্রিটিশ শাসকদের প্ররোচনা। অদ্ভুত প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে মসজিদের দরোজায় ঝুলিয়ে দেয়া হয় তালা। এরপর বাবরি মসজিদে আর জামাত হয়নি। ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে সিভিল জজ মসজিদটিকে পুরাতত্ত্ব বিভাগের অধীনস্থ ঘোষণা করেন। ভারত বিভক্তির পর ১৯৪৯ সালের ২২ ডিসেম্বর কিছু হিন্দু মসজিদে ঢুকে সেখানে রামের মূর্তি স্থাপন করে। ১৯৫০ সালে সরকার বাবরি মসজিদ এবং সংলগ্ন এলাকা ‘দেবত্ব সম্পত্তি’ হিসেবে দখল গ্রহণ করে।

১৯৮৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ফৈজাবাদ জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শ্রীকৃষ্ণ মোহন পান্ডে অ্যাডভোকেট রমেশ চন্দ্র পান্ডের আবেদনে ও মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট করে মুসলমানদের আবেদনে কোনো রকম কর্ণপাত না করে মসজিদটিতে ‘নির্বিঘেœ পূজাপাঠ সম্পন্ন করার জন্য’ হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হয়। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ওঠে। সংঘর্ষ বাঁধে গোটা পশ্চিমবঙ্গে। ভারতের নানা রাজ্যেও।

এভাবে একটি মিথ্যা কল্পকাহিনীর ওপর ভর করে দীর্ঘ এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে চলে আসা দ্বন্দ্বের আসুরিক পরিণতি ঘটে ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভেঙে ফেলার মাধ্যমে। অথচ সত্যান্বেষী অনেক হিন্দুও বাবরি মসজিদের ঐতিহাসিক সত্যতা স্বীকার করেছেন। কিন্তু ভারতের তৎকালীন সরকারপ্রধান নরসিমা রাও (তার ব্যর্থতা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক স্বীকৃত) শুধু রাজনীতির স্বার্থে উগ্রবাদী হিন্দুগোষ্ঠীকে কাছে পাওয়ার অভিপ্রায়ে পবিত্র মসজিদ ভাঙার মতো জঘন্য কাজে ইন্ধন জুগিয়েছেন।

গবেষণায় প্রমাণিত- অযোধ্যায় কোথাও রাম জন্মভূমির হদিস মেলেনি। ভারতের প্রত্মতত্ত্ব বিভাগ ১৯৭৫ সালে ‘রামায়ণ বর্ণিত স্থানগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক নির্ণয়’ নামক এক প্রজেক্টের কাজ শুরু করে। প্রত্মতত্ত্ব বিভাগের সাবেক ডাইরেক্টর বিবি লালের নেতৃত্বে বাল্মীকির রামায়ণে উল্লিখিত পাঁচটি শহরে অনুসন্ধান চালান। বাবরি মসজিদের পেছনেই ১১ মিটার গভীর পরিখা খনন করা হয়। অনুসন্ধানের পরিপ্রেক্ষিতে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয় ভারতের সানডে মেইল (২০ নভেম্বর : ১৯৮৮) এবং ইন্ডিয়া টুডে (১৫ জানু : ১৯৮৯) পত্রিকাগুলোতে। প্রবন্ধ দু’টির প্রতিপাদ্য হলো, উল্লিখিত স্থানটি রামের জন্মস্থান নয়।

রবীন্দ্রনাথ রাম জন্মভূমির ভৌগোলিক অবস্থান নিয়ে আদৌ বিচলিত ছিলেন না। আদি কবি বাল্মীকির উদ্দেশে তার নিবেদন ছিল- ‘তব মনোভূমি/রামের জন্মস্থান অযোধ্যার চেয়ে সত্য জেনো।’

সেদিনের রাম সেবকরা অবশ্য রবীন্দ্রনাথকে যথেষ্ট হিন্দু গণ্য না করারই কথা। কবির মনোভূমি থেকে স্খলিত করে রাম জন্মস্থানকে তারা ফৈজাবাদের বাবরি মসজিদ গম্বুজে স্থাপন করতেই এমন হীন নারকীয় কাণ্ড করল। আজ যদিও দাবি উঠেছে ওই কলঙ্কজনক ঘটনার পেছনে যারা নাটের গুরু ছিলেন, সেই লালকৃষ্ণ আদভানী, অশোক সিংঘল, মহন্ত অবৈদ্যনাথ প্রমুখের বিচারের। অপর দিকে, অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার ২৬ বছর পর ৩০০ বছরের পুরনো ভগ্নপ্রায় ‘আলমগীরি মসজিদ’ যা এতদিন বন্ধ ছিল তা হনুমানগড়ি মন্দির কর্তৃপক্ষ ওই স্থানে মন্দিরের টাকায় নতুন মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। অবশ্য ওই মসজিদের জন্য বরাদ্দকৃত জমি নিকটবর্তী মন্দিরের নামে ‘দেবত্ব সম্পত্তি’ হিসেবে ট্রাস্ট করা ছিল। অর্থাৎ ওই জমির আয় থেকেই মসজিদ নির্মাণ করা হবে।

কিন্তু বাবরি মসজিদের ব্যাপারে কী হলো? উগ্র হিন্দুদের দাবির কাছে নতি স্বীকার করে ওই মসজিদসংলগ্ন স্থানটি দুই ভাগে ভাগ করে দেয়ার রায় প্রদান করেছেন সুপ্রিম কোর্ট। এ রায় মুসলমানেরা আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের দাবি, বাবরি মসজিদের আদি কাঠামোতে মসজিদ পুনর্নির্মাণ করতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে এমন সব নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত দেয়া হয়, যাতে চিরদিনের জন্য ওই মসজিদ এবং সংলগ্ন এলাকার ৬৭ একর জমি থেকে মুসলমানদের বঞ্চিত করা হয়েছে। ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের কাছে মসজিদ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব হস্তান্তর করার পরিণাম মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া? আজ ভারতের ৩০ কোটি মুসলমনের প্রাণের দাবি- ‘বাবরি মসজিদ’ নামে আদি স্থানে সুদৃশ্য মসজিদ নির্মাণসহ ভারতীয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের ধর্মীয় স্বাধীনতা নির্বিঘ্নে করা, ‘গো হত্যা’র অভিযোগে মুসলিম নিধন বন্ধ করা এবং সব সরকারি পর্যায়ে মুসলমানদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা।

আর এটা বর্তমান ভারত সরকার উপলব্ধি করতে পারলে ভারতসহ উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সুবাতাস বইতে থাকবে। এটা এখন সময়ের দাবিও বটে!

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক


আরো সংবাদ



premium cement
প্রতিটি মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল করতে সরকার কাজ করছে : প্রধানমন্ত্রী দুমকীতে হত্যা মামলার আসামি বাবা-ছেলে গ্রেফতার ১২ সপ্তাহের যুদ্ধবিরতি : যেখানে আপত্তি ইসরাইলের পথশিশুদের জন্য ছায়াতলের স্বাস্থ্যসেবা ক্যাম্পেইন অনুষ্ঠিত মিরসরাইয়ে বাসের ধাক্কায় মোটরসাইকেলের আরোহী নিহত মালয়েশিয়ায় বিএমইটি কার্ডের নামে ফাঁদ! সতর্ক করল দূতাবাস ভোলায় বার্জের সাথে মাছ ধরার ট্রলারের ধাক্কা, জেলে নিহত সিদ্ধিরগঞ্জে অবৈধ গ্যাস সংযোগে দালাল চক্র, ৪৮টি বাড়ির সংযোগ বিচ্ছিন্ন সব বিভাগেই বৃষ্টি হতে পারে মানিকগঞ্জে পৌঁছেছে পাইলট আসিম জাওয়াদের লাশ ‘বল এখন সম্পূর্ণভাবে’ ইসরাইলের কোর্টে : যুদ্ধবিরতি আলোচনায় হামাস

সকল