০৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪৩১, ২৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`


ইমরান খান কি পাকিস্তানকে এগিয়ে নিতে পারবেন?

ইমরান খান - ফাইল ছবি

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির (পিটিআই) চেয়ারম্যান ইমরান খান পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। সদ্য সমাপ্ত জাতীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনে তিনি বেশ ভালো করেছেন। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও এই নির্বাচনের মাধ্যমে জাতীয় পরিষদে পিটিআই বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দেশ শাসনের জন্য দলটি অন্যদেরকে নিয়ে একটি কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে। পিটিআই খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। উল্লেখ্য, এই প্রদেশে গত বছর তারা ক্ষমতায় ছিল।

পিটিআই পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) প্রভাবিত সিন্ধু প্রদেশও তাদের শক্তিশালী অবস্থানের জানান দিয়েছে। এ ছাড়া তারা পাঞ্জাব প্রদেশেরও নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য লক্ষণীয় দূরত্বের মধ্যে রয়েছে। পাঞ্জাবে কারারুদ্ধ সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের শাসক দল মুসলিম লীগ নওয়াজ (পিএমএল-এন) সামান্য কিছু আসন বেশি পেয়েছে। পিটিআই স্বতন্ত্র সদস্যদের নিয়ে সেখানে প্রাদেশিক সরকার গঠন করতে পারবে। পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের মধ্যে পাঞ্জাবে বিপুল মানুষের বসবাস। ১০ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত পাঞ্জাব কার্যকর সরকার পরিচালনা ও সংস্কারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

নির্বাচনের আগে ধারণা করা হয়েছিল, একটি ভঙ্গুর পার্লামেন্ট বা জাতীয় পরিষদ এবং একটি ভঙ্গুর কোয়ালিশন দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে নিয়ে যাবে; কিন্তু একটি নতুন পাকিস্তান গঠনের লক্ষ্যে পিটিআইয়ের নির্বাচনী ইশতেহার অনুযায়ী উচ্চাভিলাষী ও বিস্তারিত সংস্কার কর্মসূচির সূচনা করার জন্য ইমরান খান এখন ভালো অবস্থানে আছেন। সরকার বা শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন, ফেডারেশনকে শক্তিশালী করা, ব্যাপক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কৃষির উন্নয়নে বাঁধ নির্মাণ ও পানি সংরক্ষণ, সামাজিক সেবা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এবং পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে ‘নয়া’ পাকিস্তানের এই কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।


অভ্যন্তরীণভাবে একটি সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে যেখানে আইনের শাসন, মেরিটোক্র্যাসি বা মেধাবী লোকদের দ্বারা পরিচালিত শাসন এবং সবার জন্য স্বচ্ছতার গ্যারান্টি দানের মাধ্যমে দরিদ্র ও বয়স্ক জনগোষ্ঠীর জন্য একটি সামাজিক কল্যাণমূলক নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে। একটি ন্যায়সঙ্গত শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করা হবে যেখানে সব নাগরিকের জন্য স্বাস্থ্য থেকে শিক্ষা এবং জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তাসহ সব ক্ষেত্রে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকবে। নারী, সংখ্যালঘু, গরিব এবং বিভিন্নভাবে দক্ষ লোকদের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে। অধিকারহারা, স্থানচ্যুত বা ভিটেমাটিহারা এবং সুবিধাবঞ্চিত লোকদের নিগৃহীত বা বঞ্চিত করা হবে না।


একটি অদক্ষ ও দুর্নীতিবাজ শাসক শ্রেণীর উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত অপশাসনের অ্যাজেন্ডা ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করা হবে। এসব ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হবে এবং বিদেশী সাহায্যের ওপর আর নির্ভর করতে হবে না।
চূড়ান্তভাবে, পাকিস্তানের প্রধান জাতীয় স্বার্থকে এভাবে উল্লেখ করা যায় : ভূখণ্ডগত সংহতি ও সার্বভৌমত্ব, আর্থসামাজিক উন্নয়ন, কাশ্মির বিরোধের সমাধান এবং কাশ্মিরের নাগরিকদের তারা যেখানেই থাকুক না কেন, নিরাপত্তা দেয়া। একটি ‘নতুন’ পাকিস্তান পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতে প্রতিবেশীদের সাথে শান্তি স্থাপনে দৃঢ় আস্থাশীল। এ জন্য তারা যুক্তরাষ্ট্রসহ সব রাষ্ট্রের সাথে স্বচ্ছতা, পারস্পরিক স্বার্থ এবং পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। পাকিস্তান কৌশলগতভাবে ভয় দেখিয়ে নিবৃত্ত করার তীব্র বিরোধী- তারা সঙ্ঘাত বা সঙ্কটের সমাধান চাইবেন। কিন্তু পাকিস্তান অন্যদের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না অথবা কোনো শক্তির পক্ষে ভাড়া খাটবে না।


এ ধরনের একটি বহুমুখী এবং সংহত সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার জন্য সব ফ্রন্টে একই ধরনের তৎপরতা থাকবে না, তাই এর জন্য পরম্পরা প্রয়োজন। পর্যায়ক্রমে এসব সংস্কার কার্যক্রম চালাতে হবে। লক্ষ্য এবং বাস্তব অবস্থার মধ্যকার দূরত্ব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রজ্ঞার প্রয়োজন। রাজস্ব আয় বৃদ্ধির ওপরই সামাজিক খাতে ব্যয়বৃদ্ধি এবং বিদেশী সাহায্য হ্রাস পাওয়া নির্ভর করবে। এ জন্য দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রেষণা, জবাবদিহিতা এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখার মধ্য দিয়ে আমলাতন্ত্রের সংস্কার করা প্রয়োজন। বিদেশী সাহায্য হ্রাস পাচ্ছে এবং এখন তা নমনীয় সেক্টরের দিকে ধাবিত হচ্ছে। প্রধানত, এনজিওর মাধ্যমে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা এবং সামাজিক সেক্টরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি কার্যক্রম এগিয়ে যাচ্ছে।


ইমরান তার নির্বাচন-পরবর্তী ভাষণে আপসমূলক মনোভাব দেখিয়েছেন। তিনি অতীতকে দোষারোপ করার চেয়ে বরং ভবিষ্যতের দিকে তাকাচ্ছেন। বিরোধীরা নির্বাচনে কারচুপির যে অভিযোগ করেছেন, তিনি সে ব্যাপারে বলেছেন, অবশ্যই অভিযোগ গুরুত্বের সাথে দেখা হবে এবং এ ব্যাপারে যথাযথ তদন্ত ও সহযোগিতা করতে তিনি প্রস্তুত। ইমরান খান আমেরিকাসহ প্রধান প্রধান বিশ্বশক্তি এবং পাশের ভারত ও আফগানিস্তানের সাথে সুসম্পর্ক চান বলে জানিয়েছেন।


পাকিস্তান আফগানিস্তানের ব্যাপারে সমঝোতার জন্য কাজ করছে। কিন্তু এটা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের নিজের আফগাননীতির ওপর। যুক্তরাষ্ট্র সমঝোতা প্রয়াসকে সমর্থন দেবে নাকি তালেবানদের পতন ঘটানোর চেষ্টা করবে? আমেরিকা গত ১৫ বছর ধরে তালেবান দমনে প্রচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছে। আমেরিকার অভিমত হচ্ছে, আফগান প্রিজমের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সাথে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক রক্ষা করতে চায় আমেরিকা। তারা এই অঞ্চলের ব্যাপারে তাদের নীতি পর্যালোচনা করছেন বলে জানিয়েছেন। চীন যখন পাকিস্তানের সাথে দৃঢ় সম্পর্ক বজায় রেখেছে, তখন রাশিয়ার সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক হচ্ছে ধীর এবং তা এলোমেলোভবে এগোচ্ছে।


নিরাপত্তা ইস্যুতে সব ক্ষেত্রে সামরিক কর্তৃপক্ষকে ক্ষমতা দেয়া হলেও গুরুত্বপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর বশ্যতা স্বীকার করার পটভূমি সৃষ্টি করায় আগের সরকার সমালোচিত হয়েছে। এটা অনাকাক্সিক্ষত ছিল না। কারণ দীর্ঘ দিন দেশে কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন না। পিটিআইকে শক্তিশালী নির্বাচনী সমর্থনের মাধ্যমে উজ্জীবিত করা হয়েছে এবং পিটিআই স্থিতিশীল, দক্ষ ও প্রভাবশালী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত করবে। এর মধ্য দিয়ে নতুন সরকার পররাষ্ট্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবে।


ইমরান খান প্রধানত একজন খেলোয়াড়। এরপর তিনি ক্যান্সার হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে মানবিক কাজে নিজেকে সম্পৃক্ত করেন এবং পরবর্তী সময়ে রাজনীতিবিদ হিসেবে দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছেন। কিন্তু তার গভীর আবেগপূর্ণ অবস্থা কঠোরতায় রূপান্তরিত হওয়া উচিত নয়। দক্ষিণ পাঞ্জাবকে একটি পৃথক প্রদেশে পরিণত করাসহ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধনের লক্ষ্যে সাংবিধানিক সংশোধনী আনার জন্য পার্লামেন্টে পিটিআইয়ের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই।


এসব ইস্যুতে কোয়ালিশনের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে সতর্কতা ও দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। প্রধান বিরোধী দল পিএমএল-এনকে উত্তেজিত করে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে উৎসাহিত করা উচিত হবে না। তাদের উত্তেজিত করা হলে পিটিআই আগের সরকারের বিরুদ্ধে যেমন বিক্ষোভ, পোলারাইজেশন এবং অবস্থান ধর্মঘট করেছিল- তাদেরও একই অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে তদন্তপ্রক্রিয়া অনুসরণ করে এগোতে হবে। জনগণের ওপর প্রভাব পড়ে- এ ধরনের গ্রেফতার এড়িয়ে যেতে হবে।

সব বয়সী এবং সব পর্যায়ের ভোটারের একটি বড় অংশ মনে করছেন, এটাই পরিবর্তনের সময়। তাই তারা ইমরানকে এই সুযোগ দিয়েছেন। তারা মনে করছেন, তাকে একবার সুযোগ দেয়া উচিত। পাকিস্তানের বিখ্যাত একজন কবি ও বিপ্লবী- ফয়েজ আহমদ ফয়েজ অত্যন্ত জনপ্রিয় আশার গান গেয়ে বলেছিলেন- হাম দেখেঙ্গি (আমরা দেখব), যেটা শুরু হয়েছিল এভাবে- ‘আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হবে- এটা নিশ্চিত যে, আমরাও দেখব, প্রতিশ্রুতি দিন যখন স্বৈরাচারের পাহাড় তুলার মতো উড়ে যাবে।’

সব পাকিস্তানিকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি শক্তিশালী, অধিকতর সম্মানজনক এবং ন্যায়বিচারপূর্ণ দেশে পরিণত করতে ইমরানকে অত্যন্ত দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
লেখক : অবসরপ্রাপ্ত একজন পাকিস্তানি কূটনীতিক
‘গালফ নিউজ’ থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার


আরো সংবাদ



premium cement