২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১, ১৭ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাধারণ শিক্ষা

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সাধারণ শিক্ষা - ছবি : সংগ্রহ

শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। সুশিক্ষিত জনগণ জাতির উর্বর মস্তিষ্ক। একটি দেশের পরিকল্পিত উন্নয়ন-অগ্রগতি সুশিক্ষিত জনগোষ্ঠী ছাড়া কোনোভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু বাংলাদেশে সাধারণ শিক্ষাকে অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিতে গিয়ে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষাকে অবহেলা করা হচ্ছে। যা দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নকে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। তথাকথিত সাধারণ শিক্ষা শেখায় কিভাবে চাকরি পাওয়া যায় বা চাকরি খুঁজতে হয়। কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষা শেখায় কিভাবে কর্মদক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে কাজে আত্মনিয়োগ করে সাবলম্বী হওয়া যায় এবং কিভাবে সফল উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যায়।

প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে সুখ্যাত দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে গেলে দেখা যায়- কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, হাকিম চত্বর এবং টিএসসিতে সদ্য সুপারিশপ্রাপ্ত ও নিয়োগপ্রাপ্ত বিসিএস ক্যাডার কর্মকর্তাদের মিলনমেলা বসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে পাওয়া যাবে অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী লেখাপড়া করছে, তিল ধারনের ঠাঁই নেই। এটি সুখের সংবাদ না হয়ে দুঃখের সংবাদ কারণ তাদের মধ্যে খুব কম সংখ্যক শিক্ষার্থী মৌলিক গবেষণা ও বিষয়ভিত্তিক লেখাপড়া করে। সবার সামনে বিসিএস, ব্যাংক জবের বিভিন্ন বই ও গাইড সিরিজ। গুণগত শিক্ষা ও মৌলিক গবেষণার স্থানে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আজ বিসিএসহ নানা রংবেরংয়ের চাকরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যার ফলস্বরূপ এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ব রেটিং এ পৃথিবীর অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়ে পড়ছে। এটা জাতির জন্য বড় লজ্জ্বার। তাই বলা যায়, সাধারণ শিক্ষা দিয়ে দেশ চালানো যায় কিন্তু গুণগত উন্নয়ন ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বের সাথে তাল মেলানো দুরূহ হয়ে পড়ে।

এ দেশে কিছু সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছাড়া বিসিএস চাকরি বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রত্যাশিত। আমেরিকা-ইউরোপে ছাত্রছাত্রীরা লেখাপড়া শেষ করে নিজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নিজে ও মানুষকে কর্মসংস্থানের চিন্তা করে। এ শিক্ষা তারা পরিবার, সমাজ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পায়। এই জন্য তারা পেয়েছে স্টিভ জবস, মার্ক জাকারবার্গ, লেরি পেইজের মতো উদ্যোক্তা ও প্রকৌশলী।
চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া এগিয়ে গেছে কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে। চীন এক যুগের মতো সাধারণ শিক্ষা থেকে তাদের জনগণকে বিরত রেখেছিল। তার ফলস্বরূপ তারা সারা বিশ্বের তথ্য-প্রযুক্তি থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের প্রায় সব দ্রব্য-সামগ্রীর বাজার দখল করে নিয়েছে। তাদের বাড়িতে বাড়িতে মোবাইল, টিভি, ক্যামেরাসহ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স পণ্য তৈরির বা সংযোজনের কেন্দ্র। আমাদের অনেক এলাকার বাড়িতে বাড়িতে বিড়ি তৈরি করার কারখানা। এটায় তাদের ও আমাদের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য তৈরি করে দিচ্ছে।

বাংলাদেশে কেউ ইংরেজি ভালো পারলে তাকে মাথায় তুলে রাখা হয়। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বড় বড় পোস্টে চাকরি দেয়া হয়। অথচ চীন-জাপান, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানির মানুষ ইংরেজি ভালো বোঝে না, বলতেও পারে না। তারা বোঝে কাজ, গবেষণা। তারা জানে কিভাবে দেশের ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে মূল্যায়ন করতে হয়। অন্য দিকে আমরা ব্রিটিশদের প্রদত্ত কেরানী হওয়া মান্দাতার আমলের শিক্ষাব্যবস্থার লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি ঠেলছি পাহাড় ঠেলার মতো। এ শিক্ষায় অফিসের ভালো কেরানি তৈরি হচ্ছে কিন্তু তেমন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। যারা এ দেশে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেদেরকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তারা নিজগুণে নিজেদেরকে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষায় সমৃদ্ধ করে নিয়েছেন। বর্তমানে দেশের বাস্তবমুখী শিক্ষার কদর্যচিত্র দেখে মনটা বিষাদে ভরে যায়।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করে শিক্ষাবোর্ড প্রণীত স্কুল পাঠ্যক্রমে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার সফলতা পেতে শুরু করেছে। সঠিক ও সৎ পথে যেকোনো কাজ বা বৃত্তি যে ছোট বা হীন নয় তা বুঝতে শিখেছে দেশের জনগণ। একটি সরকারি কলেজের ক্যাম্পাসে বাদাম-বুট বিক্রি করে একজন আজ কোটিপতি। তার বাড়িতে ভাড়া থাকে সেই কলেজের একজন সহযোগী অধ্যাপক। গুলশান সিটি করপোরেশন মার্কেটে একজন সবজি বিক্রেতার সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে আজ সে অভিজাত এলাকায় ফ্লাটের মালিক। স্কুল, কলেজ বা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভার, ইলেকট্রিশিয়ান, প্লাম্বার এবং কম্পিউটার অপারেটরের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে দু’তিনটার বেশি সিভি বা আবেদন পড়ে না। কিন্তু শিক্ষক, ফ্লোর ম্যানেজমেন্ট, ছায়াশিক্ষকের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দিলে শত শত সিভি ও আবেদন পড়ে। যারা এইচএসসিতে অকৃতকার্য হয়ে সেনাবাহিনীতে সৈনিক পদে চাকরিতে ঢুকেছিলেন তারা জাতিসঙ্ঘের শান্তিমিশনে সিয়েরা লিওনে গিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে ছবি তুলে ফেসবুকে আপলোড দেয়। তাদের ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরকারি বেতনের পাশাপাশি জাতিসঙ্ঘ প্রদত্ত বেশ ভালো অঙ্কের টাকা জমা হচ্ছে। মূলত এ দেশকে এগিয়ে নিচ্ছে এ দেশের খেটে খাওয়া মানুষ- কৃষক, কুলি, মজুর, প্রবাসী শ্রমিক। এদের কাঁধে দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মহান বোঝা।

এমন প্রেক্ষাপট বিবেচনায় আমাদের সামনে যৌক্তিক কারণে এসে যায় সাধারণ শিক্ষাকে অবহেলা-অগ্রাহ্য না করে কারিগরি ও জীবনমুখী শিক্ষা, পেশা ও বৃত্তিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করার বিষয়টি।
তাই সময় এসেছে কর্মজীবী শ্রেণির মূল্যায়নের, সময় এসেছে কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষাকে সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে বর্তমান উন্নয়ন মহাসড়কে দুর্বার গতিতে চলমান দেশকে এগিয়ে নেয়ার। এটি করা সম্ভব হলে সামাজিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিস্ময় বাংলাদেশ হবে বিশ্ব উন্নয়নের রোল মডেল।
লেখক : এমফিল গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


আরো সংবাদ



premium cement