২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ইমরান খান ও সেনাবাহিনী আজ মিত্র, কাল শত্রু

ইমরান খান ও সেনাবাহিনী আজ মিত্র, কাল শত্রু - সংগৃহীত

পাকিস্তানের গত ২৫ জুলাই অনুষ্ঠিত নির্বাচনে জয়লাভ করেছে বলে দাবি করার দুই সপ্তাহ পর ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টি (পিটিআই) গত সোমবার একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার ঘোষণা দিয়েছে। যা-ই হোক না কেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক উঠেছে, তা এখনো শেষ হয়ে যায়নি। আর পিটিআইয়ের নেতৃত্বাধীন যেকোনো কোয়ালিশন সরকারের ভবিষ্যৎ এখনো প্রশ্নবিদ্ধ।

গুলবুখারি

নির্বাচনের আগে পাকিস্তানের ক্ষমতাধর নিরাপত্তা বাহিনীকে তাদের পছন্দসই বা অনুগ্রহভাজন প্রার্থী ইমরান খানের জয়লাভের পথ সুগম করার জন্য রাজনীতিতে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপের জন্য দায়ী করা হয় এবং নির্বাচনের আগে যেসব ঘটনা ঘটে- দুর্নীতির অভিযোগে পিএমএল-এন’র কয়েকজন বিখ্যাত সদস্যকে গ্রেফতার, নির্বাচনের তিন সপ্তাহেরও কম সময়ের আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফকে দণ্ডিত করা, পিএমএল-এন’র অপর নেতা হানিফ আব্বাসিকে নির্বাচনের মাত্র চার দিন আগে মাদক চোরাচালানির অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদানকে অনেকেই সেনাবাহিনী ইমরান খানের বিরোধীদের যে টার্গেট করেছে তারই নিশ্চিত প্রমাণ হিসেবে দেখাচ্ছেন।

নির্বাচনের দিন এসব অভিযোগের আরো বিস্তৃতি ঘটে। ‘নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার সম্ভাব্য উদ্যোগ নেয়া হয়।’ এসব উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে : ভোট কারচুপির সরাসরি অভিযোগ, কমপক্ষে ছয়টি রাজনৈতিক দল সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তা এবং অন্যান্য নির্বাচনী কর্মকর্তরা ভোট গণনাপ্রক্রিয়ার সময় তাদের প্রতিনিধিদের ভোট গণনা প্রত্যক্ষ করতে দেননি বলে অভিযোগ করেন। অথচ আইনানুযায়ী এসব প্রতিনিধি ভোট গণনা প্রত্যক্ষ করার ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত। তারা চূড়ান্ত গণনা যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হয়নি বলেও অভিযোগ করেন। এ ছাড়া ফলাফল ট্রান্সফার সিস্টেম (আরটিএম) নিজেও প্রশ্ন উঠেছে। নির্বাচনের দিনে-রাতে আরটিএস অচল হয়ে পড়ে বলে অভিযোগ করা হয় এবং সরকারিভাবে ফলাফল ঘোষণা বিলম্বিত করা হয়। পরে জানা যায় যে, আরটিএম অচল বা ব্যাহত হয়নি বরং নির্বাচন কমিশন সন্দেহজনকভাবে তাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ আরটিএম ব্যবহার বন্ধ রাখতে বলে।

পাকিস্তানের কয়েকটি নির্বাচনী এলাকায় এখনো পুনরায় ভোট গণনা চলছে। এ প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রাপ্ত ফলাফলে ইতোমধ্যে পিএমএল-এন এবং অন্যান্য বিরোধী দল কয়েকটি আসন পুনরায় অর্জন করেছে এবং তারা তাদের যেসব ভোট চুরি হয়েছে বলে মনে করে সেগুলো পুনরায় ফিরে না পাওয়া পর্যন্ত তাদের সংগ্রাম অব্যাহত রাখবে বলে অঙ্গীকার করেছে।

বিরোধীদলীয় একটি জোট
অধিকন্তু গত ২ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধান প্রধান বিরোধী দলগুলো একটি ‘গ্র্যান্ড অ্যালায়েন্স বা মহাজোট’ গঠনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। এ মহাজোট গঠন করে তারা ‘কারচুপির’ নির্বাচনের বিরুদ্ধে পার্লামেন্টের ভেতরে বাইরে প্রতিবাদ অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়।
এ জোটে রয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টোর পিপিপি, কারারুদ্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পিএমএল-এন, ধর্মীয় দলগুলোর জোট হিসেবে পরিচিত এমএমএ, আওয়ামি ন্যাশনাল পার্টি, পাখতুন খাওয়া মিল্লি, আওয়ামি পার্টি, ন্যাশনাল পার্টি বেলুচিস্তান এবং কওমি ওয়াতান পার্টি। মহাজোট নিজেরা কোয়ালিশন গঠনের প্রচেষ্টা চালাবে বলেও ঘোষণা দিয়েছে।

কিন্তু বিরোধী দলগুলোর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ইমরান খানের পিটিআই দল পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের ঘোষণা দিয়ে ভবিষ্যতে কোয়ালিশন সরকার গঠন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। তারা যেভাবে পার্লামেন্টে সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে- তা নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন আছে। দাবি করা হয় যে, সেনাসদস্যরা পিটিআইর প্রতি সমর্থন দেয়ার জন্য কয়েকজন স্বতন্ত্র সদস্যের ওপর চাপ সৃষ্টি অথবা সত্যিকারভাবে অর্থগ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছে। ইমরান খানের নির্বাচনে জয়লাভের ব্যাপারে প্রশ্ন ওঠা সত্তে¡ও তিনি দেশের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের ব্যাপারে সম্পূর্ণ প্রস্তুত। অবশ্য ভবিষ্যতে তার চলার পথ অনিশ্চয়তায় ভরা।

ভঙ্গুর কোয়ালিশন
প্রথমে ইমরান খানের পিটিআই একটি কোয়ালিশন সরকার গঠনের জন্য আগের শত্রুদের কয়েকজনের সমর্থনের ওপর নির্ভর করে। উদহারণ স্বরূপ করাচিভিত্তিক এমকিউএম ক্ষমতাসীন কোয়ালিশনে থাকবে বলে জানায়। কিন্তু ইতোমধ্যে দুই দলের সম্পর্কে চিড় ধরতে শুরু করেছে। করাচির পিটিআই প্রধান শামীম নবভি বলেন, ‘এমকিউএম’র সাথে জোট আমাদের পছন্দ নয়। কিন্তু আমরা জোট গঠন করেছি সরকার গঠন করার লক্ষ্য জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমরা আমাদের আগের অবস্থান থেকে সরে আসেনি। এমকিউএম করাচিকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। করাচিতে তাদের মেয়রের অদক্ষতার কারণে সাধারণ নির্বাচনে তারা পরাজিত হয়েছে।’

ইমরান খান নবভির বিবৃতির নিন্দা জানিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করেছিলেন। পিটিআই কর্মীদের হুমিক প্রদান এবং এমনকি পাঁচ বছর আগে তাদের হত্যা করার জন্য তিনি ব্যক্তিগতভাবে এমকিউএমকে দায়ী করে ছিলেন। এখনো তিনি অনেককেই বুঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

অপর দল পিএমএল-কিউ এর সাথে খান এবং তার দলের ইতিহাস ভালো নয়। ওই দলটিও পিটিআইর নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশনের অংশ। ইমরান খান পিএমএল-কিউ সদস্যদের ‘খুনি’ এবং ‘পাঞ্জাবের সবচেয়ে বড় ডাকাত’ বলে অভিহিত করেছিলেন। ইমরান খান তার রাজনৈতিক প্রতিদ্ব›দ্বী বা প্রতিপক্ষকে বিদ্বেষপূর্ণভাবে সমালোচনা করার মাধ্যমে একটি নেতিবাচক রাজনৈতিক ক্যরিয়ার গড়েছেন। অধিকন্তু গত পাঁচ বছর ধরে যে-কেউ তার রাজনীতির সমালোচনা করলে তিনি তার সমর্থকদের তার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি এখন পাকিস্তানের দায়িত্ব নিতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছেন অতীতে যাদের গালাগাল ও অপমান করেছিলেন তাদের সমর্থন তার প্রয়োজন। প্রভাবশালী এবং সিজন কোয়ালিশন বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় খানের দুর্বল কোয়ালিশন কত দিন টিকে থাকতে পারে তাই এখন দেখার বিষয়।

ইমরান খান এবং সামরিক বাহিনীর জন্য কী অপেক্ষা করছে?
নির্বাচনে ইমরান খানের জয়লাভের বিষয় নিশ্চিত করার জন্য সেনাবাহিনী যে সহায়তা করেছে, তা ব্যাপকভাবে দেখা গেছে। সম্ভবত আগামীতে খানের প্রধানমন্ত্রিত্বের জন্য সেনাবাহিনী বৃহত্তম হুমকি হিসেবে দেখা দেবে।

অনেকে আশা করেন, ইমরান খান আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করার পর তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করা শুরু করবেন এবং নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখবেন। সামরিক বাহিনীর প্রভাবের বাইরে গিয়ে তিনি স্বাধীনভাবে কাজ করবেন বলেই অনেকে আশা করেন। অবশ্য এ ধরনের উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা চালালে নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তার সঙ্কট সৃষ্টি হবে এবং নিশ্চিতভাবে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দ্রুত তার মেয়াদের অবসান ঘটবে। ইমরান খান সামরিক বাহিনীর পরামর্শের ভিত্তিতে না চললে তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ছুড়ে ফেলে দিতে সেনাবাহিনীর কোনো সমস্যা হবে না। এমকিউএম অথবা পিএমএলকিউএর সহজ সম্মতিতেই সামরিক বাহিনী কোয়ালিশন সরকারের পতনের জন্য সহজেই উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারবে। অথবা তাকে অসততা, দুর্নীতি অথবা অন্য কোনো পটভূমি সৃষ্টি করে দোষী সাব্যস্ত করে দায়িত্ব পালনে অযোগ্য ঘোষণা করা হতে পারে।

ইমরান খান সামরিক জান্তা বা সেনাবাহিনীকে বিপর্যস্ত করার মতো বড় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারবেন না। এমনকি সেনাবাহিনীর নির্দেশনা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেও সামরিক বাহিনী যেকোনো মুহূর্তে ইমরান খানের সরকারকে ক্ষমতাচুত্য করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পাকিস্তানের ১৭ জন প্রধানমন্ত্রীর একজনও পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারেননি। এমনকি অতীতে জাফরুল্লাহ খান জামালি এবং মোহাম্মদ খান জুনেজার মতো অত্যন্ত নমনীয় এবং বাধ্যগত বা অনুগত প্রধানমন্ত্রীদেরও ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য যেকোনো একটি কারণ সেনাবাহিনী খুঁজে বের করেছিল। সুতরাং ইমরান খানের সাথে সেনাবাহিনীর হানিমুন বেশি দীর্ঘায়িত নাও হতে পারে।

ইমরান খান গত পাঁচ বছরে সামরিক বাহিনীর পক্ষে আগ্রাসী প্রচারণা চালিয়ে একটি স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেন এবং ধর্মীয় চরম ডান বা উগ্রপন্থীদের নিয়ে হীনপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য তৎপরতা চালিয়েছেন।

ভারতের সাথে সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানোর জন্য তিনি সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের তীব্র সমালোচনা করেন এবং ২০০৮ সালের বোম্বাই হামলার পরিকল্পনাকারী বলে অভিযুক্ত হাফিজ সাঈদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলেন। তিনি ডন লিকস স্ক্যান্ডালে পুরোপুরিভাবে সামরিক বাহিনীকে সমর্থন দেন। ওই কেলেঙ্কারির মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় যে, সাবেক প্রধনামন্ত্রী নওয়াজ শরিফ চরমপন্থী গ্রুপগুলোর প্রতি সামরিক বাহিনীর সমর্থন বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ইমরান তালেবানের সমর্থনেও এগিয়ে আসেন। তার খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রাদেশিক সরকার তালেবানের বাবা হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত সামিউল হকের মাদরাসার জন্য তিন লাখ ডলার অনুদান মঞ্জুর করে। এর প্রতিদান হিসেবে সামিউল হক পিটিআইয়ের সাথে জোট গঠন করেন।

ইমরান এসব বিপজ্জনক, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সামরিক বাহিনী দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করতে পারবেন কি না, কেবল সময়ই তা বলে দেবে। অবশ্য তিনি নির্বাচনে বিজয়ের পর দেয়া ভাষণে পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক অবস্থান ফিরিয়ে আনতে গঠনমূলক ভ‚মিকা গ্রহণে প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্কোন্নয়ন, দেশের আর্থিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ইঙ্গিত দিয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে যেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায় সেটা হলো- তিনি এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পাকিস্তানের অন্য সব প্রধানমন্ত্রীর ভাগ্যে যা ঘটেছিল- তিনিও সেই একই ভাগ্য বরণ করবেন।

লেখক : পাকিস্তানি সাংবাদিক
আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement