২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

‘সাম্প্রদায়িকতার’ অভিযোগে শাসনের বাসনা

-

গত ২ অক্টোবর নয়া দিগন্তে ‘বাংলাদেশ দখলের হুমকি বিজেপি নেতার’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় একটি সংবাদ। এতে বাংলাদেশে গায়ের জোরে হিন্দুদের ধর্মান্তরিত ও মন্দিরকে মসজিদে পরিণত করা ও ভাঙার অভিযোগ তুলে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এমপি সুব্রামানিয়াম স্বামী ত্রিপুরায় এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছেন বলা হয়েছে। অনেক সময় অনেক দেশেই রাজনীতিতে অনেকে সম্পৃক্ত হয়ে স্বীয় প্রচার লাভার্থে কিছু না কিছু বাগাড়ম্বরপূর্ণ কথা বলে থাকেন। তবে ইতিহাসের আয়নায় যে ভারতীয় রাজনীতিক ভারতকে দেখে থাকেন, তার কথায় দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বসুলভ বিচক্ষণতার একটা ছাপ অবশ্যই থাকে।

সিন্ধু সভ্যতা উপমহাদেশের যে পর্যায়ের সাম্য প্রাচীন বিশ্বে রেখেছে, তার তুল্য মর্যাদা পরবর্তীকালের ভারতবর্ষ অর্জন করতে পারেনি। কারণ, এটা তখন ক্রমে ক্রমে চরম বর্ণবাদী ধর্মীয় সমাজকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার শিকার হতে থাকে। এরই প্রধান বর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদী বিদ্বেষ, বিভাজন আর অন্ধ বিশ্বাসভিত্তিক বৈরিতা ও শোষণের ফলে অবশেষে জন্ম নেয় প্রতিবাদী ও প্রতিদ্বন্দ্বী জৈন ও বৌদ্ধ ধর্ম। সহিংস বিরোধ চলে শতাব্দীর পর শতাব্দী। জৈন ধর্মের অনুসারীদের মতে, তাদের প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভ দেবের পুত্র ভরতের নামানুসারে ভারতবর্ষের নাম হয়েছে। এর বিরোধী ব্রাহ্মণ্য তথ্যে, চন্দ্র বংশীয় (ব্রাহ্মণ) রাজা দুষ্মন্তের পুত্র ভরতের নামানুসারে এটা হওয়ার দাবি করা হয়েছে। অন্য দিকে, গৌতম বুদ্ধ বেদকেই অস্বীকার করেছেন। ভারতের তখনকার রাজধানীসহ প্রধান প্রধান ৩০টি রাজ্যের (মহাজনপদ) উল্লেখ পাওয়া যায় বৌদ্ধধর্মীয় সাহিত্যে। ভারত থেকে ৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে ফিরে গিয়ে চীনা পর্যটক হিউয়েন সাংয়ের লেখা ‘সিইউকি’ নামের বইয়ে ভারতে ১৩৯টি রাজ্যের মধ্যে বাংলার পাঁচটিসহ মোট ১১০টিতে তার ভ্রমণের উল্লেখ করেছেন।

ধর্ম-বর্ণ ও ভূখণ্ডগত এহেন সংখ্যায় বিভাজ্য ও অনৈক্যের, অনার্য ও আর্য ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশ আনুমানিক ৫২০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে দখল করেন পারস্য সম্রাট প্রথম দারিউস। পাঞ্জাব পর্যন্ত এসে ৩২৫ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে আলেক্সান্ডার ফিরে গেলেও তার প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন ব্যাকট্রিয়ার (দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার হিন্দুকুশ পর্বত ও আমু নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল) রাজা দ্বিতীয় ডেমিট্রিয়াস (১৮০-১৬৫ খ্রিষ্টপূর্ব) ভারতের একই অঞ্চলে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। ৭৮ খ্রিষ্টাব্দে করেন কুষাণরা এবং প্রায় ৪৭০-এ করেন হুনরা। ৭১২-তে সিন্ধু দখল করেন আরবরা। ৯৯৭ থেকে ১০৩০-এর মধ্যে ১৭ বার ভারতে অভিযান ও লুটপাট চালায় গজনির সুলতান মাহমুদ। ১১৯২-তে দিল্লিতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন আফগানিস্তানের মোহাম্মদ ঘোরি। ১৩৯৮-এ অভিযান চালায় চেঙ্গিস খানের বংশধর তৈমুর লং। ১৫২৬-এ প্রতিষ্ঠিত হয় একই রক্তের মোগল শাসন। ১৭৩৯-এ দিল্লিতে লুণ্ঠন ও ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় ‘পারস্য সম্রাট’ নাদির শাহ। ১৭৪৮ থেকে ১৭৫৯ পর্যন্ত ভারতে মুসলিম শাসন রক্ষার্থে পাঁচবার আক্রমণ করে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশ স্বল্পকালীন দখলে রাখেন আফগান বাদশাহ আহমদ শাহ আবদালি। ১৭৫৭-এ বাংলা দখলের মাধ্যমে সূচিত হয় ১৯০ বছরের ইংরেজ দখলদারি শাসন ও শোষণ।

প্রায় দুইশত খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ভারতে দু-পায়ের মধ্যে লম্বা ভাঁজ দিয়ে কোমরে কাছার ন্যায় ধুতি পরা পুরুষের প্রায় অনুরূপভাবে, মহিলাদের পরা শাড়ির উপরে কোমরবন্ধ দেয়া ছাড়াও উভয়ের শরীরের উপরি ভাগ অনাবৃত রাখার প্রথার তেমন কোনো পরিবর্তন ১২০০ খ্রিষ্টাব্দের আগ পর্যন্ত হয়নি। তখন মধ্য ও উত্তর ভারতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই যতটা সম্ভব তাদের মতো শরীর আবৃত রাখার অনুকরণে ওই অঞ্চলে নারী ও পুরুষের পরনে আমূল পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। সম্রাট আকবরের রাজপুত স্ত্রীদের বিলাসী পোশাক ভারতে উচ্চশ্রেণীর মহিলাদের অনুকরণীয় হয়। (তথ্য- Encyclopedia Britannica, V-5, P-1038-39)

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটেনিকা থেকে বলছি, মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ডা: প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, পণ্ডিত ভূদেব মুখোপাধ্যায় ছাড়াও স্বামী বিবেকানন্দের মতে, ‘মোছলেম কর্তৃক ভারত বিজয় দরিদ্র, পদদলিত জনগণের জন্য মুক্তিরূপে সমাগত হইয়াছিল। ইহাই আমাদের এক-পঞ্চমাংশ লোকের ইছলাম মণ্ডলীভুক্ত হওয়ার একমাত্র কারণ। তরবারি এই দীক্ষা ক্ষেত্রে কিছু করে নাই। তরবারি ও উৎপীড়নের মাধ্যমে এই দুরূহ কার্য্য সুসম্পন্ন হইয়াছে- ইহা বলা ঘোর বাতুলতা।’ আঙ্গারিকা ধর্মপাল নামে জনৈক বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারক বলেছেন, ‘সহস্র বৎসর কাল ভারতবাসী সত্য ধর্ম বিস্মৃত ছিল এবং তাহাদের ধর্ম-পথ অবহেলা করার দণ্ডস্বরূপ মোছলেম কর্তৃক ভারতবর্ষ বিজিত হইয়াছিল।’
(১৯৩৩ সালে কলকাতায় প্রকাশিত এবং বইয়ের ৩১৯-৩২২ পৃষ্ঠা থেকে উদ্ধৃত)।

১৮৩৭ সালে দ্বারকানাথ ঠাকুর সর্বপ্রথম বাংলায় রাজনৈতিক সংগঠন ‘জমিদার সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের, ১৮৫১ সালে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ-ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশনের সাথে একীভূত হয়। এর ৩৪ বছর পরে ১৮৮৫ সালে বম্বেতে ইউরোপিয়ান ও ভারতীয় পার্শির উদ্যোগে কিছু জৈন ও ব্রাহ্মণের উপস্থিতিতে এবং কলকাতার বাঙালি ব্যারিস্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে কলকাতায় কংগ্রেসের বাংলা ভাগ বিরোধী সম্মেলন শেষ হওয়ার পরের দিনই ভাগের সমর্থনে কংগ্রেসের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় মুসলিম লীগ। তবে এর ৫১ বছর আগে আঞ্জুমান-ই-ইসলাম নামে মুসলমানের সর্বপ্রথম রাজনৈতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ভারতে। সুতরাং মহাত্মা গান্ধীর কথিত রাজনৈতিক গুরু গোপাল কৃষ্ণ গোখলের, 'What Bengal thinks today, the rest of India will think Tomorrow,' বিখ্যাত ওই উক্তি সেকালে ছিল না নিরর্থক, থাকবে না একালেও। প্রায় তিন হাজার বছরের ব্রাহ্মণ্যবাদী সার্থক-অসার্থক ফলাফলের সাক্ষ দিচ্ছে ভারতীয় ইতিহাস। তাই সহমর্মিতা ও সহযোগিতার সাথে সহাবস্থানে প্রতিবেশীদের মূল্যায়নই শ্রেয়। আমরা জানি,"When your own existence is threatened, you can approach the devil for help," এই আরব প্রবাদটি।


আরো সংবাদ



premium cement
লালমনিরহাটে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশী যুবক নিহত এখনো শেষ হয়নি বিতর্কিত আউটের রেশ, ব্যতিক্রমী প্রতিবাদ মুশফিকের ‘ফ্রি ভিসার গল্প’ আর শূন্য হাতে ফেরা লাখো শ্রমিক নোয়াখালীতে প্রবাসীর স্ত্রীর ব্যক্তিগত ছবি দেখিয়ে চাঁদা আদায় দেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে, অথচ বিরোধী দল দেখে না : কাদের আশুলিয়ায় বাঁশবাগান থেকে নারী পোশাক শ্রমিকের রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার মিয়ানমারের কর্মকর্তারা ফেরত গেলেন, কিন্তু রোহিঙ্গা সঙ্কট কি আরো জটিল হচ্ছে দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষ, চালক-হেলপার নিহত মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ২ সখীপুরে বৃষ্টির জন্য অঝোরে কাঁদলেন মুসল্লিরা দক্ষিণ ভারতে কেন কাজ করেনি বিজেপির হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি

সকল