২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নিষিদ্ধ ওষুধে গরু মোটাতাজাকরণ

নিষিদ্ধ ওষুধে মোটাতাজাকরা গরু - ছবি : সংগ্রহ

সামনে কোরবানির ঈদ। আর কোরবানির ঈদ মানেই দেশজুড়ে পশু বেচাকেনার হিড়িক। এ ঈদ উপলক্ষে দু-এক সপ্তাহ আগে থেকেই চলে গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, দুম্বা, উটসহ বিভিন্ন ধরনের পশু বেচাকেনা। বিশেষ করে বাংলাদেশে কোরবানির জন্য গরুকেই গুরুত্ব দেয়া হয় বেশি। পছন্দের তালিকায় গরু শীর্ষে বলেই এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করেন কিছু অসাধু ব্যবসায়ী।

অধিক মুনাফা লাভের আশায় স্বল্প সময়ে বেশি মোটাতাজা করতে তারা গরুকে খাওয়ান নানা ধরনের ট্যাবলেট এবং মাংসপেশিতে প্রয়োগ করেন নিষিদ্ধ ইনজেকশন, যা গরু ও মানুষ উভয়ের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ঈদের এক-দেড় মাস আগেই গরু মোটাতাজা করার জন্য খামারিরা কিছু অসাধু পল্লী চিকিৎসকের পরামর্শে স্টেরয়েড গ্রুপের বিভিন্ন নিষিদ্ধ ওষুধ ব্যবহার করে থাকেন।

কৃত্রিমভাবে গরুর মাংসপেশিতে ভারতীয় ডেক্সামেথাসন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয় এবং খাওয়ানো হয় স্টেরয়েড গ্রুপের বিভিন্ন ট্যাবলেট। গরুর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায় এ ট্যাবলেট খাওয়ালে। এর ফলে শরীরে পানি জমতে শুরু করে। ফলে গরু মোটাতাজা দেখায়। এ গরু নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জবাই না করলে মারা যেতে পারে অথবা এর গোশত কমতে পারে। এমন গরুর গোশত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এসব ওষুধ তীব্র তাপেও নষ্ট হয় না। ফলে মানবদেহে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলে। এ ধরনের গরুর গোশত খেলে মানুষের কিডনি, লিভারসহ বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।

স্টেরয়েড গ্রুপের ট্যাবলেট খাওয়ানো বা ডেক্সামেথাসন জাতীয় ইনজেকশন দেয়া গরু খুব শান্ত হয়। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারে না। গরুর ঊরু অনেক বেশি মাংসল মনে হয়। অতিরিক্ত হরমোনের কারণে পুরো শরীরে পানি জমে মোটা দেখায়। আঙুল দিয়ে গরুর শরীরে চাপ দিলে দেবে গিয়ে গর্ত হয়ে যায়।

গরুর শ্বাস-প্রশ্বাস দেখেও গরুকে ট্যাবলেট খাওয়ানো হয়েছে কি না তা নিশ্চিত হওয়া সম্ভব। ট্যাবলেট খাওয়ানো হলে গরু দ্রুত শ্বাস-প্রশ্বাস ফেলে। গরুকে খুব ক্লান্ত দেখা যায় আর সারাক্ষণ হাঁপাতে থাকে। গরুর মুখে অতিরিক্ত লালা বা ফেনা লেগে থাকাও কৃত্রিম উপায়ে গরুকে মোটা করার আরেকটি লক্ষণ। তাই এসব ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত।

ভালোভাবে খেয়াল না করলে এসব বিষয় ধরা মুশকিল। যেহেতু সামর্থ্যবানদের ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। কোরবানি করার জন্য গরু কিনতেই হবে। তাই সুস্থ আর ভালো গরু চিনেই কেনা উচিত। কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা গরু আমাদের অবশ্যই এড়িয়ে চলা উচিত। ভালো হয় অভিজ্ঞ কাউকে সাথে নিয়ে গরু কিনলে। এতে করে যেমন ভালো গরু কেনা যাবে, তেমনি অসাধু গরু ব্যবসায়ীদের প্রতারণা থেকে বাঁচা সম্ভব।

আরো পড়ুন :

নারীশ্রমিকদের ওপর নির্মমতা
রহিমা আক্তার মৌ

৩২ বছর বয়সী সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান দেশটির নারীদের বেশ কিছু অধিকার প্রদানের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে নারীরা প্রথমবারের মতো সে দেশের লোকাল নির্বাচনে ভোট প্রদান ও ভোটে দাঁড়ানোর সুযোগ পেলেন। ২০১৬ সালের এপ্রিলে দেশটির পুলিশের যত্রতত্র পাবলিককে হয়রানি করার ক্ষমতা কমিয়ে আনা হয়। একই বছর অক্টোবরে দেশটির রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রখ্যাত আরব কণ্ঠশিল্পী উম্মে কুলসুুমের কনসার্ট প্রচারিত হয়েছে। ঘোষণা করা হয়, ২০১৮ সাল থেকে নারীরা স্টেডিয়ামে বসে খেলাধুলা উপভোগ করতে পারবেন। একই বছর জুন মাসে সৌদি নারীরা গাড়ি চালানোর সুযোগ পেয়ে আনন্দিত। যখন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নারীরা ফাইটার প্লেন থেকে শুরু করে সব কিছুই চালাচ্ছে, তখন সৌদি নারীরা গাড়ি চালিয়ে আনন্দ উপভোগ করছেন।

ভাগ্য বদল করতে চাইলেই কি তা করা যায়? তাও আবার বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়া ভাগ্যবিপর্যয়গ্রস্ত গৃহশ্রমিক বলে কথা। তবুও তারা স্বপ্ন দেখেন ভাগ্যকে বদলানোর, পরিবারের মুখে হাসি ফুটানোর, স্বপ্ন দেখেন নিজের কঠোর শ্রমের বিনিময়ে সন্তানকে মানুষ করার। কিন্তু সেসব স্বপ্ন যখন ভেঙে যায় অন্যের লোভ-লালসার ফলে, তখন তাদের দেশে ফিরে আসা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। দেশে ফিরে আসেন ঠিকই, কিন্তু সবাই প্রিয়জনের কাছে ফিরতে পারেন না।

ভাগ্যবদলের আশায় নারীরা সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশে যান। তবে কেউ তিন মাস, কেউ ছয় মাস, কেউবা এক বছর কাজ করেই ফিরে আসেন। সেখানে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হতে খুব বেশিদিন লাগে না। শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে এ বছর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশটি থেকে ফিরেছেন প্রায় এক হাজার বাংলাদেশী নারী। এর মধ্যে ১ থেকে ৬ জুন পর্যন্ত ছয় দিনেই এসেছেন ৮২ জন নারী। গৃহশ্রমিকদের কেউ ফেরেন শরীরে আঘাত নিয়ে, কেউ ফেরেন বিপর্যস্ত মন নিয়ে, আর কেউ ফেরেন ভিনদেশের ভদ্র সমাজের অমানুষের ঔরসজাত সন্তান নিয়ে। দেশে ফিরে সরকারের কোনো সংস্থাকে পাশে পাচ্ছেন না। এমনকি পরিবারেও ঠাঁই হচ্ছে না অনেকের। সামাজিকভাবেও হেয় হতে হচ্ছে তাদের।

লেবানন থেকে প্রায় এক বছর আগে দেশে ফিরেছে ২৫ বছর বয়সী এক নারী গৃহকর্মী। তার কোলে ছিল এক মাস ১০ দিন বয়সী শিশু। তিনি যেখানে কাজ করতেন, ওই বাসার গৃহকর্তা শিশুটির ‘বাবা’। এই নারী জানান, লেবাননে যাওয়ার পর থেকে গৃহকর্তা তাকে নির্যাতন করতে থাকেন। ওই ব্যক্তির স্ত্রীর কাছে অভিযোগ করলেও তিনি এটি বিশ্বাস করেননি। পরে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে উল্টো মামলা দিয়ে তাকে জেলে পাঠানো হয়। সন্তান জন্ম দেয়ার পর তাকে দূতাবাসের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হলো। বিমানবন্দর থেকে তাকে নেয়া হয় বেসরকারি সংস্থা অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন কর্মসূচির (ওকাপ) নিরাপদ আবাসে। সেখানে কয়েক মাস ছিলেন তিনি। সংস্থাটি চিকিৎসার পাশাপাশি এই নারীকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কাউন্সিলিংসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে তিনি বাড়ি ফিরেছেন। বিদেশে কাজ করে মেয়েটি পরিবারে বাবা ও স্বামীর কাছে তার আয়ের সব টাকা দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু দেশে ফেরার পর তারা আশ্রয় দিতে চাননি।

বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাত লাখ ৩৫ হাজার ৫৭৫ জন নারী কর্মরত আছেন। তাদের মধ্যে সৌদি আরবে গেছেন দুই লাখ ৩৪ হাজার ৮৩১ জন নারী। বিশেষ করে ২০১৫ সালে সমঝোতা হওয়ার পর দুই লাখের বেশি নারী বিদেশে গেছেন। অথচ তাদের অনেকেই সঙ্কটে পড়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছেন। চাকরি শেষ করে বা প্রতারণার শিকার হয়ে কতজন নারী শ্রমিক দেশে ফেরত এসেছেন তার কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য কারো কাছে নেই। অবশ্য গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত তিন বছরে প্রায় পাঁচ হাজার নারী ফেরত এসেছেন। এর মধ্যে অন্তত এক হাজার ফিরেছেন এ বছরই। চলতি বছরের মে থেকে ১০ জুন পর্যন্ত সৌদি আরবের রিয়াদের ইমিগ্রেশন ক্যাম্প থেকে দেশে ফিরেছেন ৩৬০ জন নারী কর্মী।

বাংলাদেশ এবং সৌদি আরবের মধ্যে গৃহকর্মী নেয়ার জন্য চুক্তি হয়েছিল ২০১৫ সালে। সৌদি সরকার দুই লাখের বেশি নারী কর্মীর চাহিদা জানালে বাংলাদেশ থেকে মাসে ১০ হাজার নারী কর্মী পাঠানোর কথা বলা হয়। ২০১৫ সালের হিসাবে মাত্র ২০ হাজার ৯৫২ জন নারী সৌদি আরবে গেছেন। সৌদি সরকার তখন বাংলাদেশকে জানিয়েছে, এখন দুই লাখ নারীর জন্য ভিসা প্রস্তুত রয়েছে। ২০১৬ সালে ৬৮ হাজার, ২০১৭ সালে ৮৩ হাজার; আর চলতি বছর ২০১৮ সালের প্রথম দুই মাসে গেছেন ১৬ হাজারের মতো। কিন্তু গৃহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশী নারীদের সৌদি আরবে যাওয়ার আগ্রহ কম। আবার কাজ করতে যাওয়ার অল্প দিনের মধ্যে নারীদের ফেরত আসার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে বেশি।

সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশে বিপদে পড়া এবং ফেরত আসা ওই নারী কর্মীদের সহায়তা দিতে জরুরি সহায়তা কর্মসূচি নিয়েছে ব্র্যাক। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান এর যৌক্তিকতা তুলে ধরে বলেন, বাংলাদেশ থেকে যেসব নারী বিদেশে কাজ করতে যান, তাদের বেশির ভাগই দরিদ্র। অনেকে পরিবারে ফিরতে পারছেন না বা পরিবার নিতেও চাচ্ছে না। সমাজও তাদের নিচ্ছে না স্বাভাবিকভাবে। নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসা নারীরা এর ফলে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে ফের ঝুঁকিতে পড়ছেন।

তথ্য প্রমাণ বলছে, বাংলাদেশী নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে পাঠানো নিরাপদ নয়। তাহলে কেন তাদের বিদেশে পাঠাতে হবে? বিদেশ ফেরত নারীদের আর কত কান্না আমরা শুনব? ভিন দেশে নারীরা শারীরিক, মানসিক ও যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা যখন নারী কর্মী পাঠানো কমিয়ে দিচ্ছে, কেন আমাদের দেশ গৃহকর্মী পাঠাচ্ছে? দেশের ভেতর যদি শুধু পোশাক খাতেই ৪০ লাখ কাজ করতে পারেন, তাহলে কেন বিদেশে গৃহকর্মী পাঠাতে হবে? মানুষের যদি অধিকার নিশ্চিত না হয়, তাহলে কোনো উন্নয়নেই কাজ হবে না। অসহায় দরিদ্র নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা দেশেই করতে হবে, আর পাঠাতে চাইলে আগে অবশ্যই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সরকার বা যেসব এজেন্সির মাধ্যমে তারা যাবেন, তাদের সে দায়িত্ব নিতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement