২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হজ ব্যবস্থাপনার এক দশক

হজ ব্যবস্থাপনার এক দশক - ছবি : সংগৃহীত

ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। কুরআন ও হাদিসের বিধান অনুসারে, আর্থিক ও শারীরিকভাবে সক্ষম মুসলমান নর-নারীর ওপর জীবনে একবার হলেও হজ করা ফরজ। হজব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ও সৌদি আরব সরকারের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জড়িত। অনেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা এ কার্যক্রমের সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। হজব্যবস্থাপনার পুরো বিষয়টি সমন্বয় করে থাকে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

২০০৯ সালের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনার আলোকে সুষ্ঠু হজব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় জাতীয় হজনীতি ২০১০-২০১৪ প্রণয়ন করেছে। এটাকে ভিত্তি করে জাতীয় হজনীতি-২০১৫-১৬, জাতীয় হজ ও ওমরাহ নীতি-২০১৫, জাতীয় হজ ও ওমরাহনীতি ২০১৭ এবং সর্বশেষ, জাতীয় হজ ও ওমরাহনীতি ২০১৮ প্রণয়ন করা হয়। আধুনিক, যুগোপযোগী ও প্রযুক্তিনির্ভর কাঠামোর ওপর দাঁড় করানোর লক্ষ্যেই এই নীতি।

পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা সম্পাদিত হয় মক্কা আল-মোকাররমায়। সৌদি আরবে বাংলাদেশের সার্বিক হজব্যবস্থাপনা দায়িত্ব কাউন্সেলরের (হজ)। হজসংশ্লিষ্ট মোয়াছসাসা অফিস, মোয়াল্লেম অফিস, মক্কায় গভর্নর অফিস, ইউটিলিটি অফিসগুলো, হজযাত্রীদের আবাসন ইত্যাদি মক্কায় অবস্থিত। সঙ্গত কারণেই পাকিস্তানের ডাইরেক্টর জেনারেল (হজ) অফিস এবং ভারতের ডাইরেক্টর (হজ) অফিস রয়েছে মক্কায়। বাংলাদেশের কাউন্সেলরের (হজ) কার্যালয় (হজ উইং) জেদ্দাস্থ কনস্যুলেট জেনারেল অব বাংলাদেশ ভবনে থাকার ফলে কাউন্সেলরকে (হজ) প্রতিনিয়ত জেদ্দা-মক্কা-জেদ্দা যাতায়াত করে হজের কার্যক্রম সম্পাদন করতে হতো। ফলে কাজ অহেতুক বিলম্বিত হতো এবং অর্থেরও অপচয় হতো। হজ উইংয়ের অফিস তাই মক্কায় বাংলাদেশ হজ মিশনে স্থানান্তর করা জরুরি হয়ে পড়ে। ২০০৯ সালে এটা করা হয়েছে। হজ মওসুমে তথা চার মাস হজ অফিস মক্কায় কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। অবশিষ্ট সময় বাংলাদেশ হজ অফিস, জেদ্দা থেকে কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

২০০৮ সাল পর্যন্ত হজব্রত পালন করা হতো পিলগ্রিমেজ পাসপোর্টের মাধ্যমে। সৌদি সরকার ২০০৯ সাল থেকে আবশ্যকীয়ভাবে হজযাত্রীদের জন্যও ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্টের মাধ্যমে হজ ভিসা ইস্যুর বিধান চালু করে। হজযাত্রীর সংখ্যা (২০০৮ সালের) চেয়ে ২০০৯ সালে প্রায় দশ হাজার বৃদ্ধি পেয়ে ৫৮ হাজার ২২০ জনে পৌঁছে। এ অল্প সময়ের মধ্যে এত অধিক ইন্টারন্যাশনাল পাসপোর্ট তৈরি ও সরবরাহ কষ্টসাধ্য হলেও ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় তা সম্পন্ন করেছে।

রূপকল্প-২০২১ তথা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে হজব্যবস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় একটি ইন্টারঅ্যাকটিভ ওয়েবসাইট প্রবর্তন করেছে www.hajj.gov.bd। সব হজযাত্রীর তথ্য ডেটাবেইজে সংরক্ষণ করে অনলাইনে ভিসা লজমেন্ট ও হজের আনুষঙ্গিক তথ্য সৌদি দূতাবাস ও মোয়াছসাসাকে পাঠানো হয়। হজযাত্রী ও এতদসংক্রান্ত সব পক্ষের সেবা নিশ্চিত করার জন্য ঢাকা হজ ক্যাম্পসহ মক্কা, মদিনা, জেদ্দা ও মিনায় আইটি হেল্পডেস্ক স্থাপনের মাধ্যমে তথ্যসেবা দেয়া হচ্ছে।

ওআইসির নীতিমালা অনুসারে এবং সৌদি সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, জনসংখ্যা অনুপাতে বাংলাদেশের হজযাত্রীর কোটা সর্বোচ্চ এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন। ২০০৯ সাল থেকে ২০১২ সালের মধ্যে হজযাত্রীর সংখ্যা নির্ধারিত কোটা পূর্ণ করার কাছাকাছি চলে যায়। ২০১৩ সাল থেকে পবিত্র মসজিদুল হারাম সম্প্রসারণসহ সংস্কারকাজ শুরু হওয়ায় সৌদি সরকার সারা বিশ্ব থেকে ২০ শতাংশ কম হজযাত্রীকে হজের সুযোগ দিয়েছে। এতে বাংলাদেশ থেকে প্রথমবারের মতো কোটার বেশি হজযাত্রী হজের জন্য আবেদন করে এবং প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়। এ বিশেষ পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার ‘আগে এলে আগে পাবেন’ ভিত্তিতে বছরব্যাপী অনলাইন পদ্ধতিতে হজের প্রাক-নিবন্ধন পদ্ধতি চালু করেছে। ২০১৫ সালে প্রাথমিকভাবে এবং ২০১৬ সাল থেকে অনলাইনে প্রাক-নিবন্ধন প্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গভাবে চালু রয়েছে।

প্রায় সব হজযাত্রী বাংলাদেশ থেকে জেদ্দা হজ টার্মিনালে অবতরণ করে থাকেন। ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় হজযাত্রীদের সুবিধার্থে ২০১০ সাল থেকে প্রতি বছর আনুমানিক ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে জেদ্দা হজ টার্মিনালে প্লাজা ভাড়া করছে। ওই বিমানবন্দরে হজযাত্রীদের সেবায় একজন মওসুমি হজ অফিসারের তত্ত্বাবধানে প্রশাসনিক দল, চিকিৎসা দল, আইটি টিম ও কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত, হজ অফিস হজযাত্রীদের প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে থাকে।

হজযাত্রীরা ঢাকা বিমানবন্দরসংলগ্ন হজক্যাম্পে রিপোর্ট, হজের প্রশিক্ষণ গ্রহণ এবং আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে থাকেন। সেজন্য তাদের কয়েক দিন আশকোনার হজ ক্যাম্পের ডরমিটরিতে অবস্থান করতে হয়। প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি মোতাবেক, ২০১০ সালে হজযাত্রীদের সুবিধার্থে হজক্যাম্পের ডরমিটরিতে প্রায় পৌনে দুই কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি লিফট এবং ক্যাম্পে হজযাত্রীদের বিমান/কাস্টমস/ইমিগ্রেশন এলাকায় সেন্ট্রাল এসি স্থাপন করা হয়েছে।

মন্ত্রণালয় যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয়সংখ্যক এজেন্সিকে লাইসেন্স দিয়েছে। হজনীতি অনুসারে প্রতিটি এজেন্সি সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে সর্বনি¤œ ১৫০ জন হজে পাঠানোর ব্যবস্থা করে থাকে। বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলোর সংগঠন হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) এগুলোর নেতৃত্ব দিয়ে থাকে। হজযাত্রীদের সেবার মান বৃদ্ধির জন্য মক্কা হজ মিশনে হাব-এর জন্য আলাদা অফিস ও হেল্প ডেস্ক রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

হজযাত্রীদের জন্য মক্কা ও মদিনায় উন্নত মানের আবাসনের ব্যবস্থা, তথা বাড়ি ভাড়ার ক্ষেত্রে কোটারিভিত্তিক অনিয়ম দূর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়েছে। দূরবর্তী, পুরাতন ও পাহাড়ের ওপর বাড়ি ভাড়া করার পরিবর্তে কাছে ও সমতল ভূমিতে বাড়ি ভাড়া করা হয়। উন্নত মানের নতুন বড় বাড়ি/হোটেল ভাড়া করে সেবার মান বৃদ্ধি করা হয়। সুষ্ঠু হজব্যবস্থাপনায় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হলো হজ যাত্রীদের জন্য সঠিক সময়ে নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। বাংলাদেশ-সৌদি আরব দ্বিপক্ষীয় হজ চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের দুটি জাতীয় এয়ারলাইন্স ৫০ শতাংশ হারে হজযাত্রী পরিবহন করে থাকে।

এ ব্যবস্থাপনার সাথে অনেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা জড়িত। ২০০৯ সাল থেকে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের মধ্যে নিবিড় সমন্বয় করে চলেছে। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুণগত মান বৃদ্ধি পেয়ে সার্বিক হজব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গত নয় বছরে হজযাত্রীদের সংখ্যা আগের তুলনায় ব্যাপক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে সেবার মান বাড়ায় এবং শৃঙ্খলা ফিরে আসায় হজযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় তিন গুণে উন্নীত হয়েছে। ব্যবস্থাপনাকে আরো উন্নত, সুষ্ঠু ও সুশৃঙ্খল করার লক্ষ্যে ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় আইনি ভিত্তি সুদৃঢ় করাসহ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। হজব্যবস্থাপনা কার্যক্রমকে আরো সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও জনবল বৃদ্ধির মাধ্যমে হজ অফিসকে একটি পূর্ণাঙ্গ অধিদফতরে উন্নীত করতে কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়েছে। সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

সৌদি হজ মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ দক্ষিণ এশীয় হাজী সেবা সংস্থা তথা মোয়াছসাসা অফিস ২০১০ ও ২০১১ সালে হজব্যবস্থাপনায় উন্নতি হওয়ায় বাংলাদেশকে ‘দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থানীয়’ বলে স্বীকৃতি দিয়ে সরকারকে পত্র দিয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement