২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও প্রসঙ্গ কথা

বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও প্রসঙ্গ কথা -

ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিক পত্রিকায় ১ অক্টোবর প্রকাশিত একটি খবরের হেডলাইন ছিল ‘কুমিল্লার মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন : শুনানি ৩ অক্টোবর’। খবরে বর্ণিত হয়েছে, ‘মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ভোরে ২০ দলীয় জোটের অবরোধের সময় চৌদ্দগ্রামের জগমোহনপুরে একটি বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মারে দুর্বৃত্তরা। এতে আট যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান, আহত হন ২০ জন। এ ঘটনায় চৌদ্দগ্রাম থানার এসআই নুরুজ্জামান বাদি হয়ে ৭৭ জনের নামে মামলা করেন। মামলায় খালেদা জিয়াসহ বিএনপির শীর্ষস্থানীয় ছয় নেতাকে হুকুমের আসামি করা হয়।’

আমার প্রশ্ন হচ্ছে, যে বিচারক এই মামলাটি বিচারের জন্য গ্রহণ করলেন, তিনি কি মামলা দায়েরকারীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘যে খালেদা জিয়া গয়রহ্ হুকুম দিয়ে এই খুন-খারাবিটা করালেন, তারা কি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন? না থাকলে তাদের হুকুম দেয়ার কোনো প্রমাণ কি মামলা দায়েরকারীর হাতে আছে?’ আমাদের দেশের আইনের অবস্থাটা কি এতটাই বেহাল যে, কাউকে হয়রানি করতে হলে এভাবে মনগড়া অভিযোগ দিয়ে মামলা করা যায়? আইনজ্ঞ না হয়েও আইনি ব্যাপারে প্রশ্ন করে বেআইনি কাণ্ড করে ফেলছি কি না বুঝতে পারছি না।

যারা জনস্বার্থে উচ্চ আদালতে মামলা করে সুনাম অর্জন করেছেন (অ্যাডভোকেট মনজিল মোর্শেদ, ইউনুস আলী আকন্দ গয়রহ্), তাদের কেউ একজন কি এগিয়ে এসে যারা অপরাধে জড়িত হওয়ার কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণাদি না থাকা সত্ত্বেও আইনের ফাঁকফোকরের কারণে অনর্থক হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তাদের স্বার্থে প্রচলিত আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধনের পক্ষে একটা রায় আদায় করবেন উচ্চ আদালত থেকে ?

মামলায় বর্ণিত ঘটনাটি যখন ঘটেছে, তার আগে-পিছে এ ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরো ঘটেছে কিছু লোকের অপরাজনীতির কারণে। বেগম জিয়ার উচিত ছিল একটি বিবৃতি দিয়ে এ মর্মে হুঁশিয়ার করে দেয়া যে, কোনো ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড তার দল সমর্থন করে না। মনে আছে, অবিভক্ত ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলন কালে ব্রিটিশবিরোধী কিছু আন্দোলনকারী যখন থানা ইত্যাদিতে আক্রমণ করতে শুরু করেছিল, তখন মহাত্মা গান্ধী সন্ত্রাস বন্ধ করতে অসহযোগ আন্দোলনই থামিয়ে দিয়েছিলেন।

এ ধরনের ঘটনা আমাদের দেশে অতীতে আরো ঘটেছে। মনে আছে, বায়তুল মোকাররমের উত্তর-পশ্চিম কোণে বেশ কয়েক বছর আগে রাজনৈতিক কারণে সদর রাস্তায় পিটিয়ে লোক হত্যার দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছিলাম। তখনো কিন্তু যে দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল সেই দলের কোনো নেতা এমন জঘন্য বর্বরতা প্রতিবাদ করেননি, সে ঘটনায় কোনো মামলা হয়েছিল কি না তা জানি না। আমাদের রাজনীতিতে আরো সভ্যতার প্রলেপ দেয়া দরকার। যে পশ্চিমাদের কাছ থেকে আমরা ভোটাভুটি শিখেছি, তারা কিন্তু এমন কাণ্ড করে না।

কিছু দিন যাবৎ শুধু বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে মামলা দায়ের করা হচ্ছে, তা নয়। ক’দিন আগে পত্রিকায় পড়েছিলাম, অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘আমার দেশ’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে কোনো এক মফস্বল শহরে মামলা হয়েছে একটা রাজনৈতিক ধরনের কারণে। হয়রানির উদ্দেশ্যে? ৩ অক্টোবর একটি ইংরেজি দৈনিকে পড়লাম বর্তমানে আমেরিকায় বসবাসরত প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিরুদ্ধে পাবনা সদর থানায় একজন আওয়ামী লীগার ডায়েরি করেছেন প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে বলার অভিযোগ। আমাদের শিক্ষিত সমাজেও হিংসাবিদ্বেষজনিত মামলা-মোকদ্দমা আমাদের অসহিষ্ণু মন-মানসিকতার প্রমাণ করে।

এসব হয়রানিমূলক মামলার কথা লিখতে গিয়ে মনে হলো, নিজের ব্যক্তিগত অসুবিধার কথাটাও এখানে লিখতে পারি। কয়েক বছর আগে, ২০১০ সালে একটি বই লিখেছিলাম, ‘যতীন সরকারের পাকিস্তান দর্শন’ নামে। আমার লেখাটা ছিল একটা প্রতিবাদী বক্তব্য। যতীন সরকার নামের অধ্যাপক ও লেখক ‘পাকিস্তানের জন্মমৃত্যু-দর্শন’ নামে একটা বই লিখেছিলেন, যা ২০০৫ সালে প্রকাশিত হলেও আমার হস্তগত হয় বছর কয়েক পরে। বইটি পড়ে এমন কিছু বক্তব্য পাই এবং আপত্তি উত্থাপন করাটা আমার কর্তব্য বিবেচনা করি। যা নিয়ে অধ্যাপক যতীন সরকার একজন অনুসন্ধানী লেখক আর তার গ্রন্থে অনেক জ্ঞানগর্ভ কথাও আছে। তবুও তিনি আমার মতো অনেক দেশবাসীর মনে আঘাত লাগার মতো কিছু কথাও লিখেছেন। দু-একটা উদাহরণ দিচ্ছি। বাংলা ভাষায় হজরত মোহাম্মদ সা:-এর প্রথম জীবনচরিত রচনাকারী শ্রদ্ধেয় মওলানা আকরম খাঁ সম্বন্ধে তিনি কোনো এক অখ্যাত লেখকের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, ‘‘না শুধু ‘কলিজেশ্বর’ লিখলে হবে না। লিখতে হবেÑ আয় মেরে গুলে চামান, নূরে জামান, আজাদ কা প্রোপ্রাইটার, বাংলামে উর্দু মিশায়ে জগাখিচুড়ি বানানে কা এক নম্বর ওস্তাদ আক্রমন খাঁ কলিজেশ্বর”।

অথচ এই আকরম খাঁ সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘আমরা মৌলানা আকরম খাঁ সাহেবকে সকলেই শ্রদ্ধা ও ভক্তি করতাম। তার বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই বলার ছিল না।’ আরেকজন বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিশ্বনবী’ রচয়িতা খ্যাতনামা কবি গোলাম মোস্তফা সম্বন্ধে একই সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে যতীন বাবু লিখেছেন, ‘আমাদের ইচ্ছা হয় গোলমাল কবিকে এই খুঁটির সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে মাথাটা ক্ষুর দিয়ে ভালো করে কামিয়ে তার ওপর গোল মতো একটি সুপুরি রেখে কাঠের খড়ম দিয়ে আস্তে আস্তে ভাঙতে।’ কে কোথায় কোন মন্দ লেখা লিখেছে, বিশেষ করে উল্লিখিত শ্রদ্ধেয় (মুসলমানদের কাছে) ব্যক্তিদ্বয় সম্বন্ধে, তা এই পণ্ডিত ব্যক্তি তার গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত করাটা কি কারণে জরুরি মনে করলেন? এমন কি মওলানা ভাসানীর মতো ব্যক্তিত্বও তার খোঁচা থেকে রক্ষা পাননি।

আরো অনেক আপত্তিকর লেখার প্রতিবাদ করতে গিয়ে আমি একটা বই রচনা করেছিলাম। কিন্তু প্রকাশ করতে পারিনি। প্রকাশিত হলে ‘প্রথম আলো’ সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে আবেদন করতাম এমন একটা আপত্তিজনক লেখাভর্তি বইটিকে কি করে তারা ‘বর্ষ সেরা বই, ১৪১১’ অভিহিত করলেন, তা ভেবে দেখতে। কিন্তু আমার বইটা প্রকাশিত হয়নি, কারণ প্রকাশক পাইনি। আর নিজে প্রকাশক হয়ে ছাপাতেও সাহস করিনি, কারণ মামলাবাজদের এ দেশে হয়রানির উদ্দেশ্যে কে কোন মফস্বল শহরে মামলা দায়ের করে আমার মতো একজন আশীতিপর বৃদ্ধকে নাজেহাল করবে, এই ভয়ে।

আমি আগের দিনের লোক। সেই ব্রিটিশ আমলে ভোট দেয়ার বয়স হয়েছিল বলে ১৯৪৭ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিত গণভোটে ভোট দিয়েছি। শুধু যে ভোট দিয়েছি তা নয়, তখনকার পাকিস্তান আন্দোলনেও জড়িত ছিলাম ১৯৪৬ সালের গোড়া থেকে। আমাদের কালে রাজনীতিতে হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানি তো ছিলই না, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অশ্রাব্য ভাষায় গালি গালাজের মন্দ রেওয়াজও ছিল না। এখন ‘২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা’ মনে করিয়ে দেয় আমরা রাজনৈতিক হানাহানি ও ষড়যন্ত্রে কতটা নিচে নেমেছি।

বহুল আলোচিত এই মামলার রায় বেরিয়েছে, কেউ খুশি আর কেউ অখুশি। মারাত্মক এ ঘটনা নিশ্চয়ই মানুষের কাণ্ড। আকাশ থেকে বর্ষিত হয়নি সেই প্রাণহানিকর বিস্ফোরকগুলো, আর না বিদেশ থেকে। তাহলে? যাদের সাজা হয়েছে তাদের কে কতটা জড়িত, তা নিয়ে প্রশ্ন হতে পারে, তবে কেউ না কেউ যে কাণ্ডটা ঘটিয়েছে, তা প্রশ্নাতীত।

আর আওয়ামী লীগনেত্রী যখন শহীদ জিয়ার (এবং বেগম জিয়ার) প্রতি তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের বাণী বর্ষণ করেন, তখন মনে পড়ে অতীতকালের সুন্দর দিনগুলোর কথা। ১৯৪৬ সালের ২ মার্চ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের সভাপতি কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে দিল্লি থেকে কলকাতা হয়ে যখন সিলেটে আসেন, তখন সিলেট পৌরসভার দেয়া নাগরিক সংবর্ধনায় তাকে মাল্যভূষিত ও উপহার প্রদান করেন পৌরসভার চেয়ারম্যান বাবু বনোয়ারী লাল দাস, যিনি ছিলেন কংগ্রেসসমর্থক, পাকিস্তান আন্দোলনের বিপক্ষে। জিন্নাহ সাহেবের প্রতি শ্রী বনোয়ারী লাল দাসের রাজনৈতিক সৌহার্দ্যসুলভ আচরণ অনস্বীকার্য সত্য ঘটনা। অতীতে বৈরীজনের প্রতি সুধীসমাজে কেমন আচরণ করা হতো, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো পাঞ্জাবের রাজা পুরুর সাথে মহাবীর আলেকজান্ডারের আচরণ। ভারতে অভিযানকালে একটি যুদ্ধে বিজয়ী আলেকজান্ডারের সামনে যখন বিজিত রাজা পুরুকে উপস্থিত করা হলো, তখন আলেকজান্ডার পুরুকে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার কাছে কী ব্যবহার আপনি আশা করেন?’

রাজা পুরু উত্তরে বলেছিলেন, ‘একজন রাজার সঙ্গে রাজার মতো ব্যবহার।’ আলেকজান্ডারের কাছ থেকে তিনি তা পেয়েছিলেন। সেই ব্রিটিশ আমলে আমরা পাঠ্য-পুস্তকে তা পড়েছি। একালে এই ভোটযুদ্ধের যুগে যখন কে বিজয়ী আর কে বিজিত, তা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নিশ্চিত হয়, তখন একের প্রতি অন্যের সৌহার্দ্য প্রদর্শনই নেতাদের থেকে কাম্য।

‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ চিন্তাধারার প্রবর্তক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যারা কটূক্তি করেন, তাদের স্মরণ রাখা উচিত এ দেশের জনগণের মধ্যে তার প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা কমেনি। হয়তো অনর্থক খোঁচাখুঁচি ও গালাগালিতে তার প্রতি মানুষের টান আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে, আরো বিস্তার লাভ করছে। তার মৃত্যুর পর মানুষের যে ঢল নেমেছিল রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউতে অনুষ্ঠিত জানাজায়, তা কি ভোলা যায়? কারো আহ্বানে নয়, শুধু মনের টানেই জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল সেই ঐতিহাসিক জমায়েত।

মনে আছে প্রয়াত শ্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি ভারতের প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে যখন বাসে চড়ে ভারতের অমৃতসর থেকে পাকিস্তানের লাহোর গিয়ে নাগরিক সংবর্ধনায় ভাষণ দিলেন, আমি বিদেশী টেলিভিশনের পর্দায় তা মুগ্ধচিত্তে দেখলাম ও শুনলাম। আমাদের দেশের টেলিভিশনে যদি তা প্রচারিত হতো আর আমাদের নেতা নেত্রীরা তা শুনতেন, তাহলে আমাদের রাজনীতির মান হয়তো উন্নীত হতো। হিন্দুত্ববাদী বিজেপির লোক হওয়া সত্ত্বেও বাজপেয়ি ছিলেন সঙ্কীর্ণতার ঊর্ধ্বে, একজন যথার্থ রাষ্ট্রনায়ক। প্রকৃত জননেতাদের মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে, আর নির্মম পরিণতি হয় রেজা শাহ পাহলবি, সাদ্দাম হোসেনের মতো শাসকদের।

শেষ আর সর্বনাশা খবরটা হলো, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারে অধিষ্ঠিত প্রকটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টির একজন বড় নেতা ও সংসদ সদস্য সুব্রামনিয়াম স্বামী বাংলাদেশ দখল করার হুমকি দিয়েছেন। তা কিন্তু একটা অতি ভয়ঙ্কর উক্তি। ভারতের হয়তো শক্তিও আছে তা কার্যকর করার। যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয়, তখনো ভারত ছিল আমাদের প্রতিবেশী ভারত। পাকিস্তানের শত্রু ছিল বিধায় আমাদের সাহায্যে তখন এগিয়ে এসেছিল। দূরে অবস্থিত পাকিস্তানকে ত্যাগ করতে আমাদের অসুবিধা হয়নি। এখন তিন দিকে শক্তিমান ভারত আর একটু ফাঁকে ভয়ঙ্কর মিয়ানমার। তা হলে কি মনে করা হচ্ছে, স্বামীজীরা আক্রমণ করলে আমাদের বাঁচাও বাঁচাও চিৎকারে সাড়া দেয়ার এখন কোনো প্রতিবেশী নেই?
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গ্রন্থকার


আরো সংবাদ



premium cement