২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি

একটি ভয়ঙ্কর সামাজিক ব্যাধি - ছবি : সংগৃহীত

দেশে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা। গত ১০ বছরে প্র্রতিদিন গড়ে ১১ জন নারী সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশে। নারী ও শিশুর প্র্রতি নির্মমতা ও নির্যাতনে হতবাক ও ক্ষুব্ধ হচ্ছেন বিবেকবান মানুষ।

পুলিশের ধারণা, শিশুরা এক শ্রেণীর বিকৃতমনা মানুষের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। নিপীড়ন চালানোর একটা বড় কারণ নৈতিকতাহীন মানসিকতা।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১২ সালে ৮৬ জন, ২০১৩ সালে ১৭৯ জন, ২০১৪ সালে ১৯৯ জন ও ২০১৫ সালে ৫২১ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ চিত্র থেকে স্পষ্ট, প্র্রতি বছরই শিশু ধর্ষণের ঘটনা বেড়েই চলেছে। সংস্থাটির বার্ষিক প্র্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ৬৮৬টি শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ইভটিজিং, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন ধরনের নিপীড়নের শিকার। ২০১৫ সালে সারা দেশে ৭২৭টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। জরিপ অনুসারে, ২০১৫ সাল থেকে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন ও পাশবিক নিপীড়ন আশঙ্কাজনক বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১৪ সালে সর্বমোট ২২৪টি শিশু যৌন নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে। পথেঘাটেও দেদার ঘটছে শিশু ধর্ষণের বর্বরোচিত ঘটনা।

সমাজতাত্ত্বিকেরা বলতে পারবেন, একটা সমাজ কতখানি অসুস্থ হলে এ রকম নারকীয় ঘটনা রোজ ঘটতে পারে। শিশুদের ওপর নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ হিসেবে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ী করেন। পুলিশের পক্ষ থেকেও স্বীকার করা হচ্ছে, শিশুদের ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। শিশুদের নিয়ে পর্নোগ্রাফি তৈরি করছে অর্থগৃধনুরা। একশ্রেণীর মানুষ শিশুদের নিছক ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখছে। অনেক ক্ষেত্রে এতে পর্নোগ্রাফির প্রভাব রয়েছে। গবেষকদের মতে, ক্রমবর্ধমান হারে শিশু যৌন লালসার শিকার হওয়ার পেছনে রয়েছে কুসংস্কারও। এই যুগেও বহু মানুষ বিশ্বাস করে, শিশু বা কুমারীদের সঙ্গে যৌন সংসর্গ করলে যৌনরোগ নিরাময় হয়।

সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের এক রায়ে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানি প্রতিরোধে দেশের প্রতিটি থানায় আলাদা সেল গঠন করতে হবে এবং এক মাস পরপর মামলার বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করবে থানা সেল; কিন্তু গত ১০ মাসেও আদালতের এ নির্দেশ বাস্তবায়ন করা হয়নি।

নারীর প্রতি সহিংসতাও বেড়ে চলেছে। ধর্ষণের পর হত্যা ও লাশ গুম করার ঘটনাও ঘটছে। পরিচয় নিশ্চিহ্ন করতে নারীকে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটছে। তবু সুষ্ঠু বিচার পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। ফরেনসিক পরীক্ষার ঝামেলা এবং আলামত সংগ্রহ করতেও অভিযুক্তকে পুলিশের কাছে উপস্থিত হতে বাধ্য করায় অনেকেই লোকলজ্জায় এসব ঘটনা এড়িয়ে যেতে চান।

থানায় মামলা হলেও গ্রেফতার হয় না অপরাধী। গ্রেফতার হলেও মামলা বেশি দূর এগোয় না। প্রভাবশালী বা ক্ষমতাসীনদের হুমকিতে আছেই; তাদের মধ্যস্থতায় কথিত মীমাংসা করতে বাধ্য হন অভিযুক্তরা। মামলা চলাকালে বিভিন্ন বিব্রতকর পরিস্থিতি এবং বিচারে দীর্ঘসূত্রতা জনমনে আইনের আশ্রয় নিতে অনীহা তৈরি করে। ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে এসব প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে কী ভাবছে রাষ্ট্র?

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে বলা আছে, ১৮০ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট মামলার প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। কিন্তু এমন অনেক নজির আছে যে, বছরের পর বছর মামলা চলছে। বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করতে বলছেন শিশু অধিকার কর্মীরা। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বিচারকস্বল্পতা এ ক্ষেত্রে একটি সঙ্কট বলে উল্লেখ করেছেন। মামলা ঝুলিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আসামি পক্ষের মানসিকতারও পরিবর্তন ঘটাতে হবে।

মানবাধিকার সংগঠন অধিকার’র পরিসংখ্যান বলছে, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে তিন হাজার ৮৩১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে শিশু ধর্ষণের শিকার দুই হাজার ৩০৮ জন। ২০১২ সালে ধর্ষণের শিকার ৮০৫ জনের মধ্যে ৪৭৩ জনই শিশু। ২০১৩ সালে ধর্ষণের শিকার ৮১৪ জনের মধ্যে ৪৫২ জন শিশু; ২০১৪ সালে ৬৬৬ জনের ৩৯৩ জন শিশু; ২০১৫ সালে ৭৮৯ জনের মধ্যে ছিল ৪৭৯ জন শিশু। ২০১৬ সালে ধর্ষণের শিকার ৭৫৭ জনের মধ্যে ৫১১ জনই শিশু। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ৩৬ জন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪ এবং মার্চে ৫৫ জন।

নির্যাতিত নারী ও শিশুদের চিকিৎসার্থে গঠিত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রায় প্রতিদিনই ধর্ষণের শিকার শিশু ওসিসিতে ভর্তি হয়েছে। বেশির ভাগ শিশুর বয়স ছয় থেকে ১৬ বছরে মধ্যে। ওসিসির সমন্বয়ক ডা: বিলকিস বেগম জানান, শিশুরাই ধর্ষণের সবচেয়ে বড় শিকার। কারণ তারা কিছুই বলতে পারে না, অসহায় থাকে ধর্ষণের সময়। ওরা নরপশু দুর্বৃত্তকে ভয়ও পায়। শিশুরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নিজ ঘরেও, এমনকি নিকটাত্মীয়-স্বজনদের হাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছে না তারা। এ অবস্থায় তাদের চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছে ওসিসি।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯ ধারা অনুযায়ী, যে শাস্তির বিধান রয়েছে তা হলো- ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশুর মৃত্যু হলে ধর্ষণকারীর জন্য রয়েছে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অন্যূন এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান। একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে ধর্ষণকালে বা ধর্ষণের পর যদি তার মৃত্যু ঘটে, তবে ওই দলের সবার জন্যই এই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

বাংলাদেশে ধর্ষণ বাড়ছে, বাড়ছে হত্যা। এর সাথে একই ভাবে বাড়ছে নিষ্ঠুরতা অথচ এই অপরাধের সাথে জড়িতদের আইনের আওতায় তেমন আনা যাচ্ছে না বলা চলে। এর কারণ, অনেকেরই আছে ক্ষমতার ‘আশীর্বাদ’, তাই তারা অপ্রতিরোধ্য। কোনো নারীই যেন আজকাল আর নিরাপদ নন।
রাস্তাঘাট, হাট-মাঠ, বাস-ট্রেন, স্কুল-কলেজ, কর্মস্থল কিংবা আপন গৃহস্থল- কোথায় কার কাছে নারী নিরাপদ? বিবেকবান প্রতিটি পুরুষই এসব ঘটনায় লজ্জিত হওয়া উচিত।

লেখক : শিক্ষার্থী, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল


আরো সংবাদ



premium cement
ভারতে দ্বিতীয় পর্বে ৮৮ আসনে ভোট খালেদা জিয়ার সাথে মির্জা ফখরুলের ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক গাজায় ইসরাইলের যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভ অব্যাহত পাবনায় ১০ কোটি টাকার অনিয়মে ৩ ব্যাংক কর্মকর্তা আটক জীবন্ত মানুষকে গণকবর আগ্রাসন ও যুদ্ধকে ‘না’ বলার আহ্বান মার্কিন মানবাধিকার প্রতিবেদনে আনা অভিযোগ ভিত্তিহীন : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বৃষ্টির জন্য সারা দেশে ইসতিস্কার নামাজ আদায় আরো ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট তাপপ্রবাহ মে পর্যন্ত গড়াবে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে ঢাকার ভূমিকা চায় যুক্তরাষ্ট্র বিদ্যুৎ গ্যাসের ছাড়পত্র ছাড়া নতুন শিল্পে ঋণ বিতরণ করা যাবে না

সকল