২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

কেমন নির্বাচন চায়

-

কমিশন অর্থ যদি কার্যের ভার দেয়া বা নিয়োগ প্রদান করাকে ধরা হয় তাহলে ‘নির্বাচন কমিশন’ অর্থ নির্বাচন সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব প্রদান ও নিয়োগ দান করাকে বুঝায়। বাংলাদেশের মালিকানা কোনো বৈষম্য ছাড়া দেশের সব নাগরিকের রয়েছে, সেহেতু দেশের নির্বাচন বিষয়ে কর্মপরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব বা নিয়োগ প্রদানও করেছে নাগরিকেরা। যে সনদের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ বা নাগরিকেরা কাউকে কার্যভার প্রদান করে কিংবা কার্য সম্পাদনের জন্য নিয়োগ দান করে, তাকেই বলা হয় সংবিধান। তাই নির্বাচন কমিশনকে ‘সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান’ বলা হচ্ছে।

সংবিধানের নির্বাচন পর্বের অনুচ্ছেদে বর্ণিত দায়িত্ব অনুযায়ী সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করাই সরকার ও নির্বাচন কমিশনের মৌলিক দায়িত্ব। এখানে সরকারের নাম উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে- ১২৬ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কমিশনের দায়িত্ব পালনে সার্বিক সহায়তা করা সরকার বা নির্বাহী বিভাগের কর্তব্য। মূলত নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে যা কিছু করণীয় সব আয়োজন সুসম্পন্ন করার মাধ্যমে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা অক্ষুণœ রাখার উদ্দেশ্যে। দেশের মালিকানা যাদের, সেই নাগরিক বা গণমানুষের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্যই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সুতরাং নির্বাচন কমিশনের সঠিকভাবে দায়িত্ব পালনের ওপর নির্ভর করে গণতান্ত্রিকব্যবস্থা।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী পিপ্পা নরিসElectoral Integrity Project এ আদর্শ নির্বাচনের আলোচনায় চিহ্নিত করে দেখিয়েছেন যে, প্রতারণা ও অনিয়মের নির্বাচন ইলেক্টোরাল ইন্টিগ্রিটির আন্তর্জাতিক মান রক্ষা করতে পারে না, ফলে রাজনৈতিক বৈধতার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটে, সর্বোপরি ভোটদানের মাত্রা হ্রাস পায়। এতে রাজনীতি হয়ে ওঠে সঙ্ঘাতপূর্ণ। যেকোনো দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক না থাকলে সামাজিক, অর্থনৈতিকসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিরাজ করে অস্বাভাবিক পরিস্থিতি। ভেঙে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। জননিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন হয়। বিপন্ন হয় দেশের মানুষের জীবন-জীবিকা। এই পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের রয়েছে। কিন্তু দেশের মানুষ যাতে সেরকম পরিস্থিতির শিকার না হয় সে জন্যই নির্বাচন কমিশনের জন্ম। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘নির্বাচন কমিশন’ স্বাধীন। তাদের দায়বদ্ধতা জনগণের কাছে। এ কারণেই জনগণ যাতে সুন্দর শান্তিপূর্ণ পরিবেশে পছন্দের প্রার্থীকে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে, তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব এই কমিশনের। তার ব্যত্যয় দেখলে জনগণ হতাশ হয় এবং নির্বাচন কমিশনের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে। প্রশ্ন ওঠে এ প্রতিষ্ঠানের নিরপেক্ষতা নিয়ে।

“In India the ruling party very often hates the election commission and the opposition loves the commission. On the other hand, the same ruling party when in opposition loves the election commission and the same opposition when in power starts hating the commission.” বলেছিলেন ভারতের সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ডক্টর এস ওয়াই কোরেশি। ২০১৪ সালের ২৪ মার্চ ঢাকার সিরডাপ মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় নির্ধারিত আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তর পর্বে তিনি উপরিউক্ত মন্তব্য করেন। কতটুকু নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ হলে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতাসীন দল ঘৃণা করে এবং বিরোধী দল ভালোবাসে তা ফুটে উঠেছে ওই মন্তব্যে। অথচ আমাদের নির্বাচন কমিশনের অবস্থা ভিন্ন। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, ২০১৪ সালের ২৩ মার্চ চতুর্থ উপজেলা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপে ৪৩ জেলায় ৯১টি উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে নির্বাচন নিয়ে ২৪ মার্চ বিবিসি বাংলা ওয়েবসাইটে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে, তাতে বলা হয়েছে কেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই ও সহিংসতার কথা। ব্রিটেন এতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

বাংলাদেশে নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিব্সন বলেছিলেন, মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করা হচ্ছে। কিন্তু তখনকার ভারপ্রাপ্ত সিইসি ‘সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে’ বলে দাবি করেন। তার চেয়ে আরো একটু এগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করেছিলেন আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির কো-চেয়ারম্যান এইচটি ইমাম। তার ভাষায়, ওই নির্বাচন আগের চেয়েও শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হয়েছে। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের প্রতিটি গণমাধ্যমে ২৩ মার্চের ওই নির্বাচনে ব্যাপক সহিংসতা ও অনিয়মের খবর তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভিন্ন রকম অনিয়ম ও অসঙ্গতি দেখা গেছে। নতুন মাত্রার অনিয়ম এবং আচরণবিধি লঙ্ঘনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের পরিবর্তে তার জবাব দিয়েছেন গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন-অর রশীদ। তিনি সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান। কিন্তু পর্যবেক্ষকেরা বলেছেন, সাড়ে ৪৬ শতাংশ কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ (ঊডএ) ১৫৯টি অনিয়ম দেখেছে। তাদের মতে, অর্ধেকসংখ্যক ভোটকেন্দ্রে অনিয়মের কারণে ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচনের পরের দিন ২৭ জুন ‘দৈনিক নয়া দিগন্ত’ প্রথম পাতায় বড় অক্ষরে প্রধান শিরোনাম করেছে ‘অনিয়মের লেটেস্ট মডেল গাজীপুর’।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন তার লিখিত ‘গণতন্ত্র ও নির্বাচন’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘নির্বাচনের সময় নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। আমাদের পাশের দেশ ভারতে নির্বাচনের সময় নির্বাচনসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কমিশনকে না জানিয়ে কোনো নিয়োগ, বদলি বা অফিস সার্কুলার জারি বন্ধ থাকে’।

অনুরূপভাবে, আমরা পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনকেও শক্তিশালী দেখতে পাই। সর্বোচ্চ থেকে সর্বনি¤œ পর্যায়ের নির্বাচনসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ম বা আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পেলে শাস্তি দেয়ার ক্ষমতাও ইসিপির হাতে দেয়া হয়েছে। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন (ইসিপি) যে কত শক্তিশালী, তার একটি উদাহরণ এখানে দেয়া যেতে পারে। ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর ২৬১ জন এমপিকে তাদের সম্পদের বিস্তারিত হিসাব দিতে না পারায় কমিশন সাময়িক বরখাস্ত করে দেয় যার মধ্যে সাতজন সিনেটরও ছিল। বাংলাদেশের আপামর জনগণেরও আশা-আকাক্সক্ষা হচ্ছে এ দেশে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকবে, যারা সংসদ সদস্যদের বরখাস্ত করার মতো ক্ষমতা রাখে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, যাদের পয়সায় এ কমিশন চলে তারা যাতে অবাধ, স্বাধীন ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পারে তার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই। তা না হলে নির্বাচন কমিশন হবে জনগণের কাছে আস্থা হারানো একটি গতানুগতিক প্রতিষ্ঠান।
লেখক : রাজনীতিক ও প্রাবন্ধিক


আরো সংবাদ



premium cement